সাইবার ক্রাইম আসলে কী? ভুক্তভোগী হলে যেভাবে প্রতিকার পাবেন

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:৩১ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:৪৫

মফিজুর রহমান

সাইবার ক্রাইম বা সাইবার অপরাধ কাকে বলে? তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইনে যে অপরাধসমূহ সংঘটিত হয় তাকে সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম বলে।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতা বিশ্বের অপার জ্ঞানভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে যেমন অভাবনীয় উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করেছে তেমনি ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে নানাবিধ অপরাধ কৌশল উদ্ভাবনের ফলে 'নেটওয়ার্কভিত্তিক অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম'-এর মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায়ই ঘটা সাইবার অপরাধসমূহের মধ্যে রয়েছে আইডি হ্যাকিং, উগ্র ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য/অডিও/ভিডিও প্রচার, ফেইক অ্যাকাউন্ট তৈরি, সাইবার বুলিং বা হ্যারাসমেন্ট, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ও গ্যাম্বলিং ইত্যাদি। তাই অনলাইনে সুরক্ষিত থাকতে হলে আমাদের সাধারণ কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

অনলাইনে নিরাপদ থাকার জন্য সাধারণ সতর্কতা

ব্যক্তিগত ফোন/ল্যাপটপ বা অন্য যে কোনো পাবলিক ডিভাইসে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহারের পর যথাযথভাবে লগআউট হতে হবে।

আপনার পরিচিতজনের বিপদের কথা জানিয়ে ই-মেইল অথবা মেসেজ আসলে আগে যাচাই করুন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন।

লটারি/মূল্য হ্রাস বা কোনো আকর্ষণীয় সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব দিয়ে কোনো লিঙ্ক প্রেরণ করা হলে সেই লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকতে হবে, ই-মেইলে বা ইনবক্সে প্রেরিত কোনো অপরিচিত এ্যাটাচমেন্ট ওপেন করা যাবে না।

অপরিচিত কাউকে ফ্রেন্ডস লিস্টে এ্যাড করা যাবে না। অনলাইনে পরিচিত হওয়া কোনো ব্যক্তি কোনো স্থানে দেখা করতে চাইলে তা এড়িয়ে চলতে হবে।

নিজের ব্যবহৃত পুরোনো ফোন/ল্যাপটপ অন্য কারও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেওয়ার সময় নিজের সকল ব্যক্তিগত তথ্য ভালোভাবে ডিলিট করতে হবে।

সকল সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টের সিকিউরিটি অপশনে থাকা প্রাইভেসি সেটিংস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিজের ব্যক্তিগত তথ্যের এ্যাকসেস সবার কাছে দেওয়া যাবে না।

একই পাসওয়ার্ড একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টের জন্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

লগ-ইন আইডি ও পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করুন। এমনভাবে সংরক্ষণ করুন যেন অন্য কেউ সহজেই তা খুঁজে বের করতে না পারে।

অপরিচিত কারও সাথে অনলাইনে চ্যাট করা, ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করা বা কোনো সম্পর্কে জড়ানো নিরাপদ নয়। ব্যক্তিগত কোনো মূহুর্তের ছবি কোনো ডিভাইসে সংরক্ষণ করা যাবে না।

সাইবার বুলিংয়ের উদ্দেশ্যে কেউ আপত্তিকর মেসেজ পাঠালে তার উত্তর না দিয়ে বা প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে স্ক্রিনশট নিতে হবে এবং পুলিশের সহযোগিতা চাইতে হবে।

“Google Yourself" গুগলে নিজের নাম সার্চ দিয়ে দেখতে হবে আপত্তিকরভাবে কোথাও নিজের নাম বা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে কি না।

কোনো একাউন্ট থেকে বিব্রতকর ছবি বা মেসেজ পাঠানো হলে সে একাউন্ট ব্লক করে দিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বা অন্যের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে কোনো মন্তব্য  করা যাবে না।

সঠিকভাবে যাচাই না করে কোনো ধরনের গুজব বা মিথ্যা তথ্য শেয়ার করা যাবে না।

ব্যবহার্য সকল ডিভাইসে ভালো মানের এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে।

প্রতিনিয়ত bank statement লক্ষ্য করবেন, যদি আপনি লক্ষ্য করেন কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত transaction হচ্ছে অতিসত্বর ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানান।

আপনি যে বিষয় সম্পর্কে জানেন না অর্থাৎ অজানা উৎস থেকে কিছু ডাউনলোড করবেন না।

প্রতিনিয়ত আপনার সফটওয়্যার আপডেট রাখুন।

কোনো ব্যক্তিগত তথ্য প্রবেশের আগে আপনি বৈধ ওয়েবসাইটে রয়েছেন কি না তা পরীক্ষা করে দেখুন।

ভিপিএন ব্যতীত এনক্রিপ্ট না করা পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করবেন না।

পর্ন সাইটগুলোতে এমন ভাইরাস রয়েছে যা আপনার ফোন / কম্পিউটারে হ্যাক করতে পারে এবং আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডের মতো সংবেদনশীল তথ্যে অ্যাক্সেস পেতে পারে। তাই এই সাইটগুলোতে যাওয়া খুবই তথ্য সম্পর্কিত ঝুঁকি থাকে।

আপনার মোবাইল নম্বর সামাজিক মিডিয়া বা সন্দেহজনক বা অজানা ওয়েবসাইটগুলোতে শেয়ার করবেন না।

ফোন থেকে সমস্ত অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ্লিকেশন ডিলিট করে ফেলুন।

আপনার ডিভাইসটি বিক্রি করার আগে আপনার সংবেদনশীল অ্যাপ্লিকেশনগুলো এবং ফোনটিকে ফরম্যাট করে নিন।

 

ফেসবুক একাউন্টের নিরাপত্তা বিধানে করণীয়

সহজে অনুমানযোগ্য পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তিগত তথ্য যেমন: জন্ম তারিখ, নিজের নাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম ইত্যাদি পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

Capital letter, small letter, number & symbol মিলিয়ে  শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। পাসওয়ার্ডকে অনেকটা টুথব্রাশের মতো ব্যবহার করতে হবে- আমরা যেমন একটি ভালো টুথব্রাশ বেছে নেই, কারও সাথে তা শেয়ার করি না এবং অন্তত তিন মাস পর পর তা পরিবর্তন করি, ঠিক একইভাবে পাসওয়ার্ড কারও সাথে শেয়ার করা যাবে না এবং নির্দিষ্ট সময় পর তা পরিবর্তন করতে হবে।

Two factor authentication অপশন চালু রাখতে হবে (ফেসবুকের সেটিংস থেকে Security & login > use two-factor authentication এ গিয়ে মোবাইল নম্বর কিংবা ই-মেইল যুক্ত করতে হবে) অন্য কেউ লগইন করতে চাইলেও এই ই-মেইলে বা মোবাইল নম্বরে আসা কোড জানতে পারবে না বিধায় সুরক্ষিত থাকা যাবে।

জন্ম তারিখ, ফোন নম্বরসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য উন্মুক্ত রাখা যাবে না। এতে বিভিন্ন রকমের হয়রানি ও প্রতারণা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সহজ হবে।

ফেসবুকের ক্ষেত্রে Trusted Contact-এ ৩ থেকে ৫ জন বিশ্বস্ত ফেসবুক বন্ধুকে যুক্ত রাখতে হবে। এর ফলে আইডি হ্যাক হয়ে গেলেও তা উদ্ধার করা সহজ হবে।

ফেসবুকের Privacy Settings অপশনটি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে প্রোফাইল লক করে রাখতে হবে।

স্ট্যাটাস বা ব্যক্তিগত ছবি প্রাইভেসি নিশ্চিত করে শেয়ার করতে হবে। ফেসবুকে নিজের জীবনাচরণ যত বেশি উন্মুক্ত হবে তত বেশি ঝুঁকি থাকবে।

ফেসবুক একাউন্ট খোলার সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাম ও জন্ম তারিখ ব্যবহার করতে হবে। এতে আইডি হ্যাক হলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হবে।

অপরিচিত কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট না করা উত্তম। অথবা একসেপ্ট করার পূর্বে যাচাই করা বা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ।

ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হলে করণীয়

প্রথমেই http://www.facebook.com/hacked লিঙ্কে প্রবেশ করতে হবে।

এরপর “Someone else got into my account without my permission”- এ ক্লিক করতে হবে। হ্যাক হওয়া একাউন্টটির তথ্য চাওয়া হলে সেখানে উল্লেখ করা ২টি অপশনের (ই-মেইল বা ফোন নম্বর) যে কোনো একটির ইনফরমেশন দিতে হবে।

এরপর “My account is compromised” এ ক্লিক করতে হবে। হ্যাক হওয়া একাউন্টটির তথ্য চাওয়া হলে সেখানে উল্লেখ করা ২টি অপশনের (ই-মেইল বা ফোন নম্বর) যে কোনো একটির ইনফরমেশন দিতে হবে।

প্রদত্ত তথ্য সঠিক হলে প্রকৃত একাউন্টটিই দেখাবে এবং বর্তমান অথবা পুরাতন পাসওয়ার্ড চাইবে; এখানে পুরাতন পাসওয়ার্ডটি দিয়ে “Continue” করতে হবে।

হ্যাকার যদি ই-মেইল এ্যাড্রেস পরিবর্তন করে না থাকে তাহলে আগের ই-মেইলে রিকভারি অপশন পাঠানো হবে। এর মাধ্যমে হ্যাকড ফেসবুক একাউন্ট উদ্ধার করা সম্ভব।

হ্যাকার যদি ই-মেইল এ্যাড্রেস, ফোন নম্বরসহ লগইনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবর্তন করে থাকে তাহলে, Need another way to authenticate? > Submit a request to Facebook এ ক্লিক করলে ফেসবুক প্রোফাইলটি উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও আইডি সরবরাহের ফর্ম পূরণের মাধ্যমে হ্যাকড ফেসবুক এ্যাকাউন্ট উদ্ধার করা সম্ভব।

গোপনীয় বা ব্যক্তিগত কন্টেন্ট ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হলে করণীয়

কারও কোনো গোপনীয় বা ব্যক্তিগত কন্টেন্ট ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে যা করণীয়:

যে পোস্টের মাধ্যমে গোপনীয় বা ব্যক্তিগত কন্টেন্ট ফেসবুকে শেয়ার করা হয়েছে সে পোস্টের ডানদিকে রিপোর্ট করার অপশনে গিয়ে Find support or report post এ ক্লিক করতে হবে।

অপশনে থাকা বিভিন্ন ইস্যু যেমন - Fake news, violence, harassment ইত্যাদির মধ্য থেকে উপযুক্ত বিষয়টি নির্বাচন করতে হবে।

ভুক্তভোগী নিজে কিংবা তাঁর ফেসবুক বন্ধুরা Me/My friends থেকে উপযুক্ত অপশনটি নির্বাচন করে মিথ্যা বা মানহানিকর পোস্টটির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে পারেন।

সংশ্লিষ্ট পোস্টটির সম্পূর্ণ লিঙ্কসহ স্ক্রিনশট নিয়ে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে যা পরবর্তীতে যেকোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হবে।

গোপনীয় বা ব্যক্তিগত কনটেন্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে হয়রানি কিংবা বিড়ম্বনার শিকার হলে কালক্ষেপণ না করে নিকটস্থ থানা পুলিশকে অবহিত করতে হবে এবং পুলিশের কোনো সাইবার ইউনিটকে অবহিত করতে হবে।

সাইবার ক্রাইমের শিকার হলে প্রাথমিকভাবে থানায় অভিযোগ করা যেতে পারে; অথবা আইনজীবীর সহায়তা নিয়ে সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা যেতে পারে। (দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল ঢাকায়)।  পাশাপাশি নিম্নবর্ণিত যে কোনো হেল্প ডেস্কের সহযোগিতা নেওয়া যাবে:

১। সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, ৩৬, মিন্টো রোড, রমনা, ঢাকা। হেল্পডেস্ক নম্বর: ০১৭৬৯৬৯১৫২২। ই-মেইল: [email protected]

২। সাইবার পুলিশ সেন্টার, সিআইডি, ফোন: ০১৩২০০১০১৪৮ ই-মেইল: https://cid.gov.bd/

৩। ফেসবুক পেইজ-পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ)। ফোন নম্বর:  ০১৩২০০০০৮৮৮ ই-মেইল: [email protected]

৪। হ্যালো সিটি এ্যাপস (ডাউনলোড ফ্রম গুগল প্লে স্টোর)

৫। রিপোর্ট টু র‍্যাব এ্যাপস (ডাউনলোড ফ্রম গুগল প্লে স্টোর)

৬। পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন যেতে পারে

৭। এছাড়াও নিম্নোক্ত পেইজে সংযুক্ত থাকা যেতে পারে-     facebook.com/cyberctdmp, facebook.com/dmpdhaka, facebook.com/cpccidbdpolice

লেখক: অ্যাডিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ঢাকা