রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে সরকার

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:১৬ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:১৯

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস

আগামী মার্চ মাসে শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। ওই সময় বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। এ বিষয় মাথায় রেখে রমজান কেন্দ্র করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অসাধু সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যাতে বাজার অস্থির করে তুলতে না পারে, সে জন্য গোয়েন্দাদের নজর রাখতে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিন্ডিকেট দমিয়ে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করাসহ বেশকিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।

আগামী রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবার তিন মাস আগেই ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ওই সময় বাজারে স্বস্তি ফেরাতে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে সরকার। গম (আটা), ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুর ও ছোলার মতো ৭টি ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আমদানিকৃত এসব ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে চাহিদা মতো ডলারের জোগান পাবেন ব্যবসায়ীরা। আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পঁচিশ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার সরবরাহ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি বাড়াতে সরব হয়েছেন উদ্যোক্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।  
রোজার চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে চিনি আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর সুপারিশ করা হয়। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তাদের স্বার্থে এ বছর গরু ও খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হতে পারে।
এবার চিনি, আটা এবং ভোজ্যতেলের ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা করে দ্রুত এসব পণ্যের আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। এছাড়া চাল আমদানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে সংস্থাটি। পেঁয়াজের ঘাটতি থাকলেও মার্চ মাসের আগেই দেশে নতুন পেঁয়াজ ওঠা শুরু হবে। এ কারণে এখন চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের কিছু ঘাটতি থাকলেও রমজানের সময় বাজার তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। রোজায় দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখতে ১৫ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোগে একটি ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এই কমিটি আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেবে।

বিশেষ করে রমজানের সময় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারসাজি বন্ধে কাজ করবে সমন্বয় কমিটি। শুধু তাই নয়, রমজানের সময় সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ওই সময় ফ্যামিলি কার্ডের বাইরে ট্রাক সেলে চিনি এবং ছোলার মতো পণ্য বিক্রি করা হতে পারে। এ ছাড়া সারাদেশের এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীরা টিসিবি থেকে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল এবং পেঁয়াজের মতো পণ্য কিনতে পারবেন। এ কারণে টিসিবির অধীনে খাদ্যপণ্য কিনতে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। অর্থাৎ রমজানের সময় বাজারে স্বস্তি ফেরাতে সব ধরনের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের।
এছাড়া রমজান মাসজুড়ে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তৎপর থাকবে ভোক্তা অধিদপ্তরও। আর সিন্ডিকেট ঠেকাতে রমজানের আগেই মাঠে নামছে গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যেই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট শনাক্তে গোয়েন্দা নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানান, আগামী রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের দর বৃদ্ধির এই সময়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এরপরও রোজায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এমন সব খাদ্যপণ্য আমদানিতে ডলারের জোগান দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের ইতোমধ্যে আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলো যাতে দ্রুত এলসি খোলে সেজন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চিনি এবং ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের দাম কমাতে আরও শুল্ক ও ভ্যাট কমাানোর জন্য এনবিআরকে অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়। তিনি আরও বলেন, রমজানে গ্রাহকরা যাতে ভোগান্তির শিকার না হন, সেজন্য খাদ্যপণ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আশা করছি, রমজানের সময় দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক থাকবে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালো।
জানা গেছে, রমজান ঘিরে খাদ্যপণ্য আমদানিতে আড়াই বিলিয়ন ডলারের জোগান দেওয়া হবে। পেঁয়াজ, মসুর ডাল ও গম আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ভোগ্যপণ্য আমদানি সহজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। 
এছাড়া রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করবে সরকার। কোটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ ফ্যামিলি কার্ডের বাইরেও এবার ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ট্রাকসেলে চিনি ও ছোলা বিক্রি করা হতে পারে। এ লক্ষ্যে টিসিবি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এ ছাড়া দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চাল শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির জন্য আরও তিন মাস সময় বাড়িয়েছে এনবিআর। 
এসব উদ্যোগের ফলে বাজারে ওই সময় জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। আগামী রমজানের আগে গরু ও খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। 
এর আগে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও গত কয়েক বছর ধরে সংস্থাটি আর দাম নির্ধারণ না করে বরং বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে চাপিয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এবার মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপ বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বিলাস দ্রব্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৩৩০টি পণ্যের উচ্চহারে শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনি আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার পরিবর্তন করে স্পেসিফিক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত সমজাতীয় অন্যান্য ভোজ্যতেল যথা- সানফ্লাওয়ার ও ক্যানোলা তেল আমদানিতে উচ্চহারে শুল্কারোপিত আছে যা সয়াবিন ও পামের ন্যায় আরোপ করা হলে সরকারের রাজস্ব কমবে না, অন্যদিকে আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য আসবে বলে মনে করে। এছাড়া রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখতে ১৫ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর এবং বেসরকারি খাত একযোগে কাজ করবে। এ লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, ধর্ম, রেলপথ, নৌ-পরিবহন, বিমান পরিবহন ও পর্যটন, কৃষি, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে একটি সমন্বিত কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি মনিটরিং করা হবে। আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ থাকবে।

(ঢাকাটাইমস/২৮জানুয়ারি/আরআর)