ডলার সংকট: আমদানিকারকদের মাথায় হাত

প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:০৪ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০৬

নিজস্ব প্রতিবেদক. ঢাাকাটাইমস

গত ৯ দিন ধরে ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য ঘুরছেন একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে এই ঋণপত্র খোলা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানান কোম্পানিটির একজন পরিচালক। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ডলার সংকট খুব ভোগাচ্ছে।

এদিকে এই ডলার সংকট নিয়ে ব্যবসায়ীরা মুখোমুখি হন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের। তিনি জানান, দুই মাসের মধ্যে এলসি খোলা নিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

অন্যদিকে অপেক্ষা করা ছাড়া সমাধানের কোনো পথ দেখছেন না ব্যবসায়ীরা। এছাড়া সামাল দেওয়ার পথ নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেও। এ অবস্থায় ডলার সংকটের অস্বস্তি নিয়ে দুই মাসের অপেক্ষায় ব্যবসায়ীরা। গতকাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের ওই দুই মাস অপেক্ষার প্রতিশ্রুতির মাত্র একদিন পার হয়েছে।   
এদিকে ডলার সংকটের কথা বললে এলসি নিয়ে আরও জটিলতা হতে পারে- এমন শঙ্কায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুর্ভোগে পড়া ভুক্তভোগী ওষুধ কোম্পানিটির একজন পরিচালক গত মঙ্গলবার ঢাকা টাইমসকে বলেন, কাঁচামাল দ্রুত না আনতে পারলে কয়েক ধরনের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ থাকবে। এলসি জটিলতায় এর আগেই কয়েকটি ওষুধের আইটেম সাপ্লাই বন্ধ রাখতে হয়েছে। কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’

এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। বর্তমানে রিজার্ভ নেমেছে ৩২.৪৭ বিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আইএমএফের হিসাবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের চেয়ে ৮ বিলিয়ন ডলার কম। যা চলমান অর্থনীতির জন্য ঝুঁকির বার্তা হলেও বিপদ সীমার নিচে নামেনি বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রবাসী ও রপ্তানিসহ বৈদেশিক আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ এলেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে।

শুধু ওই ওষুধ ব্যবসায়ীই নন, ডলার সংকটে রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপণ্য ও খাদ্যদ্রব্য আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে। ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় ইতোমধ্যেই বিদেশ থেকে চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসা জাহাজ থেকে তিন মাসেও পণ্য খালাস করতে না পারার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব কোম্পানি এবং ঋণপত্র খুলতে গিয়ে দফায় দফায় দিন পার করা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ‘টাকা’য় আমদানি করতে চাওয়া পণ্যের মূল্য এলসি খোলা ব্যাংককে পরিশোধ করলেও ওইসব ব্যাংক ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না বিদেশি কোম্পানিগুলোকে। যেসব বিদেশি কোম্পানি দেশের কোম্পানির কাছে সংশ্লিষ্ট পণ্য রপ্তানি করছে, তারা ডলারে মূল্য না পেয়ে মাল বা চাহিদা দেওয়া পণ্য, খাদ্যসহ জিনিসপত্র পাঠাচ্ছে না দেশীয় কোম্পানির কাছে। আবার পাঠালেও জাহাজেই আটকে থাকছে, ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে না পারলে নিয়মানুযায়ী খালাস করতে দিচ্ছে না।

এদিকে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে বেগ পাওয়ার পেছনে ডলার সংকট। এ কারণ এখন দৃশ্যমান এবং সম্মিলিত সংকটে রূপ নিয়েছে। কিন্তু চাহিদা অনেক থাকলেও তা সামাল দেওয়ার মতো ডলার নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। আমদানিতে এর প্রভাব দৃশ্যমান হলেও রিজার্ভ ঠিক রাখতে ডলার দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

এ ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যদ্রব্যসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানিতেও ব্যবসায়ীদের কাছে ডলার সংকটই প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থপাচার রোধ করে, হুন্ডিচক্রকে নিয়ন্ত্রণ, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ও রপ্তানি আয়ই প্রধান ভরসা ডলার তহবিল বা রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে। ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক করা ও ঋণপত্র (এলসি) খোলার সবিধা স্বাভাবিক করতে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রয়োগ করেও সংকট সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

প্রতিনিয়তই রিজার্ভ বৃদ্ধি ও ঋণপত্রের অনুকূলে ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নানামুখী কৌশল-উদ্যোগ প্রয়োগ করে যাচ্ছেন বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

এদিকে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানিতে এলসি মার্জিন ন্যূনতম করাসহ বেশ কিছু নীতিগত পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এলসি খোলা নিয়ে বিরাজমান পরিস্থিতি দুই-এক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

জানা গেছে, ভবিষ্যতে যাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে না যায়, সে জন্য পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিও এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে আসন্ন রমজানে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ চেয়ে একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এদিকে ব্যবসায়ীরাও রোজার মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি নিষ্পত্তিতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন। কারণ, আসন্ন রমজানে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলসি খুলতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও ডলার সংকটে তা পারছে না বেশিরভাগ ব্যাংক। আর ডলার জোগাড়ে দিশেহারা হয়ে আমদানিকারকরা ভোগ্যপণ্যের এলসির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিচ্ছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে ডলার সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে আমদানিকারকরা বারবার সরকারি দপ্তরে ধরনা দিচ্ছেন।

তবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় না নামে, সে জন্য চাইলেই ডলার দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু সার, জ্বালানি ও সরকারি খাদ্য আমদানিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

অবশ্য গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ভোগ্যপণ্যের এলসি খুলতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ঋণপত্রসহ নানা চাপে রিজার্ভ

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৫ কোটি ডলার বিক্রির পর বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন (রিজার্ভ) এখন ৩২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। কিন্তু এরপর থেকে আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ডলার। অন্যদিকে রিজার্ভের নিয়ামক প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান একই হারে বাড়েনি। এতে টান পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২ সাল থেকে রিজার্ভ কমতে কমতে এ পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে। সেখান থেকে আরও বেড়ে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে তা বেড়ে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। রিজার্ভের এ অঙ্ক ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এরপর আর রিজার্ভের সেই ধারা ধরে রাখা যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতির কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৭৯ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতিও ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি। ঘাটতি মেটাতে ডলার বিক্রি করায় টান পড়তে থাকে রিজার্ভে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৫০ কোটি ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত সরকারের আমদানির দায় মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে এ রিজার্ভ বিক্রি করা হয়। আর গত সোমবারই বিক্রি করে ৫ কোটি ডলার। ফলে রিজার্ভের পরিমাণ নামে ৩২ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে। অবশ্য ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ আরও ৮ বিলিয়ন ডলার কম। এই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন রকম তহবিল গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, সর্বোচ্চ তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেই তা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়। বর্তমান রিজার্ভ কিছুটা ঝুঁকির বার্তা দিলেও এখনো বিপদসীমার নিচে নামেনি। আগামীতে রেমিট্যান্স, প্রবাসী আয় বা বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে আসা ডলার যোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে রিজার্ভ কমলেও বিপদসীমা অতিক্রম হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

(ঢাকাটাইমস/২৬জানুয়ারি/আরআর)