জাবি ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে বহিরাগতকে হলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ

প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:০৭

জাবি প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

নেশাদ্রব্য খাইয়ে বাসে উঠিয়ে ঢাকার খিলগাঁও থেকে এক বহিরাগতকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এনে বেধড়ক মারধরের পাশাপাশি ৪৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে।

 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক অসিত পালসহ অজ্ঞাতনামা চার জন মিলে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। অভিযুক্ত অসিত পাল বাংলা বিভাগের ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী।

 

বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬-১০টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলের ২১৪/এ কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। রাত প্রায় ১টায় হল প্রভোস্ট, প্রক্টরিয়াল বডি, ছাত্রলীগ নেতা ও সাংবাদিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে পরিচালিত অভিযানে ভুক্তভোগীর বর্ণনা অনু্যায়ী রুমটি শনাক্ত করা হয়।

 

অপহরণ ও নির্যাতনে অভিযুক্ত অসিত পালের কক্ষে মদ, গাজা ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম, সিরিঞ্জসহ নানা মাদকদ্রব্য গ্রহণের সামগ্রী এবং মারধোরে ব্যবহৃত এসএস পাইপ উদ্ধার করা হয়।

 

ঘটনার ভুক্তভোগী লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁওয়ের জনৈক আরিফুল্লাহর ছেলে ওয়ালি উল্যাহ (৩০)। তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক শেষে খিলগাঁওয়ে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কোর্স করছেন।

 

ভুক্তভোগীর ভাষ্যমতে, "আমি খিলগাঁও থেকে লোকাল বাসে উঠে গুলিস্তান যাচ্ছিলাম, বাড়ির (লক্ষ্মীপুর) বাস ধরার উদ্দেশ্যে। এরপর থেকে আমি তেমন কিছু মনে করতে পারছি না। পরে আমাকে এই হলের (সালাম-বরকত) একটি রুমে রাখা হয়, যেটার পাশে বাথরুম আছে। সেখানে একটিমাত্র সেমি-ডাবল খাট আছে, চেয়ার আছে। ওই কক্ষে আমাকে চারজন ব্যক্তি এসএস পাইপ দিয়ে ঘাড়, হাত-পা ও পিঠে বেধড়ক মারধর করে এবং ১০ লাখ টাকা দাবি করে। আমি ১০ লাখ টাকা কই পাব বললে তারা আরও মারধর করে। পরে আমার ব্যাগে থাকা নগদ ৪০ হাজার টাকা তারা নিয়ে নেয় এবং বাড়ি থেকে আমার ভগ্নিপতি একটি বিকাশ নাম্বারে আরও ৫ হাজার টাকা পাঠায়। এরপর তারা আমাকে হলের বাইরে বের করে দেয়।’

 

"বের হওয়ার সময় আমি শুধু মনে রেখেছি এই জায়গায় অনেকগুলো ফুলগাছ আছে (সালাম বরকত হলের বাগান) এবং এর নাম সালাম-বরকত হল। এরপর আমি মেইনগেট খুঁজতেছিলাম। পরে একজন নারী শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করি, আপু এখান থেকে মেইন রাস্তাটা কোনদিকে, আমি বের হব কিভাবে? উনি আমাকে রিকশায় পৌঁছে দেয়ার সময় জানতে পারি তার বাড়িও একই জেলায়। পরে তাকে সব ঘটনা খুলে বলি। পরে  ক্যাম্পাসের সাংবাদিকরা উপস্থিত হয় এবং তারা আমাকে আবার সালাম-বরকত হলে নিয়ে আসেন এবং আমি সিউর এখানেই আমাকে আনা হয়েছিল এবং বাথরুমের পাশের কোন রুমে রাখা হয়েছিল। আমি কাউকে জানি না, তবে লোকগুলোকে দেখলে চিনতে পারব।’

 

বিকাশ লেনদেনের সূত্র ধরেই অনুসন্ধান চালিয়ে অসিতকে শনাক্ত করা হয়। উক্ত লেনদেনের বিকাশ এজেন্ট শনাক্ত করেছেন টাকা তুলতে আসা দুইজন ব্যক্তির একজন অসিত আর ভুক্তভোগী ছবি দেখে শনাক্ত করেছেন অসিতই মারধর ও মুক্তিপণ আদায়ে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল।

 

পরবর্তীতে হল প্রভোস্ট, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যসহ সাংবাদিক ও হল শাখা ছাত্রলীগের উপস্থিতিতে হলের সকল বাথরুমের পাশের কক্ষগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং ২১৪/এ শনাক্ত করা হয়। যদিও ততক্ষণে উক্ত রুম থেকে সেমি ডাবল বেডটি লাপাত্তা হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন "হলের বদনাম হতে পারে ভেবেই বেডটি সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।’

 

এসময় শহীদ সালাম-বরকত হলের প্রভোস্ট ও ফার্মাসিস্ট অধ্যাপক ড. সুকল্যাণ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে এখানে একটি বড় গ্যাং জড়িত আছে। এমন ঘটনার রাষ্ট্রীয় তদন্ত হওয়ার দরকার। অবস্থা দেখে যা মনে হলো, তাকে স্কোপোলামিন বা শয়তানের শ্বাস নামক ড্রাগ ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। এটির ব্যবহারে মানুষ হিপনোটাইজড হয়ে যায়।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যে এমন মাদকের প্রচলন আছে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। যেখানে নবীনরা গণরুমে থাকছে, সেখানে একজন একটি রুম দখল করে পরিত্যক্ত করে রাখাটাও অযৌক্তিক। আজকের এই ঘটনার ভুক্তভোগী যেন সুষ্ঠু বিচার পায় সেটা আমাদের একান্ত চাওয়া। আমরা এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনকে অবগত করব।’

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর রনি হোসাইন বলেন, "প্রক্টর স্যার ইতোমধ্যে অবহিত হয়েছেন। সাংবাদিকদের মাধ্যমে আমরা ঘটনায় একজন জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছি। বাকি তিনজনকেও খুঁজে বের করতে হবে। তারা কি ক্যাম্পাসের ছাত্র না-কি বাইরের- এটাও আমরা ইনভেস্টিগেশন করব। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হবে।’

 

এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে অসিত পালের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

 

উল্লেখ্য, জাবি ছাত্রলীগের এক বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, জাবিতে ইয়াবার সিন্ডিকেট চালায় এই অভিযুক্ত অসিত। কিছুদিন আগে কোনো বাসে উঠে সবাইকে জিম্মি করে টাকা আদায় করেছে অসিত এবং এ ধরনের ঘটনা সে নিয়মিত করে থাকে। শৃঙখলাভঙ্গের অভিযোগে তাকে হলের পলিটিক্যাল ব্লক থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে আরও বেশ কয়েকমাস আগেই।

 

যেভাবে পাওয়া গেল অভিযুক্তকে 

রাতেই ঘটনার সত্যতা খুঁজতে বের হন সাংবাদিকরা। প্রথমে ভুক্তভোগীর ভগ্নিপতি যে বিকাশ নাম্বারে লেনদেন করেছেন সে বিকাশ এজেন্টকে খুঁজে বের করা হয়। নাম্বারটি ছিল সালাম-বরকত হলের সামনের দোকানদার আদম আলীর। আদম আলীকে খুঁজে বের করা হলে তিনি জানান, তার শ্যালক দোকানে বসেছিল। তবে রাত সাড়ে ৯টায় একটি বিকাশ নাম্বার যার শেষ তিন ডিজিট ৩৭৭ (ভুক্তভোগীর ভগ্নিপতি যে নাম্বার থেকে টাকা পাঠায়) ৫ হাজার টাকা আসার কথা স্বীকার করেন আদম আলী।

 

এরপর আদম আলীর শ্যালক খাইরুলকে ফোন করা হলে জানায়, "প্রথমে আমার এখানে একটি কম আসে। বলে আমি ঔশিক (অসিত), চিনছো, লাস্টে ৩৭৭ থেকে ৫ হাজার টাকা গেছে, একটা ছেলেকে পাঠাচ্ছি, দিয়ে দিও। কিন্তু আমার কাছে তখন ৪ হাজার টাকা ছিল। পাশের দোকান থেকে ৫০০ টাকা ধার করে ৪৫০০ টাকা দেই আমি। একটু পর ঔশিক (অসিত) ভাই এসে বকি ৫০০ টাকা নিয়ে যান। তিনি লাল এপাচি  বাইকে চড়ে এখানে এসেছিলেন।"

 

সালাম বরকত হলে ঔশিক নামে কেউ নেই। তখন বেশ অসংলগ্ন হয়ে ওঠে তদন্ত। তবে, আদম আলীর শ্যালক খাইরুল আরেকটি তথ্য দেয় যে, "আমাদের বিকাশের লেনদেনের জন্য যে মোবাইলটি ব্যবহৃত হয়, সেটি ঔশিক ভাইয়ের থেকে কেনা। দুলাভাই (আদম আলী) কিনছেন।’

পরবর্তীতে আদম আলী ঔশিক নয় অসিতকে শনাক্ত করেন। তিনি, তার শ্যালক খাইরুল ও অপহরণের ভুক্তভোগী ওয়ালি উল্যাহকে বেশ কয়েকটি ছবি থেকে বেছে নিতে বলা হলে তিনজনই বেছে নেন অসিত পালকে।

 

(ঢাকাটাইমস/৯ফেব্রুয়ারি/এআর)