ঐতিহ্য খোয়াচ্ছে মাদারীপুরের মধুখণ্ড ‘পাটালী গুড়’

প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৩২

সাগর হোসেন তামিম, মাদারীপুর

এক একটি খণ্ড এক কেজি থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত। দেখতে মনে হবে একটি ‘মধুখণ্ড’। চিরচেনা সেই পাটালি গুড়ের ঐতিহ্য খোয়াতে বসেছে মাদারীপুরে। গেলো কয়েক দশক ধরে ব্যাপক সুখ্যাতি থাকলেও বর্তমানে ভেজারের কারণে সেই সুনাম নেই বললেই চলে। এতে কমেছে পাটালী গুড়ে কদর। ফলে কেনা-বেঁচাও এসেছে ভাটা। অনেক ব্যবসায়ী চলে যাচ্ছে ভিন্ন পেশায়। অন্যদিকে প্রশাসনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, জেলার ব্রান্ডিং পাটালী গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। তাই নিয়েছেন নানা উদ্যোগও।

মাদারীপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের পাঁচখোলা ইউনিয়নের জাফরাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খুব ভোরে আলোর ফোটার সাথে সাথে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত লোকমান শিকদার ও তার ছেলে আল-আমীন। এক একটি গাছ থেকে আধা হাড়ি রস পাচ্ছেন। সেই রস চুলায় ঢেলে রস থেকে গুড় তৈরিতে লেগে পড়ে তার স্ত্রী আমেনা খাতুন। এক থেকে দেড় ঘন্টা জ্বালানোর পরে রস লাল হয়ে গুড়ে তৈরি হয়। সেই গুড় আপন মনে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে তৈরি করে গুড়ের লালী। সেই লালী গুড় ছোট বড় মাটির মাত্র ঢেলে তৈরি করে এক থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত গুড়ের খন্ড। এসময় কথা হয় লোকমান শিকদারের সাথে।

লোকমান শিকদার বলেন, ‘প্রতি বছর কার্তিকের শেষ থেকে ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খেজুর গুড়ের মৌসুম। এ মৌসুমে খেজুর গুড়ের মৌ-মৌ গন্ধে পাওয়া যেতো আবহমান বাংলার প্রকৃত রূপে। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে গরম গুড়ের পাটালী ও লালী গুড়ের লোভনীয় স্বাদ ভোলার নয়। কিন্তু পারিপার্শি¦ক নানা কারণ ও যান্ত্রিক সভ্যতার যাতাকলে পড়ে একশ্রেণীর মানুষের ভেজালের কারণে ধ্বংস হতে শুরু করেছে সেই ঐতিহ্য। যে কারণে ভেজালমুক্ত গুড় এখন আর আশা করা যায় না।’

তার ছেলে আল-আমীন বাবার সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘ভেজালের কবলে পড়ে মাদারীপুর জেলার খেজুর গুড় তার নিজস্ব ঐতিহ্য খোয়াতে বসেছে। দিন দিন মুনাফাখোর ও অসাধু গুড় উৎপাদনকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠায় গুড়ের হারানো ঐতিহ্য আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা কয়েকটি পরিবার কোন রকম টিকে আছি। আগামীতে হয়ত আমরাও টিকে থাকতে পারবো না। এতে সেই আগের রসনাবিলাস থেকে বঞ্চিত হবে শহুরী মানুষ।’
ভোজন রসিক এসএম আরাফাত শরীফ বলেন, ‘ভেজাল গুড়ে এখন হাট-বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। গুড়ের ওজন বৃদ্ধি করতে চিনি আর রং ফর্সা করতে মিশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। যে কারণে সুস্বাদু খেজুর গুড় এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে। গত ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও নেওয়া হয়নি আইনি ব্যবস্থা। তাই গুড় বিক্রের সাথে জড়িতদের আগের মতো ব্যবসা নেই। ফলে অনেকেই চলে গেছে অন্য পেশায়। আমরাও বঞ্চিত হচ্ছি মধুখন্ড পাটালী গুড় থেকে।’

আর মাদারীপুর জেলার ব্রান্ডিং পাটালী গুড়ের ঐতিহ্য ফিরাতে কৃষি অফিস থেকেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। সেই সাথে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা, এমনটারই আশ্বাস জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক দিগ্বিজয় হাজরার। তিনি বলেন, ‘যারা ভেজাল গুড় তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সহযোগিতায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা কৃষি অফিস থেকেও কৃষকদের ভেজাল গুড় উৎপাদন করতে নিরুসাহিত করা হচ্ছে। যদি কেউ অপরাধের সাথে জড়িত হয়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আবহমান বাংলার পৌষ-পার্বণের উৎসব আর শীতের পিঠা-পায়েস ও লোকখাদ্যের কথা যেন ভুলতেই বসেছে বাঙালিরা। প্রতি বছর জেলায় অন্তত তিন থেকে চার কোটি কাটার গুড় বিক্রি হয় বলে দাবী, গুড় ব্যবসায়ীদের। তাই তো নির্ভেজাল গুড়ের স্বাদ ও গন্ধ আগের মতো পাইতে খেজুর গাছ ও গাছির সংখ্যা বাড়ানোর কথা জানালেন জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘মাদারীপুর জেলার ব্রান্ডিং হচ্ছে খেজুর গুড়। তাই ঐতিহ্য আর সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্যে নানা পদক্ষেন নেয়া হয়েছে। প্রতি উপজেলায় বিনামূল্যে খেজুর চারা বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া গাছিরা যাতে উৎসাহ পায়, সেজন্যে গাছিতের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। আগামীতে গাছিরা যেন নিচে বসেই রস সংগ্রহ করতে পারে, সে বিষয় উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।’
 

(ঢাকাটাইমস/২৩জানুয়ারি/এআর)