ভেষজ গুণসমৃদ্ধ খেজুর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:২৬

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ফল খেজুর। সংস্কৃত খর্জুর থেকে বাংলা খেজুর। যার বৈজ্ঞানিক নাম ফিনিক্স ড্যাকটিলিফেরা। তালজাতীয় শাখাবিহীন খেজুর গাছ প্রধানতঃ মরু এলাকায় ভাল জন্মে। পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোতে খেজুরের চাষ প্রচলন বেশি। অনেকের মতে ইরাক অথবা মিসর খেজুর ফলের আদি স্থান। প্রাচীনকাল থেকে খেজুর ফলের বাগান সৃষ্টি করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত খাদ্য ও ফলের উৎস হিসেবে খেজুর মানুষের জীবন ধারণের অন্যতম অবলম্বন ছিল।

আরব দেশগুলোর মরুভূমি এলাকায় যেখানে অন্য কোনো গাছপালা জন্মানো সহজ হয় না সেখানে খেজুর বাগান সৃষ্টি করে মরুদ্যান সৃষ্টি করা হতো। খেজুর যেসব দেশে বেশি চাষ হয় তার মধ্যে মিসর, সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, ওমান, লিবিয়া ও তিউনেশিয়া অন্যতম। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও আমেরিকার কিছু অংশে সফলভাবে খেজুর চাষ করা হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে খেজুর গাছ “ট্রি অফ লাইফ" বা জীবন বৃক্ষ নামে পরিচিত। খেজুর উৎপাদনে বিশ্বে সৌদি আরবের অবস্থান তৃতীয়। সমগ্র সৌদি- আরবে ৩৬০ প্রজাতির প্রায় আড়াই কোটি খেজুর গাছ আছে। আকারে ও স্বাদে খেজুর অনেক প্রকারের হয়। উল্লেখযোগ্য হলো—পাঠান-আল মদিনা, মাসকানি, বার্হী, শাহীবি, খালস, আজওয়া, আনবারা, সাগি, সাফাওয়ি, ওয়ান্নাহ, সেফরি, খুদরি বেরহি, সামরান, জাহেদি, মরিয়ম, আনবারাহ, আসমাউলহাসনা, ইয়াবনি ইত্যাদি।

চারটি পর্যায়ে খেজুর পাকানো বা সংরক্ষণ করা হয়। আরবিতে সেগুলো কিমরি (কাঁচা), খালাল (পূর্ণাঙ্গ), রুতাব (পাকা—নরম) এবং তুমুর (পাকা—রোদে শুকানো)। খেজুর সাফাওয়ি নরম হয়ে থাকে। রং গাঢ় বাদামি। আকারে লম্বাটে। খেতে মাঝারি মিষ্টি। মদিনার বিখ্যাত খেজুর আমবার। এটি কম মিষ্টি। আর মরিয়ম নামের খেজুর লালচে বাদামি রঙের হয়। আকারে হয় এক-দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেজুর হলো আজওয়া। এর মধ্যেও আবার অনেক পদ আছে। সৌদি আরব থেকে আসে এই আজওয়া খেজুর।

মদিনায় এ খেজুরের ফলন হয় বেশি। আজওয়া খেজুর কালো ও মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে। পুষ্টি ও মানের দিক দিয়ে সবচেয়ে ভালো খেজুরগুলোর মধ্যে আজওয়া রয়েছে প্রথম সারিতে।

আজওয়া খেজুর নরম ও অনেক সুস্বাদু হয়। এগুলো আকারে ছোট ও উপরে সাদা রেখা দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই আপনাকে সঠিক আজওয়া খেজুর বাছাই করতে সাহায্য করবে।

মেডজুল নামক খেজুর যা ‘খেজুরের রাজা’ হিসাবেও পরিচিত। এটি এখন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন।

পুষ্টিবিদদের মতে, খেজুরে থাকে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালোরি, সোডিয়াম, আয়রনসহ আরো অনেক খাদ্য উপাদান। এছাড়া খেজুরে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা।

রোজ খেজুর খেতে পারেন, খেজুরে একজন সুস্থ মানুষের শরীরে আয়রনের চাহিদার প্রায় ১১ ভাগই পূরণ করে।

খেজুরে রয়েছে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, আঁশ, পটাশিয়াম, জিঙ্ক ও আয়রন।

খেজুরের পুষ্টিগুণ, খেজুর শক্তির একটি ভালো উৎস। তাই খেজুর খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ক্লান্তিভাব দূর হয়। খেজুরের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে বলা হয় চারটি বা ৩০ গ্রাম পরিমাণ খেজুরে আছে ৯০ ক্যালোরি, এক গ্রাম প্রোটিন, ১৩ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.৮ গ্রাম ফাইবার এবং আরও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। সুস্বাদু আর বেশ পরিচিত একটি ফল, যা ফ্রুকটোজ ও গ্লাইসেমিক সমৃদ্ধ। আছে প্রচুর ভিটামিন বি, যা ভিটামিন বিসিক্স মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। খেজুর ফলকে চিনির বিকল্প হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, আয়রন, ভিটামিন এবং ম্যাগনেসিয়ামসহ নানান পুষ্টিগুণ। এসব খাদ্য উপাদান শরীরে অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে যখন আপনার বয়স পৌঁছাবে ৩০-এর কোঠায়। এ সময় মস্তিষ্কের স্মৃতি ধারণক্ষমতা কমতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, আমাদের কর্মশক্তি হ্রাস, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, পেশির সমস্যা, হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি, হিমোগ্লোবিনের অসামঞ্জস্যতা, হজমে সমস্যা, ডায়াবেটিস, হাড় ক্ষয়, ত্বকের নানা সমস্যা হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।

আর এসব সমস্যারই সমাধানে একটি দামি অস্ত্র হতে পারে খেজুর। আসুন জেনে নিই এই ফলটি আমাদের শরীরে কীভাবে কাজ করে।

 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে

শরীরে আয়রনের ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করে খেজুর। একই সঙ্গে খেজুরের মিষ্টতা চিনির বিকল্প হিসেবে কাজ করে। খেজুর ভরপুর মিষ্টি একটি ফল। সুস্বাদু এই মরু ফলটিতে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ফাইবার, খনিজ এবং ভিটামিন। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, খেজুর খেলে ব্লাড সুগার বাড়ে না। বরং এটি স্বাস্থের জন্য বেশ উপকারী। কারণ স্বাস্থের জন্য ভালো এমন অনেক উপাদান খেজুরে রয়েছে। তবে ডায়াবেটিস রোগীরা নিয়মিত খেজুর খেলে ১ বা ২টি খেতে হবে। স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি মিষ্টির বিকল্প হতে পারে খেজুর। ডায়াবেটিস রোগীদের খেজুর খাওয়ার ব্যাপারে একটি নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। ১০ জন মানুষকে চার সপ্তাহ নিয়মিত ১০০ গ্রাম খেজুর খাওয়ানো হয়েছে। চার সপ্তাহ পর তাদের ব্লাড গ্লুকোজ বাড়েনি। এবং তাদের কোলেস্টরেলও নিয়ন্ত্রণে ছিল।

 

স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায়

খেজুর নানা ভিটামিনে পরিপূর্ণ থাকায় এটি মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনার গতি বৃদ্ধি রাখে, সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ছাত্রছাত্রী যারা নিয়মিত খেজুর খায় তাদের দক্ষতা অন্যদের তুলনায় ভালো থাকে। তাই বেশি বয়সে স্মৃতিশক্তি লোপ করতে না চাইলে বয়স ৩০ হলেই খেজুর খেতে শুরু করে দিন।

 

কর্মশক্তি বাড়ায়

প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি থাকার কারণে খেজুর খুব দ্রুত শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বয়স বৃদ্ধির কারণে ঝিমুনি ভাব দেখা দিলে প্রতিদিন ৩টি খেজুর খান। তাহলেই আর ক্লান্তি আপনাকে ঘিরে ধরতে পারবে না।

 

রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি

যকৃতের সংক্রমণে খেজুর উপকারী। এ ছাড়া গলাব্যথা, বিভিন্ন ধরনের জ্বর, সর্দি এবং ঠান্ডায় খেজুর উপকারী। খেজুর অ্যালকোহলজনিত বিষক্রিয়ায় বেশ উপকারী। ভেজানো খেজুর খেলে বিষক্রিয়ায় দ্রুত কাজ করে। এ ছাড়া নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাসে বৃদ্ধি পায় শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও।

 

দৃষ্টিশক্তি প্রখর

খেজুরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। যেমন: বি১, বি২, বি৩ এবং বি৫। এ ছাড়া ভিটামিন এ১ এবং সিসহ নানা ভিটামিনের পাওয়ার হাইস বলতে পারেন খেজুরকে। এটি দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে রাতকানা রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাই বেশি বয়সে চোখের সমস্যা তাড়াতাড়ি আনতে না চাইলে খেজুর খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।

 

যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

যৌন অক্ষমতা এবং সন্তানহীনতার সমস্যা কাটাতে সাহায্য করে খেজুর। খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে শারীরিক শক্তি ও যৌন শক্তির উদ্দিপনা। আদিকাল থেকেই বিবাহ শাদিতে খোরমা খেজুর বিতারণ করার একটা রেওয়াজ চালু হয়ে আসছিল। এটা মূলত এজন্যই যে, দাম্পতি জীবনের চাহিদা পূরণে খেজুরের ভুমিকা যথাযথ। খেজুরের মধ্যে থাকা বিদ্যমান বিভিন্ন শক্তিশালৗ খনিজ উপাদান আপনার যৌন শক্তিকে বাড়াতে এবং কর্মক্ষণ রাখতে সহায়তা করে।

 

হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস

বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়ে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও। এই ঝুঁকি কমাতে পারে খেজুর। খেজুরে রয়েছে পটাশিয়াম, যা হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ করে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, খেজুর শরীরের খারাপ ধরনের কোলেস্টেরল কমায় (এলডিএল) এবং ভালো কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

 

পরিপাকে সহায়তা

তিরিশের কোঠায় হজমশক্তি আমাদের কমতে শুরু করে। তাই এ সময় খেজুর খাওয়ার অভ্যাসে আপনার হজমশক্তি বাড়বে। কারণ, অন্ত্রের কৃমি ও ক্ষতিকারক পরজীবী প্রতিরোধে খেজুর বেশ সহায়ক। খেজুরে আছে এমন সব পুষ্টিগুণ, যা খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে।

 

হাড়ের সুরক্ষায়

ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়ক। আর খেজুরে আছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, যা হাড়কে মজবুত করে। সেই সঙ্গে মাড়ির স্বাস্থ্যও সুরক্ষিত রাখে।

 

ত্বকের যত্ন

বয়সের ছাপ প্রথমে ত্বকেই ধরা পড়ে। তাই ত্বকের যত্নে খেজুর কাজে লাগাতে পারেন। নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে বাঁচায়। ত্বকের নানা সমস্যা থেকেও খেজুর মুক্তি দেয়। ত্বকের বলি রেখা নিয়ন্ত্রণ করতেও খেজুর সিদ্ধহস্ত। এ ছাড়া ত্বকের ফ্যাকাশে ভাব ও হরমোনের সমস্যা কমাতে খেজুর কার্যকর।

 

হিমোগ্লোবিনের সামঞ্জস্যতা বজায়

খেজুরে থাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। এই আয়রন শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। শরীরে রক্তাল্পতা দেখা দিলে বা হিমোগ্লোবিনের কমতি হলে খেজুর খাওয়া শুরু করুন। এর ফলে শরীরের আয়রনের মাত্রা বজায় থাকবে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক হবে এবং রক্তের কোষ উৎপন্ন হবে।

 

মজবুত পেশি

বয়সের সঙ্গে দেখা দেয় পেশির নানান জটিলতা। আর এই পেশি জটিলতা এড়াতে ভালো কাজ করে প্রোটিন। খেজুর প্রোটিন সমৃদ্ধ। তাই এটি আমাদের পেশি ভালো রাখতে সহায়তা করে এবং শরীরের জন্য অপরিহার্য প্রোটিন সরবরাহ করে।

 

ঢাকাটাইমস/০৫ ফেব্রুয়ারি/আরজেড)