ভূমি বিরোধ ও এর আত্মকাহিনী

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৩, ১৫:৪৩ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৩, ১৫:৪৭

মো. আসসাদিকজামান

আকমল সাহেব চাকরী থেকে সম্প্রতি অবসরে গেছেন। সারাজীবনের জমানো টাকার বড় অংশ দিয়ে ৭.৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। নামজারি করার জন্য ভূমি অফিসে গিয়ে দেখলেন তার ক্রয়কৃত জমির মধ্যে ৪ শতাংশ নামজারিযোগ্য। ৩.৫ শতাংশ মূল জোতে জমি নেই। ৩.৫ শতাংশ জমিতে ভেজাল। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার সামিল। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য জমি কিনে কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গচ্ছিত আদরের জমানো টাকায় কিনা জমিটা এখন তাঁর জীবনের অন্যতম অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। কোন একজন তাকে বলেছে, “ও মিয়া, তুমি যার কাছ থেইকা ৭.৫ শতাংশ কিনছিলা, সে তো তার বইনের জমিসহ তোমারে দিয়া ফালাইছে”। শুরু হলো মিস কেসে তার টিকে থাকার গল্প।  

আসমা খাতুন একজন স্কুল শিক্ষক। ছোট পরিবার। এক ছেলে এক মেয়ে উভয়ে স্কুলে যায়। স্বামী ছোট একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। উভয়ে ভদ্র স্বভাবের। নির্ভেজাল জীবন পছন্দ করে। কিন্তু ৬ ফুট জায়গা নিয়ে পাশের বাড়ির মর্জিনা বেগমের সাথে বিরোধ। মর্জিনা বেগম ঝগড়াটে স্বভাবের। তার উচ্চস্বরে প্রতিবেশিদের অনেক সময় ঘুম ভাঙে অ্যালার্মের প্রয়োজন হয় না।

কাছা দিয়ে ঝগড়া করার তার সুখ্যাতি ও পারদর্শিতা রয়েছে। তার স্বামীও তাকে ভয় পায়। স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই জোকসটি অনেকটা সামজ্ঞস্যপূর্ণ। একবার রেললাইনের প্লাটফর্মে বেশি ব্যাগ ও বস্তা দেখে কুলি জিজ্ঞেস করেছিলো, ম্যাডাম, ও ম্যাডাম কুলি লাগবো? জবাবে ম্যাডাম বলেছিলো, এই ব্যাডা দেহসনা মোর স্বামী আছে। মর্জিনা বেগম অনেকটা সে স্বভাবের। সেই ৬ ফুট জমির মালিকানা ও দখল নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ।

অফিসে থাকা অবস্থায় আসমা খাতুনের স্বামীর মোবাইলে ফোন গেলেই সে কেপে উঠে এই বুঝি বাসায় ঝগড়া লেগেছে। এটি বলা হয়ে থাকে, No news is good news. অর্থাৎ নিকটস্থ মানুষের কাছ থেকে ফোন না আসা মানে সে ভাল আছে। যাইহোক সেই ৬ ফুট জমির মালিকানা প্রমাণ নিয়ে দীর্ঘদিন মিস কেস চলছে। আসমা খাতুনের প্রতীক্ষা কবে সেটির সমাধান হবে এবং সে তার নিজের মতো করে নির্ভেজাল জীবন যাপন করবে।

মাহতাব উদ্দিন (৭৯) ও আফতাব উদ্দিন (৬৩) দুই ভাই। জীবদ্দশায় ভাইয়ে ভাইয়ে খুব মিল ছিল। অবশ্য এখন এমনটা খুব কম দেখা যায়। ছোটবেলার ভাই বোনের আড়ি বা ঝগড়া থাকত ২ ঘন্টা। কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে কাট্টি নিতো, আবার অল্প সময়ের মধ্যেই বৃদ্ধাঙ্গুলি মিলিয়ে মিল মিল। এখন বিরোধ বা অভিমান থাকে দাফন কাফন পর্যন্ত।

গ্রামের নির্ভেজাল হাওয়ায় পরিবার নিয়ে শান্তিপুর্ণ জীবন যাপন করেছে দুই ভাই মাহতাব ও আফতাব। মুখে মুখে উভয়ে জমির ভাগ বাটোয়ারা করে নিজ নিজ ভোগ দখলে আছে। মাহতাব উদ্দিন সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। মাহতাব উদ্দিনের বড় ছেলে পড়াশুনা করে বিদ্বান হয়েছেন। রাজনীতির সাথেও তার সম্পৃক্ততা আছে। চার পাঁচজনকে প্রতিদিন চা খাওয়ায়। আফতাব উদ্দিনের ছেলেরা জমি চাষাবাদ করে। জমির দাম বাড়ার কারণে চাচা আফতাব উদ্দিন যে জায়গায় ভোগ দখলে আছে সে জায়গার এখন ভাগ চায় মাহতাব উদ্দিনের বিদ্বান ছেলে।

বাবার মৌখিক জমি বন্টন নিয়ে সে সন্দিহান ও মানতে নারাজ। সে বাবার সন্তান, এটি মানতে রাজি আছে কিন্তু বাবার এতদিনের মৌখিকভাবে দেয়া বন্টন মানতে তার ঘোর অনীহা কারণ চাচার জমির বর্তমান মূল্য বেশি। বলে আমার বাবা যে দিয়েছে তার প্রমাণ কি? কোন রেজিস্ট্রিকৃত বন্টননামা আছে? তাই দাগে সমহিস্যা চাই। রেজিস্ট্রিকৃত বন্টননামা আবার কি শব্দ সেটা আফতাব উদ্দিন তার বিদ্বান ভাতিজার কাছ থেকে আজই প্রথম শুনলো। শুরু হলো মিস কেসে টিকে থাকার গল্প। 

আকমল সাহেব, আসমা খাতুন বা আফতাব উদ্দিন সবই প্রতিকী নাম। তবে জীবনের গল্পটিতে অনেকের সাদৃশ্য রয়েছে। আকমল সাহেব মাস্টার্স পাশ করেছেন; কিন্তু গর্ব নিয়ে বলেছেন, ল্যান্ড বা ভূমি নিয়ে আমার তেমন নলেজ নেই। সেই গর্বই এখন তার অস্বস্তির কারণ কেন শিখলাম না? ভূমি বিষয়ক পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় তাদের এখন পাশের গ্রামের মাতবর চাচার দ্বারস্থ হতে হয়। মাতবর চাচা জমির হিসাব-নিকাশে খুব পারদর্শী। অনেকের জমি বেচাকেনা করে দিয়েছেন। কাগজ কলম দেখলেই বুঝতে পারেন। সিএস, এসএ, আর এস, মৌজা ম্যাপ, পর্চা, নকশা যে শব্দগুলো আকমল সাহেব, আসমা খাতুন বা আফতাব উদ্দিনের কাছে আধারের মতো সে সব কিছুতে মাতবর চাচার পারদর্শিতা।

ভূমি অফিসে শুনানীর দিন মাতবর চাচাকে নিয়ে যেতে পারলে অনেকটা স্বস্তির বিষয়। মাতবর চাচাকে যখন ভূমি অফিসে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো তখন মাতবর চাচার বডি ল্যাংগুয়েজ আপ। ডিমান্ড বেড়ে যায়। আগে কাগজ দেখানোর জন্যও সিডিউল নিতে হয়। মাতবর চাচা ব্যস্ত না হলেও এখন মহা ব্যস্ত কারণ ব্যস্ত মোড়লের কদর বেশি। তবে মাতবর চাচা আন্তরিক। ভূমি অফিসে শুনানীর দিন মাতবর চাচাসহ আরও ২/৪ জন নব্য নেতাকে নেয়ার অভিপ্রায় আকমল সাহেব, আসমা খাতুন বা আফতাব উদ্দিন সাহেবের। সিএনজি বা উপযোগী যানবাহন দিয়ে নেয়াটা বাঞ্চণীয়, সাথে দুপুরে ভাল খানাপিনা। বিশাল আয়োজন করে নির্ধারিত তারিখে শুনানীতে উপস্থিত হওয়ার পর আকমল সাহেব/আফতাব উদ্দিন জানতে পারলেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সরকারী কাজে বাহিরে আছেন। শুনানীর পতা (মানে পরবর্তী তারিখ ০০/০/০০০০ বা দুই মাস পর)।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার শতটি কাজ; সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, তদন্ত, প্রটোকল, অভিযান ইত্যাদি ইত্যাদি তাই অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও পতা। অথবা ব্যস্ততা থাকায় দুই মিনিট শুনে অধিকতর শুনানীর পতা ০০/০/০০০০ বা দুই মাস পর। নিরাশ হয়ে বেরিয়ে আসলেন আকমল সাহেব/আসমা খাতুন/আফতাব উদ্দিন তার সাজানো দল নিয়ে। দিনটি পূর্বনির্ধারিত ছিল বলে দুই মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। ব্যক্তিগত কাজ, অফিস, দাওয়াত, বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেয়া বা অন্যান্য সকল কাজ থেকে সেদিন ছুটি নিয়েছেন। আকমল সাহেব/আসমা খাতুন/আফতাব উদ্দিন পতায় (পরবর্তী তারিখ) হতাশ হলেও সাথে থাকা মাতবর চাচা বা অন্যান্য প্রভাবশালীদের কিছু আসে যায় না। মন খারাপ করে বের হয়ে আসলেন। তবে খানাপিনার আয়োজন করা কিন্তু বাঞ্চনীয়। একটি ভাল রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভাল ভাল খাবার অর্ডার করলেও আকমল সাহেব/আসমা খাতুন/আফতাব উদ্দিনের সে খাবারে কোন আনন্দ নেই।

আসমা খাতুনের চোখে মুখে স্বপ্ন, কবে শেষ হবে ঝগড়াটে সেই মর্জিনা বেগমের তিক্ত কথার ছুড়ি যা তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে? আকমল সাহেবের দীর্ঘ নিঃশ্বাসে প্রশ্ন, আমি কি ৭.৫ শতাংশ জমিই পাবো তো? আফতাব উদ্দিনের মনে প্রশ্ন, যে ভাতিজাকে নিয়ে কাধে করে ছোট বেলায় মেলায় নিয়ে গিয়েছি সেই ভাতিজাকি এতো সহজেই রেজিস্ট্রিকৃত বন্টননামা ছাড়া আমাকে সেই জমি দিয়ে দিবে? কেবলই তাদের অপেক্ষা...

 

লেখক: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)