ইউএন পিসকিপিং মিশন মেমরী

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৭

রেজাউল মাসুদ

পশ্চিম আফ্রিকার প্রতিটি দেশই এত সুন্দর ভাবে সীমানা নির্ধারন করা আর নীতিনির্ধারকরা কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তা করলে তাদের মাথা থেকে এমন সুবুদ্ধি আর সুবিবেচনাপ্রসুত ন্যায়বিচার বেরিয়ে আসে তা দেখলে শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় বিমোহিত না হয়ে পারিনা। লাইবেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, চাঁদ সেনেগাল, নাইজার, নাইজেরিয়া, ঘানা, টগো, বেনিনসহ প্রতিটি দেশেরই আটলান্টিক মহাসাগরের সীমানা আছে, কাউকেই বঞ্চিত করা হয়নি প্রকৃতির অবাক করা বিস্ময় রহস্যেঘেরা অতল অথৈ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে।

আইভরিকোস্টের সবচেয়ে বিখ্যাত আটলান্টিক সী বীচ সানপেদ্রো সী বীচ।ইয়ামুসুক্রু শহর থেকে ৫৫০ কিমি উত্তর পশ্চিম দিকে এর অবস্হান।এছাড়া আরও যে সব বিথ্যাত বীচ আছে সেগুলোর মধ্যে গ্রান্ড বাসাম অন্যতম।আবিদজান শহরের বিমান বন্দর হয়ে চল্লিশ কিমি উত্তর পশ্চিম দিকে যেতেই পড়বে এ নয়ানাভিরাম বীচটি।ব্যস্ত এবং দারুন জনাকীর্ন থাকে সব সময় ,ছুটির দিন শনি এবং রবিবারে মানুষের ভীড়ে লোকারন্য হযে উঠে সর্বত্র।ইংলিশ মুভি কিংবা জনপ্রিয় স্টার প্লাস সিরিয়াল বেওয়াচ একেবারে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠে।

আসিয়ানী বীচটি ঘানার একেবারে সীমান্তে ।আবিদজান শহর থেকে ১২০ কিমি দক্ষিনে।সুপ্রস্ত রাস্তা সারি সারি বিভিন্ন বাহারী ফ্রেঞ্চ  নামের রিসোর্ট আর সেগুলো নয়ানাভিরাম আর্কিটেক্ট ডিজাইনে দারুন কারুকার্যে শোভা বর্ধন করে বেড়াচ্ছে।বিশ থেকে ত্রিশ কিমি এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০টি রিসোর্ট পাওয়া যাবে। আসিয়ানী বীচে যেতে ডান পাশে লেগুনা যেটা দেখতে অনেকটা লেকের মত,প্রতিটা লেকেই সুইমিং পুলের ব্যবস্হা করা আছে।একপাশে লেক, লেগুনা সুইমিং পুল মাঝে রিসোর্ট আর অপর পাশে বিশাল আটলান্টিক মহাসাগরের অথৈ জল আর ঢেউয়ের মাতলামী। এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই আছে।ঐশ্বর্য রাই এর বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার ফাইনাল অনুষ্ঠানাটি আইভরিকোস্টের আবিদজানের এই লেগুনার জলের পাশেই নির্মিত স্টেজে করা হয়েছিল। এখন তার নামেই পার্কটি ব্যবহৃত হচ্ছে ঐশ্বর্যা রাই পার্ক।পুরো টিমটি নাকি এই আসিয়ানী বীচের রিসোর্টে উঠেছিল।তারা মুগ্ধ হয়েছিল আসিয়ানী বীচ দেখে। আটলান্টিক সাগরের মায়ায় সাতদিনের জায়গায় তারা পনের দিন অবস্হান করেছিল আফ্রিকার ইউরোপ এই আইভরিকোস্টে।

ভার্জিন বীচ নামে আরও একটা বীচ আছে আইভরিকোস্টে,ওখানে নাকি শুধু প্রেমিক প্রেমিকারা যায়,দারুন সুন্দর নাকি ওটা,পাথুরে বীচ,তবে ইনানী বা সেন্টমার্টিন  মত না,পাথুরে পাহাড় বেয়ে  উপরে উঠে আবার নেমে ভার্জিন বীচে নাকি যাওয়া লাগে।তবে একেবারে ছোট এরিয়া।হলিডে গুলোতে কপোত কপোতীদের ভীড়ে মুখরিত থাকে।

প্রতিটি বীচেই আমার যাওয়া হয়েছে।কেননা সমুদ্র আমার বরাবরই ভাল লাগে। ভাল লাগে সাগর পাড়ে ঢেউগুলোর আছড়ে পড়া দেখতে। আরও ভাল লাগে সৈকতে পা ভিজিয়ে বালুর মাঝে হেঁটে বেড়াতে। সাগর পাড়ি দিয়ে যে বাতাসগুলো দেহমন ছুঁয়ে যায়, তারা যেন আমাদের প্রলুব্ধ করে সারাক্ষণ সৈকতে বসে থাকতে। সন্ধায় সূর্য যখন ডুবে যায়, পশ্চিমের রক্তিম আভা সাগরের ঢেউয়ে মিশে যেন একাকার হয়ে যায়। অল্প দূরে আকাশে মিটিমিটি জ্বলে সন্ধাতারা যেন জানান দেয়, আঁধারে আসছে তারার মিছিল।

আমরা যখন সানপেদ্রো বীচে যাই সাব ইন্সপেক্টর মজিবর তা দেখে হতাশ হয়ে বলেছিল স্যার এত দূরে সাগর দেখতে আসার কোন মানে হয়না,সব সাগরই তো একইরকম।উনার কথার সাথে আমি একেবারে দ্বিমত প্রকাশ করলাম।আসলে একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম।চিটাগাং মেট্রোপলিটন পুলিশে থাকা কালীন সময়ে প্রতিমাসে একবার সকল অফিসারদের ডিউটি তদারকীর জন্য সারা রাত এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে ঘুরে দেখতে হত,রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে আমি প্রতিবারই পতেঙ্গার জনমানবহীন বীচে বসে সাগরের হাওয়া খেতাম আর প্রকৃতির অবাক করা রহস্য উপভোগ করতাম।ড্রাইভার কনস্টবল শাহীন ও বলে স্যার রাতের সাগর নাকি দেখতে হয়না,তাতে মন খারাপ আর দুঃখ বাড়ে,ওর কথার কোন মানে বুঝিনাই হয়তবা তার বউ বাচ্চার টানে বাসায়  যেতে চাচ্ছে আর আমাকেও কনভিন্স করার বৃথা চেষ্টা করছে।

ঘানা সফরে গিয়েও আমাদের প্রধান আকর্ষন ছিল সমুদ্র দর্শন কেপকোস্টে গিয়ে আটলান্টিক দেখে তো অবাক হযে গিয়েছিলাম,পুরো শহরটিই যেন সাগরের মায়ায় মোহিত হযে আছে কেমন জানি এক মন ভাল করার মাতাল হাওয়া সর্বত্র ।কেপকোস্ট আটলান্টিক এর গর্জন মনকে মাতিয়ে রাখে সারাক্ষন।দৃরে  ফিসিং বোটগুলো যখন ঢেউয়ের তোড়ে দোল খায় মনে হয় এ যেন আরেক দুনিয়া।

ঘানার রাজধানী আক্রার লাবিডা বীচ দারুন উপভোগ্য,দিনটি ছিল হলিডে বছরের শেষ দিন,যেন মানুষের মিছিল,ওখানে গিযেই হোচট খেলাম,বীচে ঢুকতে এন্ট্রি ফি দেওয়া লাগবে,বলে কি প্রকৃতির সৃষ্টি আর রহস্য দেখতে টাকা দিতে হবে কেমন কথা,এসেই যখন পরেছি যেতে হবেই।লাবিডা বীচে ঢূকলাম ।এ বীচের বর্ণনা কি দিব,আমার দেখা দারুন এক বীচ, বীচের কোল ঘেষেই অনেক রিসোর্টের মত করা আছে,আর প্রতিটা রিসোর্টের সামনেই মন মাতানো অনুষ্ঠা্ন হচ্ছে,কেউ নানা ধরনের শারিবীক কসরৎ দেখাচ্ছে,আবার কোনটার সামনে ঘানাইয়ান নাচ চলছে,আমরা মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করে চলছি,আর সাগরের ঢেউয়ের তোঢ়ে মাঝে মাঝে ভেসে যাচ্ছি।একজায়গায় গিয়ে থমকে দাড়ালাম,সার্কাস দেখানোর মত রিস্কি কাজ করছে লোকটা,এক পর্যায়ে দেখলাম টেবিলের উপর একটা কাচের বোতল প্রচন্ড শব্দে ভেঙে ফেলল ,আর গুড়া কাচ গুলো পুরো্টাই খেয়ে ফেলল।দর্শক সারিতে যারা ছিল তারা তো ভয়ে অস্হির ।ফুল ভলিউমে ঘানাইয়ান মিজজিক চলছে আর সাথে চলছে স্বল্পবসনার নারী এবং পুরুষদের সাগর মাতানো  উন্মাদনা।কিন্ত সর্বত্র একটা দারুন সুশৃঙ্খল কোথাও বেহায়াপনার বিন্দুমাত্র কিছু নেই।

গতবছর গ্রীসের এথেন্সে কিছুদিন ছিলাম,সাব ইন্সপেক্টর কদ্দুস কোন ক্রমেই ভুমধ্য সাগর দেখবে না এরিস্টটল,প্লেটোর একাডেমী অথবা সক্রেটিসের বাড়ী কিংবা প্রথম অলেম্পিক স্টেডিয়াম দেখায় ওর ব্যস্ততা বেশী ,ওর কথা স্যার সাগর দেখার জন্য তো ইউরোপে আসিনাই,এবার আমি দ্বিমত না পুরো বিপরীত মত পোষন করলাম।ভুমধ্যসা্গরের নীল স্বচ্ছ আর পরিস্কার পানির জন্য তা দুনিয়া বিখ্যাত আগে থেকেই শনেছি,এথেন্সে এসেও  দেখব না তা কি করে হয়,ওকে কোনরকমে বুঝিয়ে নিযে আসলাম,আমরা সারাদিন ভুমধ্য সাগর বীচে কাটালাম,মনে হচ্ছিল ছবির মত,কল্পনার জগতে যেন ভেসে বেড়াচ্ছি,এত স্বচ্ছ পরিস্কার আর নীল  পানি থাকতে পারে তা আমার আগে জানা ছিলনা,চার পাচ ফিট পানির নীচের সব কিছু একেবারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল,আর পুরো বীচ জুড়েই ফ্যামিলী ললনাদের স্বল্প বসনার কেউ কেউ , অনেকের তাও ছিলনা,হয়তবা ওদের জন্য  এসব কিছু না , প্রথমে একটু হোচট খেলেও পরে স্বাভাবিক মনে হল নিজেকে,যার যার দেশের কালচার কে সন্মান করতে তো হবে।এথেন্স ভুমধ্য সাগর দর্শন করে কদ্দুসের মন্তব্য ছিল,এই নীল জল আর ভুমধ্য সাগর বীচ না দেখলে জীবনের বিরাট একটা অংশ অপূর্ণ রয়ে যেত।

আর কক্সবাজার!! আমার দেশের চট্টগ্রাম আর কক্সবাজার বীচের কোন তুলনাই হয়না,পৃথিবীর যত সাগর আর বীচ আছে আমার মনে হয় আমার দেশেরটা্ই সেরা। দুইপাশে পাহাড়, একপাশে নদী, অন্যপাশে সাগর। মোহনা থেকে শুরু করে উজানে ১০ কিমি বন্দরের জেটি, বিশ্বের নানাদেশের নানা পতাকাবাহী নোঙর করা সারি সারি জাহাজ, নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি করে।পর্যটক হয়ে যিনিই আসেন, অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। পৃথিবীতে এরকম সৌন্দর্যে ভরপুর দ্বিতীয় কোন নদীর মোহনা অদুরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত সত্যিই বিরল।

কক্সবাজার এর লাবনী কলাতলী ইনানী  কিংবা সেন্টমার্টিন  বীচ দুনিয়া বিখ্যাত।অল্পের জন্য প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চার্যের খ্যাতি থেকে বঞ্চিত হলাম আমরা। আইভরিকোস্টের  আমাদের কনফারেন্স রুম কিংবা প্রতিটা অফিস রুমে বাংলাদেশকে উপস্হাপনের যতগুলো পিকচার আছে তার মধ্যে কক্সবাজারেরটাই দারুন। যত বিদেশী মেহমান আসে সবাই অবাক হয়ে যায়, হিমছড়ির উপর থেকে মেরীন ড্রাইভের রাস্তা আর সুউচ্চ পাহাড়সহ দৃষ্টিনন্দন আর শৈল্পিক ভাবে পিকচারটা উঠানো হযেছে।ভারত মহাসাগরের এই বঙ্গোপসাগর এত সুন্দর দৃষ্টিনন্দন আর নজর কাড়া থাকতে পারে এটা  তাদের কাছে একটা বিস্ময়।কক্সবাজার ভ্রমনে কে যেতে না চায়, বার বার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে পর্যটন নগরীর সাগরের বুকে। যুগল বিদেশী বেওয়াচ টাইপনা!পুরো ফ্যামিলীসহ কক্সবাজার ট্রিপ! এর চেয়ে আনন্দময় সুন্দর আর ভাল কিছু থাকতে পারে কি? যে ট্রীপে থাকবে সবাই! মমতাময়ী মা, বটবৃক্ষ বাবা , স্নেহের ভাই, প্রিয় সহধর্মিনী, থাকবে আদুরে সন্তান।

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা