রাজউকের মাস্টারপ্ল্যানের কী হলো শেষ পর্যন্ত?

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২৩, ০৮:০৬ | আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৩, ০৮:১০

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস:

রাজধানীকে বাসযোগ্য রাখার লক্ষ্যে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপের গেজেট প্রকাশের ছয় মাস পার হয়েছে। তবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউকের ১৫৮২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় নতুন এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতপার্থক্য নিরসন হয়নি।

ভূমির সুনির্দিষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে দূষণ, যানজট, জলাবদ্ধতাসহ অন্যান্য নাগরিক সমস্যা নিরসনে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট নতুন করে ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

ঢাকা শহরের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য প্রণীত এই মহাপরিকল্পনা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদ থাকবে। টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৩-এর ধারা ৭৪ এর উপধারা-১ এর বিধান অনুযায়ী সরকার এ মাস্টারপ্ল্যানের গেজেট প্রকাশ করে।

গেজেটের পর ড্যাপ নিয়ে রাজউক ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। গেল জানুয়ারির মাঝামাঝি ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা হলেও অনেকে কমিটিতে নাম প্রস্তাব পাঠাননি। এমনকি মিটিং পর্যন্ত হয়নি।

এদিকে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ড্যাপ মেনে তাদের ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এতে জমির মালিক ও আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে।

এর আগে ২০১৬ সালে সংশোধিত ড্যাপ প্রণয়ন কাজ শুরু করে রাজউক। আর একই আইনের ৭৩ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর ড্যাপের আপত্তি বা সুপারিশ দিতে সর্বসাধারণের প্রতি আহবান জানানো হয়। সেসব মতামত ও সুপারিশ আমলে নিয়ে ড্যাপ গেজেটভুক্ত করা হয়। রাজউকের এ মাস্টারপ্ল্যান প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড পৃথকভাবে প্রকাশিত হয়।

এর আগে সংশোধিত ড্যাপ গেজেটভুক্ত হওয়ায় ২০১০ সালের ২২ জুন রাজউকের প্রথম ড্যাপ গেজেটভুক্ত হয়। নতুন ড্যাপের গেজেটের পর আগের ড্যাপ বাতিল হয়েছে। রাজউকের প্রথম ড্যাপ নিয়ে অংশীজনদের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। এ কারণে ওই ড্যাপের সুপারিশগুলো বলা চলে অকার্যকর ছিল।

ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং এখনো হয়নি। আমরা বিভিন্ন অংশীজনের কাছে প্রতিনিধি চেয়েছি। তারা এখনো প্রতিনিধিদের নাম পাঠায়নি। প্রতিনিধিদের নাম পেলে তারপর আমরা বসে একটা ট্রান্স অফ রেফারেন্স তৈরি করব।’

নতুন ড্যাপ মেনেই ভবন নির্মানে করা হচ্ছে কি না প্রশ্নের জবাবে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিতে হবে। পরবর্তীতে ড্যাপের সংশোধনী এলে নিয়মও পরিবর্তন করা হবে।’

রাজউকের ওয়ার্কিং কমিটি শিগগির হয়ে যাবে আশা করছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলগমীর শামসুল আলামিন কাজল। ওয়াকিং কমিটি অফিশিয়ালি কোনো চিঠি পাননি বলেও তিনি জানান।

ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘সকলের সমন্বয়ে গ্রহনযোগ্য, বাস্তবধর্মী, সময়োপযোগী একটি ড্যাপ দরকার। এখন আমাদেরকে যে নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে, তাতে খুব দ্রুত প্রকল্প দিতে আমাদের মেম্বাররা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। নীতিমালায় কন্ডিশন আর হাই রেস্ট্রিকশনের কারণে জমির মালিকেরা সেটা গ্রহণ করতে চাচ্ছেন না। যার কারণে আমাদের মেম্বারদের সঙ্গে জমির মালিকদের বনিবণা হচ্ছে না। এতে ব্যবসা করাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে।’

রিহ্যাব সভাপতি আলগমীর শামসুল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এসব ব্যবসা হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী। আবার আমরা যেগুলোর কাজ করছি সেগুলো আরও এক দেড়বছর আগে নেয়া প্রজেক্ট। এখন যেগুলোতে আমরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছি, এটার ইফেক্ট আমরা আরও ছয়-সাত মাস বা একবছর পর পাবো।’

জানা গেছে, ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) অনুসারে রাজউক ও অন্যান্য সরকারি সংস্থা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এমআরটি করিডোর বরাবর স্টেশনকেন্দ্রিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট সংক্রান্ত পলিসি ও গাইডলাইন প্রস্তুতকরণের জন্য রাজউক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

রাজউক অনুমোদিত আবাসন প্রকল্পের অন্তত একটি প্রধান সড়ককে আরবান লাইফ লাইন অর্থাৎ পর্যাপ্ত গাছপালা, স্ট্রিট ফার্নিচার, দৃষ্টিনন্দন ও কার্যকরী আরবান ডিজাইনের মাধ্যমে নিরাপদ, উপভোগ্য, পথচারীবান্ধব ও সাইকেলবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজউক ও সংশ্লিষ্ট আবাসন কোম্পানিসমূহের মধ্যে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

তাছাড়া রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প, উত্তরা (৩য় পর্ব) প্রকল্পসহ ড্যাপে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য ৪টি সাইটের সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি জমিতে সাশ্রয়ী আবাসনকে উৎসাহিতকরণের জন্য ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) এর আলোকে ভবনের নকশায় ৪০০-৬০০ বর্গফুটের কমপক্ষে ৫টি সাশ্রয়ী ইউনিট থাকলে পরিকল্পনা অনুমোদনপত্রে ০.৭৫ পর্যন্ত এফএআর প্রণোদনা প্রদানের কার্যক্রমও চলমান আছে।

হাজারীবাগ পুরাতন ট্যানারি এলাকাসহ পুরাতন ঢাকার সাতটি স্থানে ড্যাপের রূপরেখা অনুসারে নগর পুনঃউন্নয়নের লক্ষ্যে রাজউকে ঢাকা আরবান রিজেনারেশন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। শিগগিরই ভূমি পুনর্বিন্যাসকরণ ও উন্নয়ন-স্বত্ব বিনিময় ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটসের বিস্তারিত নীতিমালা ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

জানা গেছে, রাজউক কর্তৃক কেরানীগঞ্জে একটি আঞ্চলিক পার্ক ও কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর শেখ রাসেল পার্ক, সাভার ও গাজীপুরে আরও দুইটি আঞ্চলিক পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার আশে পাশে নদীসমূহ সংস্কার ও সচলকরণের লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিইটিএ-কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ড্যাপের এলাইনমেন্ট অনুসারে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল উদ্ধারের লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে ও অন্যান্য খালগুলো সংস্কারকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকার যানজট নিরসনে ড্যাপ ও রিভাইজড স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে চিহ্নিত ইনার ও মিডল রিং রোড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ সমন্বয়কের ভূমিকায় কাজ করছে।

ড্যাপ সূত্রে জানা গেছে, ড্যাপ ও ওয়াসার মাস্টার প্ল্যান অনুসারে বিভিন্ন স্থানে পানি শোধনাগার স্থাপনসহ ওয়াসা অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ড্যাপের ৭৫টি উপ-অঞ্চলে ২০৩৫ সনের মধ্যে ৬২৭ টি স্কুল, ২৮৭ টি হাসপাতাল, ৫ টি আঞ্চলিক পার্ক, ২০ টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ৩টি ইকোপার্ক, ২৩ টি খাল, ৫০০ টি পুকুর, ১৩৯ কিমি সড়ক পথ, ৪০০ কিমি জলপথ, ৫০০ কিমি সাইকেল লেন, ১০০০ কিমি পথচারীদের জন্য হাটার পথ প্রভৃতি প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১০০টি স্কুল বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর পত্র প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব নাগরিক সুবিধা বাস্তবায়ন হলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা মহানগরী বিনির্মাণ সম্ভব হবে।

(ঢাকাটাইমস/০২মার্চ/এসএস/ডিএম)