মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অবদান এবং শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর মাতৃসুলভ দৃষ্টি!

প্রকাশ | ২২ মার্চ ২০২৩, ২১:৩৮

ড. আব্দুল ওয়াদুদ, ঢাকাটাইমস

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে দেশের আপামর জনসাধারণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে দেয়। বস্তুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর দফায় দফায় বৈঠক ব্যর্থতার পর্যবেশিত হলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। জনগণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে মোকাবেলার জন্য রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।

২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক আকারে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লুটপাট শুরু করলে জাতির পিতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তান  আর্মি গণহত্যা শুরুর একদিন পরেই ইন্দিরা গান্ধী গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ এবং নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ৩১ শে মার্চ ভারতের লোকসভা বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানায়। ৪ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে বৈঠক কালে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। গণহত্যা শুরুর পরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, তা কেউ জানতো না।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক গণহত্যার মুখে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভার বহন করা ভারতের অর্থনীতির পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ ছিল। তবুও অকুতোভয়, দূরদর্শি, নেহেরু কন্যা, ইন্দিরা গান্ধী জাতি, ধর্ম এবং বর্ণ নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আশ্রয় চাওয়া সকল মানুষকে আশ্রয় প্রদান করে; এবং দীর্ঘ নয় মাস যাবৎ শরণার্থী শিবির খুলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু মুসলমানদেরকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তোলে ধরে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৈশাচিক গণহত্যার বিরুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, জনমত গঠনের জন্য। এ কারণে তৎকালীন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার নেহেরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি রুষ্ট হন। তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে, ভারতকে নানা রকম হুমকি দিতে থাকেন। তাছাড়া চীনের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক উষ্ণ থাকায় ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক, বিশেষ করে- স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষে কাজ করে যাওয়া অত্যন্ত দুরূহ এবং কূটনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে আমেরিকার মতো একটি পরাশক্তি প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের সমর্থন করলে এটি শীতল যুদ্ধে রূপ নেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। তারই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য সপ্তম নৌবহর পর্যন্ত বঙ্গপোসাগরে পাঠানোর পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের পথে হাটে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে মোকাবার জন্য ১৯৭১ এর আগস্ট মাসে তৎকালীন অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে ইন্দিরা গান্ধী বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য এনে নিজের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন।

৪ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধী এবং তৎকালীন জাতীয় নেতা তাজ উদ্দিন আহমেদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয় এবং কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের বিষয়টি সামনে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত সরকারের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ভারতের সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে তাজউদ্দিন আহমেদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

এখন প্রশ্ন থাকতে পারে ভারত কেন এত দ্রুত বাঙালিদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সমর্থন দিল। এর প্রধান কারণ ছিল ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরে ভারত-পাকিস্তান বৈরী সম্পর্ক, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ক্রমাগত সীমান্ত সমস্যা, তাছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশ ভারতের দুই পাশে অবস্থিত হওয়ায় ভারতের পক্ষে দুটি সীমান্তে সমানভাবে নজরদারি করে চীনের মতো একটি বৈরী শক্তিকে মোকাবেলা করা অত্যন্ত দূরূহ ছিল। রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে ভারতের সামনে এমন একটি সুযোগ আসায় এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন শুরু হওয়ায়, ভারতের পক্ষে এমন একটি পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না।

জুলাইয়ের শেষদিকে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা চীন সফর করলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিচারের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের লোকসভা এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অনভিপ্রেত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং বিশ্ব জনমত গঠনে ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন সরকার প্রধানদের কাছে চিঠি দিয়ে এই প্রহসনমূলক বিচার বন্ধের দাবি জানান।

অবশেষে আকস্মিকভাবে ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসে। এমন একটি সুযোগ তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী হাতছাড়া করেননি। ভারত পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করে। এই যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়, মুক্তিবাহিনী এবং বাংলাদেশের জনসাধারণ। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ক্ষমতা তছনছ হয়ে যায়। পরবর্তীতে যৌথ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল ইতিহাস রচিত হলে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অবদানকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে যে কোনো মূল্যে মুক্ত করে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। তিনি রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। এমনকি ভুট্টো যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বিচার করার প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে না পারে, তার জন্য শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছিলেন। শোষণ ও বঞ্চনার বিপরীতে একটি শোষণহীন সমতা ভিত্তিক সমাজ ও রাস্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তার সরকারের গৃহীত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকা অবস্থায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর একটি উশৃঙ্খল অংশের আক্রমণে ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট তিনি পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে নিহত হন। ইতিহাসের বর্বরোচিত এই রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জার্মানি থেকে তার দুটি সন্তান জয় এবং পুতুলকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ নামমাত্র সংগঠনে পরিণত হয়, এবং অনেকেই পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য মোস্তাক সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এমতাবস্থায়, শ্রীমতি গান্ধী শেখ হাসিনা এবং তার সন্তানদের পরম স্নেহে ভারতে অবস্থান এবং লালন পালনের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ক্ষমতার পালাবদল এবং নানাবিধ টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আজকে একটি উচ্চতর পর্যায়ে এসে পৌছেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের নির্মম সত্য এটাই যে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ নিজ দেশের ঘাতকদের হাতে নিহত হয়ে রক্তে ভেজা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি সরূপ বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতা সম্মাননা প্রদান করেছে। ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বাংলাদেশের এমন স্বীকৃতি দুদেশের সম্পর্ককে আরো আস্থাশীল এবং গভীর করেছে।অমর হোক এই দুই ঐতিহাসিক নেতা, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের জীবনের এবং দেশের মানুষের দুর্দশাকে লাঘবের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

শেখ হাসিনা চিরজীবী হোক।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

প্রেসিডিয়াম সদস্য– বঙ্গবন্ধু পরিষদ, প্রধান পৃষ্ঠপোষক- বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞানের সমিতি।