ম্যালোরী এবং আরভিনের অসমাপ্ত অভিযান

প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩:০৫

আবু দারদা মাহফুজ

‘আপনি কেন এভারেস্টে উঠতে চান?’ সাংবাদিক সাত-পাঁচ না ভেবেই প্রশ্নটা করলেন। প্রশ্নটি শুনে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া গড়নের লোকটি উত্তর দিলেন—‘...কারণ, ওটা সেখানেই!’

রাতারাতি শেষের এই উক্তিটুকু জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। উক্তিটুকুর চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে গেলেন ছয় ফুট দীর্ঘ শরীরের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক একজন লেফটেন্যান্ট। নাম জর্জ হারবার্ট লেহ ম্যালোরি। যিনি জর্জ ম্যালোরী নামেই সমধিক পরিচিত, জনপ্রিয়।

পাহাড়ে চড়া যাঁর নেশা, তাঁকে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলে বাঁধা জীবন কখনোই দমিয়ে রাখতে পারে না। সেই নেশাতেই নিজেকে ঢেলে দিতে হয়ত, সেনাবাহিনীর চাকরিটা ছেড়েই ১৯২১ সালে ম্যালোরী যোগ দিলেন ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের একটি দলে, যে দলটি এভারেস্টে আরোহণ করার উপযুক্ত পথটি আবিষ্কার করেছিলো।

এভাবে, ১৯২১ সালের পর ১৯২২ সালেও দ্বিতীয়বার অভিযানে নামেন ম্যালোরী এবং তাঁর অভিযাত্রী দলটি। এভাবে একটি উপযুক্ত আরোহণ পথ আবিষ্কার শেষে তাঁরা লন্ডনে ফিরে আসেন। ঠিক দুই বছর বিরতি দিয়ে ম্যালোরী আবারও এভারেস্ট অভিযানে নামেন। ম্যালোরীর এবারের লক্ষ্য- যে করেই হোক পৌছুতে হবে চূড়ায়, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে যেতে হবে।

ম্যালোরী তাঁর এই অভিযানের জন্যে বেছে নিলেন আরেক দুঃসাহসী অভিযাত্রী অ্যান্ড্রু কমিন স্যান্ডি আরভিনকে। আরভিনকে সঙ্গে নিয়ে ১৯২৪ সালের ৪ঠা জুন চীনের তিব্বতে হিমালয়ের এভারেস্টের অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্প বা এবিসি থেকে যাত্রা শুরু করেন ম্যালোরী। উত্তর দিকের পথ দিয়েই ম্যালোরী আর আরভিন আরোহন শুরু করেন।

দুই দিন বাদে, ৬ জুন সকালে তাঁরা এভারেস্টের পাঁচ নম্বর ক্যাম্পে পৌছান। এবং, পরের দিন ছয় নম্বর ক্যাম্পে উঠে পড়েন। প্রতি ঘণ্টায় ৮৫৬ ফুট গতিবেগে ম্যালোরী এবং আরভিন আরোহন করতে থাকেন, ৮ জুন তারিখের যেকোনো একসময় তাঁরা পৌছে যান এভারেস্টের চূড়ায়! পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয় করেন এই দুই ব্রিটিশ অভিযাত্রী।

আরোহনের সময় তাঁদেরকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন দলের পর্যবেক্ষক সদস্য নোয়েল ওডেল। আরভিনের কাছে নিজের একটি ক্যামেরা ছিলো। পুরো অভিযানের সময় ক্যামেরায় তিনি দৃশ্য ধারণ করছিলেন।

এভারেস্ট জয়ের পর, ৯ই জুন, ১৯২৪ তাতিখে ম্যালোরী আর আরভিন উত্তর দিকের পথ ধরেই অবরোহণ করা শুরু করেন। স্বাভাবিক গতিতেই নামতে থাকেন তাঁরা। কিন্তু, কয়েকশ মিটার নেমে আসার পরই দুজনের মধ্যে কেউ একজন পিছলে যান। ম্যালোরী এবং আরভিন- দুজনই যেহেতু একই রশির দুই প্রান্তে নিজেদের বেঁধে রেখেছিলেন, একজন পিছলে যেতেই স্বাভাবিকভাবে অপরজনও পড়ে যান। চেষ্টা করেও কেউই আর নিজেদেরকে থামাতে পারেননি, দুজনেই নিহত হন।

ম্যালোরী আর আরভিনের এই অভিযানের দিকে চোখ রাখছিলো ব্রিটিশ গণমাধ্যম। দুই অভিযাত্রী এভারেস্টে হারিয়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে প্রথম জানা যায়, যে এভারেস্ট জয়ের শেষে এই দুই অভিযাত্রী নিখোঁজ হয়েছেন। নিখোঁজ অভিযাত্রীদের দেহগুলো পাওয়া যায় নি তখনও।

সে বছরই অক্টোবর মাসে, লন্ডনে ম্যালোরী আর আরভিনের দেহহীন শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকার ম্যালোরীকে 'জাতীয় বীর' হিসেবে সম্মাননা দেয়।

হিমালয়ে হারিয়ে যাওয়া এই দুই অভিযাত্রীকে খুঁজে পেতে আরও কয়েকটি দল পরে অভিযান চালায়। ১৯৩৩ সালে একটি দল আরভিনের ব্যাবহার করা কুঠারটি উদ্ধার করে। কিন্তু তখনও সন্ধান পাওয়া যায়নি ম্যালোরী এবং আরভিনের দেহাবশেষের।

১৯৯৯ সালে আবারও একটি অনুসন্ধানী দল এভারেস্টে অভিযান চালায়। অবশেষে, সেই দলটি ১লা মে, ১৯৯৯ তারিখে এভারেস্টের উত্তর দিকের পথে, চুড়া থেকে কয়েকশ মিটার নীচে জর্জ ম্যালোরীর চিরতরুণ দেহটি আবিষ্কার করে।

মৃত্যুর ৭৫ বছরেও সামান্য ক্ষতি হয়নি ম্যালোরীর প্রানহীন দেহটির। ম্যালোরীকে যখন পাওয়া যায় নিথর প্রাণহীন অবস্থায়, ম্যালোরীর কোমরে সেই রশিটি জড়ানো ছিলো, পায়ে মোজা এবং জুতাও ছিলো। শরীরের জ্যাকেটটিও অক্ষত ছিলো। শুধু ম্যালোরী উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছিলেন।

আবিষ্কৃত দেহটি ম্যালোরী নাকি আরভিনের, তা নিয়ে সন্দেহে ছিলো। অবশেষে, পরণের জ্যাকেটটির গলার অংশের পিছনের দিকের কাপড়ে সেলাই করে লেখা নাম দেখেই দেহটি যে ম্যালোরীর- তা নিশ্চিত হওয়া যায়। ম্যালোরীর জ্যাকেটের পকেটে একটি চিঠিও পাওয়া যায়। পাহাড়ে আরোহনের জন্যে কেনা সরঞ্জামের দোকান থেকে খরচা বাবদ নেওয়া মেমোটিও ছিলো ম্যালোরীর জ্যাকেটের পকেটে।

ঘুমন্ত ম্যালোরীকে হিমালয়ের সাদা চাদরে অক্ষত পাওয়া গেলেও, আজও পাওয়া যায়নি ম্যালোরীর আরেক দুঃসাহসী সঙ্গী আরভিনকে। আরভিনের সঙ্গে থাকা ক্যামেরাটিও আর পাওয়া যায়নি।

জর্জ ম্যালোরী আর অ্যান্ড্রু আরভিন যে ১৯২৪ সালেই প্রথমবার এভারেস্ট জয় করেন তা নিয়ে তর্ক হয়েছে, তর্ক মিটেছে, পরে আবারও তর্ক হয়েছে। তবে, স্বীকৃতভাবে এডমন্ড হিলারী এবং তেনজিন নোরগে ১৯৫৩ সালে এভারেস্ট জয় করেন। হিলারি নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে ম্যালোরী এবং আরভিনই প্রথম এভারেস্ট জয় করেন। তবে, একটি প্রশ্নও হিলারী সেই সাথে যোগ করেন, ‘...তবে, চূড়া জয় করে সমতলে নিরাপদে ফিরে না আসার ঘটনাকে কি আদৌ এভারেস্ট জয়ের স্বীকৃতি দেয়া যায়?’।

ম্যালোরী কিংবা আরভিন—কেউই আর ফিরে আসবেন না কোনোদিন। তাঁরা কোনওদিন জানতেও পারবেন না, মৃত্যুর পরে তাঁদের জন্যে কেঁদেছিলো পুরো বিশ্ব। তাঁরা কখনোই জানবেন না, তাঁদের দেখানো পথে হেঁটেই একদিন হিলারী আর নোরগে এভারেস্ট জয় করেছিলেন। ম্যালোরী কখনোই জানতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পর প্রিয়তমা স্ত্রী রুথ কীভাবে নিদারুন কষ্টে দিনানিপাত করেছেন। রুথও মারা গেছেন পরে, ম্যালোরীকে শেষবার ছুয়ে দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে।

বিশাল এভারেস্ট ম্যালোরী আর আরভিনকে নিজের বুকে আশ্রয় দিয়েছিলো। বরফের চাদরে জমে থাকুক কিংবা অক্ষত থাকুক ম্যালোরী আর আরভিনের বুক ভরা সাহস আর সাহসী গল্পগুলো, যে সাহসে ভর করে পরে এভারেস্ট জয় করেছে হাজারও অভিযাত্রী।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী