‘মা’ দায়িত্ব আর আদর্শের বীজ বুনে দিয়েছিলেন

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:১৫ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩, ১০:২৭

অভিজিত রায় কৌশিক, ঢাকাটাইমস

তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব, নেপোলিয়নের প্রখ্যাত উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয় কুষ্টিয়া জেলার খোকসার একজন মা অনুভা ঘোষ। বিখ্যাত এই উক্তিটির সঙ্গেই মিলেছে তার জীবন। পাঁচ সন্তানের জননী একজন সফল মা। প্রতিটি সন্তানই শেষ করেছে উচ্চ শিক্ষা। চাকরিও করছেন দেশ-বিদেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। পাঁচ সন্তানের কেউ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), কেউ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), কেউবা আবার রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), কেউ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (এমবিএসটিইউ) নানান উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অধ্যয়ন শেষ করেছেন।

পাঁচ সন্তানই যেন পৌঁছে গেছে সফলতার শেষ প্রান্তে। আর এর পেছনে শক্ত হাতে হাল ধরে রেখেছেন যিনি তাকে রত্নগর্ভা বলে আখ্যায়িত করা হলেও কম হয়ে যাবে। তাই তো এই রত্নগর্ভা মায়ের সন্তানদের কথায় ফুটে উঠেছে ‘মা আমাদের মাঝে দায়িত্ব আর আদর্শের বীজ বুনে দিয়েছিলেন তাই হয়তো কখনো পথ হারা হয়নি আমরা।’

এই রত্নগর্ভা মায়ের পাঁচ সন্তান হলেন­- অশোক কুমার ঘোষ, ডলি ঘোষ, স্বপন কুমার ঘোষ, সমীর কুমার ঘোষ এবং তুষার কুমার ঘোষ। তাদের পিতা অমরেশ চন্দ্র ঘোষ (রতন)। পরিবারের দু-বেলা দু-মুঠো খাবারের সন্ধানেই যার কেটে গেছে সারাটা জীবন। সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে দিতে পারেননি একবিন্দু সময়ও। মায়ের প্রবল চেষ্টায় আজ সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন প্রতিটি সন্তান। তবে মায়ের পাশাপাশি এই সফলতার পেছনে রয়েছে আরও একটি মানুষের অবদান। কাকা শ্যামল কুমার ঘোষ, পেশায় যিনি একজন হাই স্কুল শিক্ষক।

মা শব্দটি ছোট্ট হলেও, দায়িত্ব বিশাল। মমতা, আশ্রয়, নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা ও নির্ভরতা সবই রয়েছে এই একটি শব্দের মাঝে। এই মা-ই কঠোর পরিশ্রম এবং নিজের স্বপ্নের মাঝেই সুশিক্ষা দিয়ে সন্তানকে গড়ে তোলেন। এতে সন্তানরা দেশে-বিদেশে হয় আলোকিত। আর সন্তানের আলোয় আলোকিত হয় মায়ের মুখ।

এই পাঁচ সন্তানের জননীরও আলোকিত হয়েছে মুখ। এটা তো গর্বের বিষয় যার পাঁচ সন্তানই এখন প্রতিষ্ঠিত। তবে সমাজে এমনও প্রতিষ্ঠিত সন্তান রয়েছে যাদের জননী রত্নগর্ভা হলেও শেষ জীবনে আশ্রয়ের বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তাদের। তবে তার সম্পূর্ণ ভিন্ন এই জননীর ছেলেরা। কর্মক্ষেত্রে আলাদা আলাদা থাকতে হলেও এখনও সংসারের হাঁড়ি একটি। আর এই সংসারেই মা যেন মাথার মণি।

সন্তানেরা আলোর মুখ দেখলেও ভোলেনি মায়ের অবদানের কথা। তাদের মুখে এখনও যেন মায়ের জয়গান। কর্মক্ষেত্রে বাবাকে ব্যস্ত সময় পার করতে হওয়ায় সন্তানদের সবকিছুরই হাতে খড়ির হাল ছিল মায়ের হাতে। এই মায়ের অনিশিকার্য অবদানে পাঁচ সন্তানের মাথার মণি হয়ে রয়েছেন এই মা।

দেশের শিক্ষা অর্জন শেষ করে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় পাড়ি জমিয়েছেন ছোট ছেলে তুষার কুমার ঘোষ। বিদেশের মাটিতে পাড়ি দিয়েও ভোলেননি মায়ের অবদান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি মনের আবেগ প্রকাশ করে লিখেছেন...

সোফায় বসে আছি, মা এসে বলছেন "চৈতন্য" শব্দের অর্থ কি।  আমি উত্তর দেওয়ার পর আরও তিনটা শব্দের অর্থ  জিজ্ঞাসা করলো। এই একটা জিনিস আমাকে খুব অবাক করে, এই ৬৮ বছর বয়সে জ্ঞান অর্জনের যে পিপাসা আমাকে সর্বদাই অভিহিত করে।

প্রাইমারির গণ্ডি পার না করা আমার মা যখন তার সমবয়সী আরও কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিদিন বিকালে ভাঙা ভাঙা ভাবে বই পড়ে, বই নিয়ে আলোচনা করে, নিজে জানার চেষ্টা করে অন্যকেও উদ্বুদ্ধ  করে।

আমার মায়ের বাবা (দাদু) মারা যায় ছোটকালে। পড়াশোনায় আগ্রহী মায়ের পড়ালেখা বেশিদূর আগাইনি।  তারপর বাবা হারা মেয়ের বিয়ে (১৯৭০ সালে) হয় এক দরিদ্র একান্নবর্তী পরিবারে কোমরভোগ গ্রামে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে দরিদ্রতা যেন আরও চেপে ধরে। মায়ের সংসার আর স্বাধীনতা অর্জিত বাংলাদেশ যেন একে অপরের প্রতিবিম্ব। বাংলাদেশের হাল ধরেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এই দিকে অভাব অনটনের সংসারে শক্ত হাতে হাল ধরেন আমার মা। এই দারিদ্র্য আর সংগ্রাম করতে করতে তার সংসারে আসে ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে। যেখানে তিন বেলা সবার মুখে অন্ন তুলে দেওয়া অনিশ্চিত সেখানে শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেন বিলাসিতা। তবে তিনি এটি ঠিকই বুজেছিলেন, শিক্ষা কেবল দরিদ্র থেকে বের করে আমাদের সুন্দর জীবন দিতে পারে।

পেটে দুটো দানা পড়লো কি না পড়লো, সকাল-বিকাল বাবার সাথে কৃষি কাজে সাহায্য করা, গরু-ছাগল পালন করা,  বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা করা, সারা দিন কায়িক পরিশ্রম করার পর শরীরের ক্লান্তিকে দূরে রেখে তার সন্তানদের নিয়ে প্রদীপের নিভু-নিভু আলোয় ছেলেমেয়েদের বই নিয়ে বসাতে ভুলতেন না। অত্র গ্রামে অক্ষর জ্ঞান জানা বধূ হলো আমার মা। সবার চিঠি পড়ে শুনান এবং চিঠি লিখে দেয়া আমার মার ছিল নিত্য কাজের একটা অংশ।

মা হয়তো ভালো জামাকাপড় দিতে পারেননি, ভালো খাবার মুখে তুলে দিতে পারেননি, কিন্তু নীতি ও চরিত্র গঠনে কোনো কমতি রাখেননি আমাদের। সালটা ১৯৯৬ অথবা ১৯৯৭ হবে, বড় দাদা তখন ঢাকাতে BUET-এ পড়ে। মেজো দাদা বড় দাদার কাছে থেকে ঢাকাতে  কলেজে HSC পড়ে। কোনো এক ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি খোকসা থেকে ঢাকার পথে রওনার সময় মায়ের উপদেশ ছিল বড় সন্তানের নিকট "কঠিন সময়ে   ধৈর্য ধরো, ছোট ভাইকে স্নেহ এবং শাসনে রেখো, পথের মধ্যে ভিক্ষুককে সাধ্যমতো সাহায্য করো, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক"।

মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করা দিদি প্রত্যেকদিন স্কুল ও কলেজে একই জামা পরে যাওয়ায় বান্ধবীদের কটূক্তি, বড়দা টিউশন করে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া, মেজদার কুয়েটে যোগ্যতা অর্জন করার পরও অনিশ্চিত পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া, কুয়েট জীবনের প্রথম দিন থেকে টিউশনি খুঁজে বেড়ানো, এই মাসে টাকা পাঠাতে পারবো না বলে বাবার চিঠি, সেজদার RUET জীবনে ১০০ টাকায় পুরা মাস চলা, এই সব সংগ্রামের পিছনে শক্তি জুগিয়াছেন মা। কোনো কিছুই সামনে এগিয়ে যেতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

আমি আমার ভার্সিটি (MBSTU) জীবনে মাসে একবার মায়ের সাথে কথা বলতাম কি না ঠিক মনে নেই। মা শুধু একটা কথাই বলতেন, "ঈশ্বরের নামে তোমাদের ছেড়ে দিয়েছি, ঈশ্বরই তোমাদের দেখবেন"।  তখন বুঝিনি! এখন বুঝি মা আসলে আমাদের মাঝে দায়িত্ব আর আদর্শের বীজ বুনে দিয়েছিলেন, তাই হয়তো কখনো পথ হারা হয়নি আমরা।

সময়ের আবর্তনে আজ মা ৬৮ বছরের বয়স্ক কিন্তু তার ছোটবেলার পড়ালেখার আগ্রহ আজ ও বর্তমান। তিনি মুখে হয়তো কিছু বলেন না, তিনি তার কর্ম  আর জীবন দর্শন দিয়ে আমাদের সবসময় উপদেশ দিয়ে যান।

তখন নেপোলিয়নের প্রখ্যাত উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয় "তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব"।

ইতি

ছোট ছেলে

(ঢাকাটাইমস/০৬মার্চ/কেআর)