কোভিড সেরে ওঠা রোগীদের পরবর্তীতে তিন রোগের জটিলতা বেশি: গবেষণা

প্রকাশ | ২১ মার্চ ২০২৩, ১৫:৪৯ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৩, ১৬:১১

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

করোনভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের জটিলতার ঝুঁকিতে থাকে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষনা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) যৌথভাবে এই গবেষণা করেছে।

বিএসএমএমইউর ডি ব্লকের আইএনএম অডিটোরিয়ামে মঙ্গলবার এক সেমিনারে গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

‘লং টার্ম সিকুয়েল অফ কোভিড-১৯: অ্যা লংগিটুডিনাল ফলোআপ স্টাডি ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন হয়। এছাড়া সেমিনারে ‘লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন ফর ফিজিশিয়ানস’ শীর্ষক একটি নির্দেশিকাও উপস্থাপন করা হয়।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম পাঁচ মাসের ফলোআপের ফলাফল সম্প্রতি গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট রিজিওনাল হেলথ সাউথইস্ট এশিয়ার প্রকাশিত হয়।

এশিয়ার মধ্যে এটি প্রথম গবেষণা যেখানে দেখা যায়, করোনা থেকে সেরে ওঠা ভোগীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, যাকে পোস্ট-কোভিড-১৯ সিনড্রোম (পিসিএস) বা লং কোভিড হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএসএমএমইউর উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। যাদের করোনা হয়েছে আবার যাদের করোনা হয়নি তাদের নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।’

‘করোনার কারণে মানুষের স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। চোখের দৃষ্টি শক্তিতে প্রভাব ফেলেছে। হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলেছে। মানব দেহে বিদ্যমান রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের শারীরিক জটিলতা ও মৃত্যু ঝুঁকি তীব্র করেছে।’

করোনায় অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যু হার কম উল্লেখ করে বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার কেন কম তা নিয়েও গবেষণা হতে পারে। করোনা পরবর্তী রোগীদের অসুস্থতা থেকে উত্তরণের জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। কারণ গবেষণার মাধ্যমে রোগের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব। আবার রোগ প্রতিরোধের উপায়ও জানা যাবে।’

এসময় বিএসএমএমইউর সামগ্রিক গবেষণাখাতের মোট অর্থ বর্তমানে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বলেও তথ্য দেন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। অতীতে বিএসএমএমইউতে গবেষণায় দুই বা চার কোটি টাকার বেশি ছিল না বলেও তিনি জানান।

গবেষণায় যা উঠে এসেছে

সেমিনারে জানানো হয়, ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকায় দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৩৬২ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কোভিড-পরবর্তী তাদের জটিলতা নির্ণয় করার জন্য সেরে ওঠার ১ মাস, ৩ মাস এবং ৫ মাস পর ফলোআপ করা হয়। তাদের স্নায়ুবিক, হৃদযন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী সেরে ওঠা ব্যক্তিদের কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদযন্ত্রের জটিলতা (উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত হৃদকম্পন বা পা ফুলে যাওয়া) এবং স্নায়ুবিক (পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা হাত ও পায়ে অসাড়তা, ঝিমঝিম করা বা ব্যথা, স্বাদ ও গন্ধের অস্বাভাবিকতা) জটিলতা সম্ভবনা দ্বিগুণ।

এই রোগের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাবগুলোও নারী পুরুষ ভেদে পৃথক, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে কোডিড-পরবর্তী জটিলতার প্রকোপ দেড় থেকে চার (১.৫-৪) গুণ পর্যন্ত বেশি দেখা গেছে।

হাসপাতালে ভর্তিকৃত এবং নিবিড় পরিচর্যার  প্রয়োজন হয়েছিল এমন রোগীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার সম্ভাবনা হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া গেছে।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত গুরুতর কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের নিয়মিত ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করা সত্ত্বেও রক্তে অনিয়ন্ত্রিত শর্করার (ব্লাড সুগার) সম্ভাবনা যাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি তাদের তুলনায় ৯ থেকে ১১ গুণ বেশি ছিল এবং তাই যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তাদের বেশি ইনসুলিন প্রয়োজন হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল প্রতি এক হাজার জনে ১০ জন। একইভাবে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে নতুন করে কিডনিজনিত জটিলতা (হাই ক্রিয়েটেনিন এবং প্রোটিনিউরিয়া) এবং লিভারজনিত জটিলতা (বর্ধিত লিভার এনজাইন) উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল।

গবেষকরা যা বললেন

আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ গবেষণার ফলাফলের ওপর গুরুতারোপ করে বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ধরণ নির্ণয়ে এই গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু কেভিড-১৯. আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তারা যদি নিয়মিত ফলোআপ না করেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ না করেন তবে এই গবেষণার সার্থকতা ম্রিয়মান হয়ে যাবে।’

বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকদের জন্য লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন উপস্থাপন করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনের অনুপস্থিতি প্রায়শই সহজে নির্ণয় করা যায় না। ফলে কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করে। প্রস্তাবিত গাইডলাইন চিকিৎসকদের সর্বাধিক সাফল্যের সাথে রোগ সনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে সহায়তা করবে।

সেমিনারে অন্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ ও লাইন ডাইরেক্টর, সিডিসি) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম, বিএসএমএমইউর কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী মেশকাত আহমেদ এবং আইসিডিডিআরবির নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভি বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী এবং প্রধান গবেষক ডা. ফারজানা আফরোগজ, উএসএআইডির কর্মকর্তা সামিনা চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন।

অধ্যাপক ডা. মো. ফেরদৌস উর রহমান সঞ্চালনায় সেমিনারে শিক্ষক, চিকিৎসক, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

(ঢাকাটাইমস/২১মার্চ/এএ/ডিএম)