ভালোবাসা দিবসের চাপায় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:১৮ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:২৩

রাকিবুল ইসলাম

শাহবাগের যে রাস্তাগুলো আজ ভালোবাসার লাল গোলাপের ঝরে পড়া পাপড়িতে লাল হয়ে উঠেছে, ঠিক ৪০ বছর আগের এই দিনে এই রাস্তাগুলো আরও বেশি লাল হয়ে উঠেছিল। না, সেটা লাল গোলাপের পাপড়িতে নয়, সেদিন এই রাস্তাগুলো লাল হয়েছিল এরশাদী পুলিশের বুলেটের আঘাতে ছাত্র-যুবাদের বুকের তাজা রক্তে।

৪০ বছর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই সংঘটিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র-গণআন্দোলন। জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহার জীবনের দামে বাতিল হয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদের কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষানীতি। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ফাটল ধরিয়েছিল এরশাদের দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈর সিংহাসনে।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রতিবাদে চুপ থাকেনি ছাত্রসমাজ। '৫২, '৬২, '৬৬, '৬৯, '৭১-এর মতো এবারও জ্বলে ওঠে তারা। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার ও ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন ছাত্রনেতা শীবলি কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আব্দুল আলী।

এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান ক্ষমতায় এসেই প্রণয়ন করেন নতুন শিক্ষানীতি। প্রাথমিক স্তরেই বাংলার সঙ্গে ইংরেজি ও আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। মূলত ধর্মকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহারই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। খর্ব করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন। খারাপ রেজাল্ট হলেও ৫০ ভাগ শিক্ষার ব্যয় দিলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে।

মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঐকমত্যে পৌঁছায় ছাত্র সংগঠনগুলো। ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। শুরু হয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর ও জনমত তৈরির কাজ।

১৯৮৩ সালের ২৬-২৭ জানুয়ারি ২ দিনব্যাপী পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। জানুয়ারি মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন নতুন শক্তি পায়। এ সময় আঘাত আসে ভাষা আন্দোলনের চেতনার ওপর। ২১ ফেব্রুয়ারির বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ইসলাম পরিপন্থী ঘোষণা করে শহীদ মিনারে আলপনা আঁকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ। মূলত ক্ষমতায় টিকে থাকার মাধ্যম হিসেবে দেশের সাধারণ জনগণকে বোকা বানানোর জন্য এরশাদ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল গ্রহণ করেন শুরু থেকেই। সাধারণ জনগণ বুঝতে না পারলেও সংগ্রামী চেতনাধারী ছাত্রসমাজ ষড়যন্ত্রটা ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, ছাত্রবন্দিদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধের দাবিতে, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

এরপর ছাত্র সমাবেশ থেকে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে সচিবালয়ের দিকে।হাইকোর্ট গেটের সামনে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে হাইকোর্ট থেকে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত লম্বা মিছিল।কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে জলকামান নিয়ে প্রস্তুত পুলিশ। কাঁটাতারের ব্যারিকেডের সামনে এসে বসে পড়েন ছাত্রীরা এবং ছাত্র নেতারা ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেন। হঠাৎ করেই গুলিতে প্রকম্পিত চারদিক, স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পুলিশ বাহিনীর অতর্কিত হামলায় একে একে লুটিয়ে পড়েন গুলিবিদ্ধ জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল । সমবেত জনতার ওপর পুলিশ ট্রাক তুলে দেয়। মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শিক্ষার্থীদের ওপর গরম পানি ছিটানো হয়। শিশু একাডেমির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে নিহত হয় শিশু দিপালী সাহা। তার লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ। জয়নালের গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নিশ্চিত করা হয় মৃত্যু। কলাভবনেও গুলি টিয়ার শেলের আঘাতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর নৃশংস হামলা করা হয়। গ্রেপ্তার হন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী । গ্রেপ্তারকৃতদের ওপরও চলে নির্যাতন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের নিয়ে আসতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়, কিন্তু ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। সেদিন জয়নাল, জাফর, মোজাম্মেল ও দীপালি সাহাসহ অন্তত ১০ জন নিহত হন। নিখোঁজ হন আরও অনেকে। সরকারি হিসাবে গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৩৩১ জন ছাত্রকে। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি ছিল। পরে এদের মধ্যে অনেকেরই আর খোঁজ মেলেনি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ও কারফিউ জারি করা হয়।

১৫ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ওইদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন জবি ছাত্র আইয়ুব। এদিকে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। সেখানে ঢাকা মেডিকেল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও গুলি চালায়। এতে নিহত হন কাঞ্চন নামে এক ছাত্র।

স্বৈরশাসকের গুলিতে নিহত জাফর, জয়নাল, দিপালী, কাঞ্চনের রক্তের স্রোতে নির্মিত হলো এক নতুন ইতিহাস। এই আন্দোলন ছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রথম গণআন্দোলন। ছাত্রসমাজের একটি স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান, যা পরবর্তীকালে এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানকে সম্ভব করে তোলে। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে আখ্যা দেওয়া হয় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে।

কিন্তু সামরিক শাসকের কয়েক বছর যেতে না যেতেই সাংবাদিক শফিক রেহমান ১৯৯৩ সালে তার সম্পাদিত যায়যায়দিন পত্রিকায় প্রথম এই দিনটিকে উপলক্ষ করে বিশেষ ‘ভালোবাসা সংখ্যা’ বের করেছিলেন। দিনে দিনে সে ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে রীতিমতো উৎসবে।

মুক্তবাজার অর্থনীতি আর কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রবল জোয়ারে এই ঐতিহাসিক দিনটিও পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে। কথিত ভালোবাসা দিবসের নিচে চাপা পড়ছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস।

আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সেদিনের শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা সকল শহীদের।

লেখক: সংস্কৃতিকর্মী ও সাবেক ছাত্রনেতা