রিজার্ভ চুরি: সাক্ষ্য দিতে ফিলিপাইনে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা

প্রকাশ | ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২৬ | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:০৫

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে ফিলিপাইন গেছেন পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এছাড়া এ রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিরে পেতে সেখানে কয়েকটি বৈঠকেও অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে তাদের। গত শনিবার ফিলিপাইনে যাওয়া প্রতিনিধি দল আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করবে বলে জানা গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ওই প্রতিনিধি দল ফিলিপাইনের আদালতে চলমান একটি মামলার সাক্ষ্য দেবেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে চলমান এ সংক্রান্ত মামলার বিষয়েও বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করবেন।
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সেখানে অবস্থানকালে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ছাড়াও ফিলিপাইনের মুদ্রা বিনিময় প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের সম্পত্তি ক্রোকের এক মামলায় সাক্ষ্য দেবেন। মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবেদনের বিষয়ে এ শুনানি হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জানা গেছে, সম্প্রতি এ রিজার্ভ চুরির মামলার বিষয়ে ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি) ও অন্যদের সমঝোতারভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট কোর্ট। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত আগামী ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই সমঝোতা করতে বলেছেন।
 
সূত্র বলছে, গত শনিবার বাংলাদেশ থেকে ফিলিপাইন পৌঁছা ওই প্রতিনিধি দলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি রয়েছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দুজন করে মোট চারজন কর্মকর্তা রয়েছেন ওই প্রতিনিধি দলে। এছাড়া ওই দলে যুক্ত হবেন ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। 
এ বিষয়ে বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা বলেন, ফিলিপাইনের আদালতে রিজার্ভ চুরির মামলা চলমান রয়েছে। ফিলিপাইনের সরকার ও আদালত বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা করেন। সেই বিষয়ে ফলোআপ মিটিং করতে একটি প্রতিনিধি দল সেই দেশে গেছেন। তাদের মধ্যে বিএফআইইউ ও সিআইডির কয়েকজন গেছেন ওই দেশের আদালতে সাক্ষ্য দিতে। 

বিএফআইইউ জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত হয়েছে বিবেচনায় ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দি সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্কে (ফেডারেল কোর্ট) আরসিবিসিসহ ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। পরে আরসিবিসিসহ ৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মামলা বাতিল করার (মোশান চু ডিসমিস) আবেদন করে। বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার পর ২০২০ সালের ২০ মার্চ ফেডারেল আদালত ফিলিপাইনের বিভিন্ন বিবাদী কর্তৃক দায়ের করা আবেদন খারিজ করে দিয়ে মামলাটি ফেডারেল কোর্টের পরিবর্তে স্টেট কোর্টে পরিচালনার নির্দেশ দেয়।

ওই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৭ মে বাংলাদেশ ব্যাংক আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টে (স্টেট কোর্ট) আরসিবিসিসহ ফিলিপাইনের ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মামলা দায়েরের পর ৬ বিবাদী ফেডারেল কোর্টের মতো এই কোর্টেও মামলা বাতিলের আবেদন করে। বিবাদী পক্ষের আবেদনের বিষয়ে ২০২১ সালের ১৪ জুলাই ও ১৪ অক্টোবর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
নিউইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল মামলার আংশিক রায়ে দুই প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক আপিল আবেদন করে, যা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

আদালত তার রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ক্ষেত্রে আরসিবিসির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জোগসাজশ ছিল। আদালতের রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, আরসিবিসির নিউইয়র্কের হিসাব ব্যবহার না হলে এবং ফিলিপাইনে আরসিবিসি অভিযুক্তদের সহযোগিতা না করলে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ওই অর্থ অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না।
স্টেট কোর্ট আরসিবিসি ও অন্যান্য বিবাদীদের আগামী ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জবাব দেওয়ার আদেশ এবং মধ্যস্থতার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিউইয়র্কে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনি প্রতিষ্ঠান মধ্যস্থতার বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।

এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ জানায়, ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) সহযোগিতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে। তাই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আরসিবিসিসহ অভিযুক্ত ছয়জনের দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট (স্টেট কোর্ট)। ফলে রিজার্ভের অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশের করা মামলা পরিচালনায় আর কোনো বাধা রইল না। তবে আরসিবিসিসহ অন্যান্য ১৮ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ইতিহাসে রিজার্ভ চুরির সবচেয়ে বড় এই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। সেই রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া এই অর্থ প্রথমে গিয়েছিল ফিলিপাইনের মাকাতি শহরের রিজাল ব্যাংকের ৪টি ভুয়া অ্যাকাউন্টে। তারপর সেখান থেকে দ্রুত এই অর্থ উত্তোলন করেন হ্যাকাররা। শেষ পর্যন্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের সহযোগিতায় মাত্র দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করতে পেরেছে বাংলাদেশ। চুরি যাওয়া বাকি অর্থের ফেরতের প্রক্রিয়া ঝুলে আছে। এ বিষয়ক চলমান মামলাগুলোর রায় হলে এই প্রতিবন্ধকতা কেটে গিয়ে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

(ঢাকাটাইমস/৩০জানুয়ারি/আরআর/আরকেএইচ)