মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

‘মাইন দিয়ে ৬টি পণ্যবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলাম’

শওকত আলী, চাঁদপুর
 | প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:১২
মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী, বীরপ্রতীক

মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন বীর নৌ কমান্ডো। খেতাব পান বীরপ্রতীক। ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কর্মজীবনে ছিলেন সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। সচিব পদমর্যাদায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী ১৯৫০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর সদরের মৈশাদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ১৯৬৫ সালে সফরমালী হাইস্কুল থেকে এসএসসি, চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে এইচএসসি এবং ১৯৭০ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসির ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ’৬৭ সালে ছাত্রদের ১১ দফা এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।

যুদ্ধকালীন দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মো. মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র, সেই সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারাদেশের ছাত্র-জনতা ছিল ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উৎসাহিত হই। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঢাকাসহ দেশের নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের খবর শুনে ভয়াল মার্চ মাসের শেষের দিকে নিজ গ্রাম মৈশাদীতে চলে আসি।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকার মতো চাঁদপুরেও বর্বর হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন এবং নারী নির্যাতন শুরু করে। এটা দেখে ভীষণ কষ্ট পাই এবং মর্মাহত হই। সিদ্ধান্ত নেই, পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এপ্রিলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যাই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমারা ক্যাম্পে।

এখানে কিছুদিন গেরিলা প্রশিক্ষণ নেই। এরপর মে মাসের প্রথমদিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় নৌ কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য অন্য যুবকদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক পলাশীর ‘নৌ কমান্ডো ট্রেনিং সেন্টারে’ নেওয়া হয়। একটানা প্রায় আড়াই মাস কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নৌ কমান্ডো প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশিক্ষিত একজন নৌ কমান্ডো হিসেবে নিজেকে তৈরি করি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, নৌ কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের কমান্ডো দলের সঙ্গে চাঁদপুর নদী বন্দরে অপারেশনে আসি। আমি ছিলাম এ কমান্ডো দলের উপ-দলনেতা। এ সময় আমাদের নৌ কমান্ডোদের ঘাঁটি ছিল সদর উপজেলার গুণরাজদি করিম খানের বাড়িতে।

১৫ আগস্ট চাঁদপুর নৌ বন্দরে আমার নেতৃত্বে কমান্ডো গ্রæপ পুরনো লঞ্চঘাট, ৫নং কয়লাঘাট, স্টীমারঘাট, বিআইডব্লিউটিএ ঘাট ও মেঘনার মাঝখানে ছয়টি পণ্যবাহী জাহাজ লিমপেট মাইনের মাধ্যমে গভীর পানিতে ডুবিয়ে দেই। এতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে রাতে চাঁদপুর নৌ বন্দর পাক সেনাদের জন্য চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

এরপর ভারতে চলে যাই। প্রায় দেড়মাস পর চাঁদপুর ফিরে এসে অন্য নৌ-কমান্ডোদের সঙ্গে নদী বন্দরে ২৬ অক্টোবর পাক বাহিনীর দুটি খাদ্যবাহী নৌকা দখল, ২৯ অক্টোবর নতুন বাজার বার্মা ইস্টার্ন কোম্পানির তেল ডিপোতে বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে আগুন, ৩০ অক্টোবর লন্ডনঘাটে এমভি লোরাম (বর্তমানে এমভি আকরাম) ধ্বংস, ৯ নভেম্বর চাঁদপুর মৈশাদী রেললাইনের ব্রিজ লিমপেট মাইনের সাহায্যে ধ্বংস করার অপারেশনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখি।

মমিনউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি অপারেশন পরিচালনা করি। মুক্তিযুদ্ধে অপারেশন সফলভাবে পরিচালনা করায় সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে।

মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে প্রথম বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হয়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি কুষ্টিয়া, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় পুলিশ সুপার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ), ডিসি সদর দপ্তর, ডিসি রায়ট ও ডিসি গোয়েন্দা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি কয়েকমাস সারদা পুলিশ একাডেমির ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি ২০০৮ সালে সচিব হিসেবে অবসর নেন।

মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী অনেক সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করেন। তিনি রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ২০১৬ সালে মৈশাদী গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন বীরপ্রতীক মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী একাডেমি (৬ষ্ঠ-দ্বাদশ)।

(ঢাকাটাইমস/২২জানুয়ারি/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :