বাইরে ঐক্য দেখালেও জাতীয় পার্টির ভেতরে ‘দ্বন্দ্ব’

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২৩, ০৮:২৫

জাহিদ বিপ্লব, ঢাকাটাইমস

ওপরে ওপরে ঐক্যের কথা বলা হলেও জাতীয় পার্টিতে (জাপা) নেতৃত্ব নিয়ে রওশন এরশাদ ও গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। দলীয় নানা কর্মসূচিতে তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও দুজনে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন।

নেতারা বলছেন, নেতৃত্ব নিয়ে দেবর-ভাবির মাঝে কোনো সমাঝোতা হয়নি। ওপরে ঐক্যের ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব আছে। যার প্রকাশ ঘটছে নানান ভাবে। তারা মনে করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এ দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকবে। হয়ত, সরকারই এ দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখছে তাদের স্বার্থে।

সর্বশেষ ২০ মার্চ জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ৯৩ তম জন্মবার্ষিকী পালনকে কেন্দ্র করে আবারও তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। সেদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে জন্মবার্ষিকীর একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও রওশন এরশাদ তার পন্থীদের নিয়ে আয়োজন করে পৃথক অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে জাপা থেকে বহিষ্কৃত মসিউর রহমান রাঙা এবং জাপায় জিএম কাদেরের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করা জিয়াউল হক মৃধাসহ পার্টি থেকে বাদ পড়া নেতারা অংশ নেন।

শুধু তাই নয়, সেদিন আলাদা প্রোগ্রামে জিএম কাদের বর্তমান সংবিধানে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করলেও রওশন এরশাদ বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচনে যাবে জাতীয় পার্টি।

মূলত, সেদিন তাদের মধ্যকার বিভাজন ও দ্বন্দ্ব আবারও দৃশ্যমান হয়ে উঠে। গুলশানের নিজ বাসভবনে অনুষ্ঠিত প্রয়াত এরশাদের দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে রওশনপন্থীরা ছাড়াও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু এমপি, এসএম ফয়সল চিশতি, নাজমা আকতার এমপি, ভাইস চেয়ারম্যান রওশন আরা এমপিও উপস্থিত ছিলেন।

জাপা নেতারা বলছেন, সরকারের মধ্যস্থতায় জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদ একসঙ্গে বসলেও কোনো সমঝোতা হয়নি। সমাঝোতা হলে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠজন জিয়াউল মৃধার মামলা কেনো প্রত্যাহার হলো না? রওশন এরশাদ বিগত কয়েকমাসে ৩৫টি জেলায় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করেছেন, কেনো তা বিলুপ্ত হলো না? রওশন এরশাদ পার্টি থেকে বাদ পড়া নেতাদের পুনর্বহাল করার কথা বললেও কেনো পুনর্বহাল হয়নি?

যদিও বিরোধীদলীয় নেত্রী ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই দাবি করে ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমাদের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

যে জিয়াউল হক মৃধা জিএম কাদেরের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছেন তাকে নিয়ে আপনি প্রোগ্রাম করলে আপনাদের মধ্যকার ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠতে পারে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেদিন জিয়াউল হক মৃধা উপস্থিত ছিলো কিনা আমি লক্ষ্য করিনি।

জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। একসময়ের মহাসচিব ও সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে এবং দলটির উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে পৃথক দুটি নালিশি মামলাও হয় ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে।

মূলত, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই দলের নেতৃত্ব নিয়ে দেবর-ভাবির লড়াই শুরু। এরপর পার্টির জাতীয় কাউন্সিলে পদ হারান জাপার বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। এরপর নানা কারনে বহিষ্কার হন অনেকে। তারাও রওশন এরশাদকে আশ্রয়স্থল মনে করে একত্রিত হতে থাকেন।

২০২১ সালে ৫ নভেম্বর সংকটাপন্ন অবস্থায় রওশন এরশাদ ব্যাংককে চিকিৎসার জন্য গেলে তখন জাতীয় পার্টি থেকে তার কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি বলে দেশে এসে অভিযোগ করেন তিনি। সেসময় জাতীয় পার্টি থেকে বাদ পড়া নেতারা নিয়মিত রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আর তখনই বহিষ্কৃত ও পার্টি থেকে বাদ পড়া নেতারা একত্রিত হতে থাকেন। এরমাঝে ২৮ জুন ব্যাংকক থেকে সংসদে যোগ দেন। নিজ অনুসারীদের নিয়ে গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে মতবিনিময় সভা করেন। জিএম কাদেরপন্থিরা এতে যাননি।

কিন্তু দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বের বিস্ফোরণ ঘটে রওশন এরশাদের একটি চিঠিতে। হঠাৎ করেই গত ৩১ আগস্ট তিনি চিঠি দিয়ে নিজেকে আহ্বায়ক এবং নিজের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহকে সদস্যসচিব করে জাতীয় পার্টির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করে দলের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকেন ২৬ নভেম্বর।

তাঁর এই ঘোষণা যেন দলের মধ্যে স্তূপকৃত বারুদে  দিয়াশলাই ছুড়ে মারে। জাতীয় পার্টি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিবৃতিতে জানায়, সম্মেলন আহ্বান ও আহ্বায়ক কমিটি গঠনের ঘোষণার এখতিয়ার নেই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের। তার চিঠি অবৈধ, অনৈতিক ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। দলের পক্ষ থেকে ওই চিঠি প্রত্যাহারের জন্য রওশনকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তা আমলে না নেওয়ায় জাপার পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে রওশনকে অব্যাহতি দিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করা হয়। সেই সিদ্ধান্তের কথা যথারীতি চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে। কিন্তু দুই মাস অতিক্রান্ত হলেও স্পিকারের কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে গত ৩০ অক্টোবর জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বে কয়েকজন এমপি স্পিকারের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা জি এম কাদেরকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশের দাবি জানান। কিন্তু স্পিকার তা করেননি।

এরইমধ্যে গুলশানে আলাদা পার্টি অফিস নেন রওশন অনুসারীরা। ২৩ নভেম্বর রওশন এরশাদ দেশে ফিরলে দৃশ্যপট অনেকটা পাল্টে যায়। পার্টির শীর্ষনেতারা একে একে দেখা করতে আসেন রওশন এরশাদের সঙ্গে। পরবর্তীতে সংসদে রওশন এরশাদের ডাকা সভায় পার্টি থেকে এমপিদের যেতে বারণ করলেও সিংহভাগ এমপি সেখানে উপস্থিত হোন।

এরই মধ্যে ৩০ অক্টোবর রওশনপন্থী বলে পরিচিত জাপা থেকে বহিষ্কৃত জিয়াউল হক মৃধা জিএম কাদেরের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে রিট করলে আদালত তার দলীয় কার্যক্রম চালাতে নিষেধাজ্ঞা দেন। এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সরকারের মধ্যস্থতায় ৯ ডিসেম্বর একযৌথ ঘোষণায় রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের জানান, জাতীয় পার্টিকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চান। 

জাতীয় পার্টিতে বিভক্তি ও নেতৃত্বের বিরোধ নিয়ে যখন সরব আলোচনা চলছে তখন যৌথ ঘোষণার কপি সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

পাঠানো বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির বিভক্তি সম্পর্কিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরকে বিভ্রান্তিকর বলে দাবি করে তারা বলেন, আমরা দুজনই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের প্রয়াত নেতা পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বদ্ধপরিকর। এ যৌথ বিবৃতির পরও প্রায় দু'মাস জিএম কাদেরের কার্যক্রম আদালতের নির্দেশে স্থগিত থাকে।

জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলীয় সাংসদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এ দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়। হয়ত, সরকারই এ দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখছে তাদের স্বার্থে।

জাতীয় পার্টিতে (জাপা) ঐক্য আছে দাবি করে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমাদের মাঝে কোনো ভাঙন নেই। বহিষ্কৃতরা কী করল না করল তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। পার্টির মধ্যে একই দিনে একই বিষয়ে আলাদা অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উনি (রওশন এরশাদ) যা ইচ্ছে করুক। উনাকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। তাই কিছু বলতে পারি না।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমার মনে হয় ম্যাডাম এগুলো কিছু করছে না। কিছু লোক তাকে দিয়ে এগুলো করার চেষ্টা করছে। আর যারা নামবিহীন তাদের কথা বলে লাভ নেই।

বিভিন্ন জেলা কমিটি অনুমোদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাস্তার লোক যদি কমিটি দেয় আমরা কী করব?

জাতীয় পার্টিতে ঐক্য প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং রওশন ঘোষিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমি ঐক্যের বিষয়ে আশাবাদী। জাতীয় পার্টিতে অনেক ত্যাগী ও অবহেলিত নেতাকর্মী আছেন। তাদের সমম্বয় করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি সময়ের দাবি।

জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বিরোধীদলীয় নেতার মুখপত্র কাজী মামুনুর রশীদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ঐক্যের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে আসেনি বা ঐক্যের কোনো আবহাওয়া বিরাজ করছে বলে মনে হয় না। তবে, আমরা আগেও ঐক্য চেয়েছি এখনো চাই।

(ঢাকাটাইমস/২৪মার্চ/জেবি/ইএস)