অতিরিক্ত চিনি খাওয়া কোলোন ক্যানসারের ঝুঁকি

প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:১৮ | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৫২

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

চিনি বিষ জেনেও কিছুতেই লোভ সামলানো যায় না। চোখের সামনে চকলেট, মিষ্টি দেখলেই টপাটপ মুখে চালান অনেকেই! অনেকের কাছে চিনি খাওয়া বন্ধ করা বেশ কঠিন কাজ। আবার সরাসরি চিনি খাচ্ছেন না মানেই যে সুরক্ষিত আছেন, এমন নয়। কোল্ড ড্রিংক, রঙিন পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবারেও কিন্তু চিনির পরিমাণ বেশি। ফলে অত্যধিক হারে এই ধরনের খাবার খাওয়ার ফলে অজান্তেই শরীরে প্রবেশ করছে চিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে চিনি খাওয়া কমাতে না পারলে মারাত্মক বিপদই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। চিনি ও চিনিযুক্ত পানীয় ক্যানসারের কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অত্যধিক চিনি স্থূলতা, ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং প্রদাহ হতে পারে, এগুলো সবই ক্যানসারের ঝুঁকির কারণ। চিনি রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র মতে, পুরুষদের দিনে ৯ চামচ এবং মহিলাদের ৬ চামচের বেশি চিনি খাওয়া ঠিক নয়। দিনে যত ক্যালোরি শরীরে যায়, তার থেকে ১০-১৫ শতাংশের কম আসা উচিত চিনি থেকে।

চিনি আখ বা মিষ্টি বিট থেকে তৈরি হয়। শিল্পকারখানায় রিফাইনিং পদ্ধতিতে আখের রস থেকে চিনি তৈরি করার সময় ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, এনজাইম এবং অন্যান্য উপকারী পুষ্টি উপাদান দূর করে অপ্রাকৃতিক উপাদানে পরিণত করে। ফলে অতিরিক্ত চিনি খেলে চিনির বিষক্রিয়ায় শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

আমাদের খাদ্য তালিকায় এমন কিছু খাবার আছে যার মধ্যে উচ্চ মাত্রার চিনি লুকিয়ে আছে। যা আমাদের অজান্তেই খেয়ে থাকি। ফলে মুটিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এমনকি বিসন্নতার মত রোগ শরীরে বাসা বাধে। রেস্টুরেন্ট ও বেকারি আইটেমে চিনি থাকেই। চিনি শুধু স্বাদের জন্য না বরং প্রিজার্ভেটিভ, টেকচার হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। তরল ক্যালরি মানে কোলা, জুস খাওয়া বন্ধ করতে হবে। জুস না খেয়ে ফল খান। সকালের ব্রেকফাস্টে এক সার্ভিং এ দশ গ্রামের বেশি সুগার আছে এমন সিরিয়াল খাওয়া যাবে না।  ফ্রোজেন সুইটনার তথা আইস্ক্রিম, মিল্ক সেক, কোল্ড কফি খাওয়া বন্ধ করেন।

মিষ্টি, চকলেট, মিষ্টি দই, মিষ্টি বিস্কুট, কেক, পাই, ডোনাটস, কর্ন ফ্লেক্স, পিৎজা এবং পাস্তার সস, কেচাপ ইত্যাদি খাওয়া বন্ধ করুন বা কমান।

প্রক্রিয়াজাত খাবার, কর্নফ্লেক্স, পাউরুটি, পিৎজা, কেচাপ, বিস্কুট, মেয়োনিজের মতো খাবারেও প্রচুর চিনি থাকে। খাবারকে প্রসেস করে অতিরিক্ত ফ্যাট বের করে নিলে, স্বাদ-গন্ধ চলে যায় তলানিতে। সে সব ফিরিয়ে আনতে খাবারে মেশানো হয় সাদা চিনি, ব্রাউন সুগার, কর্ন সিরাপের মতো উপকরণ। ফলে ফ্যাট কমে গেলেও, ক্যালোরি কমে না। বরং পুষ্টি কমে যায়।

সারা বিশ্বে প্রতিদিন চিনি খাওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। গড় হিসেবে প্রায় সিংহভাগ বিশ্ববাসী প্রতিদিন কম-বেশি প্রায় ২২ চামচ চিনি খেয়ে থাকেন, যা বিপদ সীমার থেকে অনেক ওপরে। এত মাত্রায় চিনি খাওয়ার কারণে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। আসুন কী সেই ক্ষতিগুলো তা জেনে নেওয়া যাক...

 

ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত চিনি খেলে প্যাংক্রিয়েটিক ক্যানসার, প্রস্টেট ক্যানসার, ক্ষুদ্রান্তের ক্যানসার, গলা, ফুসফুস, রেকটাম ও স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চিনি খাওয়া কোলোন ক্যানসারের জন্য দায়ী। এর কারণ হলো, যখন আমরা হোল গ্রেইন বা ফলের মাধ্যমে কার্বোহাইড্রেট নেই তখন গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজের সাথে সাথে আমরা প্রচুর ফাইবারও গ্রহণ করি। ফাইবার আমাদের হজমে দারুণ সহায়ক ভূমীকা পালন করে। রিফাইন সুগারে ফাইবার থাকে না অথচ আমাদের ক্যালরির চাহিদা ঠিকই পূরণ হয়ে যায়।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়

চিনি খাওয়ার মাত্রা যত বাড়তে থাকে, তত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে। কারণ চিনি শরীরে প্রবেশ করার পর নিমেষে সুগার লেভেলকে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। আর এমমনটা চলতে থাকলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা যে মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর একবার যদি ডায়াবেটিস শরীরে এসে বাসা বাঁধে তাহলে একে একে প্রায় প্রতিটি ভাইটাল অর্গানই অকেজো হতে শুরু করে।

 

মস্তিষ্কে জটিল রোগের সৃষ্টি হয়

অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস থাকলে অন্ত্রে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অনেক সময় মস্তিষ্কের প্রদাহ বা রোগের কারণ হয়। বিশেষ করে অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলে প্যারাব্যাকটেরয়েডের জন্ম হয়। এরা ধীরে ধীরে সংখ্যায় বাড়তে থাকে। আর যেগুলো আগে থেকে অন্ত্রে অবস্থান করে সেগুলো চরিত্রে পরিবর্তন আনে। ফলে জটিল রোগের সৃষ্টি হয়।

 

শরীরের প্রতিটি অঙ্গের কর্মক্ষমতা কমে যায়

গবেষণায় দেখা গেছে চিনি শরীরে প্রবেশ করে ফ্রুকটোজে রূপান্তরিত হয়ে যায়, যা লিভারে মেদ জমাতে শুরু করে। সেই সঙ্গে রক্তেও ফ্যাটের পরিমাণ বাড়ে। ফলে একটা সময়ে গিয়ে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে লিভারের কর্মক্ষমতাও কমতে শুরু করে।

 

হার্টের মারাত্মক ক্ষতি হয়

চিনি শরীরে প্রবেশ করার পর হার্টের ক্ষতি করে থাকে। রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে গেলে হৃদপিন্ডের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। যে কারণে বাড়ে নানাবিধ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। মাত্রাতিরিক্তি চিনি খাওয়ার কারণে কেউ যদি একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তাহলেও হার্টের কর্মক্ষমতা তো কমেই, সেই সঙ্গে স্ট্রোক এবং হার্ট ফেইলিওরের সম্ভাবনাও প্রায় ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তাই ভুলেও দিনে ৬ চামচের বেশি চিনি খাবেন না যেন!

 

ব্লাড প্রেসার বাড়তে থাকে

বেশি মাত্রায় চিনি খেলে বাস্তবিকই রক্তচাপ বাড়তে শুরু করে। আসলে দেহের অন্দরে চিনির মাত্রা বাড়তে থাকলে ইনসুলিনের উৎপাদনও বেড়ে যায়, যে কারণে ধমনিতে এক ধরনের দেওয়াল তৈরি হতে শুরু করে। এই কারণেই রক্তচাপ বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে স্ট্রোকের মতো ভয়ঙ্কর রোগ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।

 

রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়

চিনি খাওয়ার মাত্রা বাড়তে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই দেহের ওজন বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাও বিপদ সীমা ছাড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, উপকারি কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমতে শুরু করে। ফলে হার্টের উপর মারাত্মক চাপ পড়ে। এবার বুঝেছেন তো চিনি আমাদের শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকারক!

 

এনার্জি কমতে শুরু করে

চিনি বা ওই জাতীয় কোনও খাবার খেলে বেশি মাত্রায় এনার্জির ঘাটতি দেখা দেয় যে শরীর একেবারেই চলতে চায় না। শুধু তাই নয়, চিনি খাওয়ার মাত্রা বাড়ালে মস্তিষ্কের অন্দরে সেরাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়, যে কারণে ঘুম আসতে থাকে। ফলে কাজ করার ইচ্ছা একেবারে চলে যায়।

 

পুরুষের বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে

পুরুষদের খাদ্যাভাসে চিনির পরিমাণ বেশি হলে কমতে পারে শুক্রাণুর মান। তাই অতিরিক্ত চিনি খেলে ধীরে ধীরে পুরুষের বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে। গবেষণা থেকে জানা যায়, খাদ্যাভাসে চিনির পরিমাণ অতিরিক্ত হলে পুরুষের শুক্রাণুর মান কমতে থাকে।

 

মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে

অতিরিক্ত মাত্রায় চিনি খাওয়া শুরু করলে একটা সময়ের পর ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু চিনি খাওয়ার সঙ্গে মানসিক অবসাদের সম্পর্কটা ঠিক কোথায়? একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে রক্তে চিনির পরিমাণ বাড়তে থাকলে মস্তিষ্কের অন্দরে ডোপামাইন নামক ফিল গুড হরমোনের ক্ষরণ কমে যেতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ ঘিরে ধরে।

চিনির প্রতি তীব্র মোহ কমাতে চিনির বিকল্প বেছে নিতে হবে। সাদা চিনি খাওয়া একেবারেই বাদ দিন। লাল চিনি সাদা চিনির থেকে কম ক্ষতিকর। এ ছাড়া মিষ্টি ফল, ফলের সালাদ বা কাস্টার্ড ভালো সমাধান। খেজুর, মধু, গুড়, কিশমিশ খেয়েও কিন্তু মিষ্টির মোহ কমাতে পারেন, যা ততটা ক্ষতিকরও নয়। তবে কৃত্রিম চিনি কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চিনি, যেমন স্টিভা নামের একধরনের পাতা খেতে পারেন, যা চিনির স্বাদ দেবে কিন্তু চিনির মতো ক্ষতিকর নয়। সুস্থ থাকতে হলে ধীরে ধীরে খাবার তালিকা চিনিজাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।

ঢাকাটাইমস/০৪ ফেব্রুয়ারি/আরজেড)