বৈশ্বিক নেতৃত্বের কেন্দ্রে আসছে চীন

প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০২৩, ১৭:২৬

অলোক আচার্য

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কেন্দ্র করে শুরু থেকেই পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। কেউ সরাসরি রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের বিপক্ষে আবার কোনো কোনো দেশ সরাসরি বিরোধীতা করেনি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে গত কিছুদিন উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই উত্তেজনা মাঝে মাঝে তীব্র আকারে পৌছে যায়। কিন্তু কোনোভাবেই যে অস্থিরতা কমছে না সেটাই মাঝে মধ্যে বোঝা যায়। মাত্র কয়েকদিন আগেই, চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন শি জিনপিং। তার সময়েই চীন অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। বিশ্বে প্রতিযোগীতায় ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে এবং কূটনৈতিক সাফল্য পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

বর্তমান প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বে শক্তিশালী কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দুই দেশের উত্তেজনার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা তাইওয়ান ইস্যু, সাম্প্রতিক বেলুনকান্ড এবং বিভিন্ন অঞ্চলে নিজের বিস্তার বিষয়ক দুরত্ব দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে। এসবের মধ্যে তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ মূল দ্বন্দ্বের কারণ। এরই মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিশ্লেষকদের মতে, চীনের সামরিক প্রভাব কমাতে অষ্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন দিতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন চীনের সাথে অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নেতারা সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি নতুন নিরাপত্তা চুক্তি সই করেন।

মূলত অকাস জোটের নতুন চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন তিনটি সাবমেরিন কিনবে অষ্ট্রেলিয়া। প্রশান্ত মহাসাগরের আশেপাশে যেখানে চীনের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে বলে অষ্টেলিয়া মনে করছে সেখানে নজরদারি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। ডিজেল চালিত সাবমেরিনের চেয়ে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন এতটাই অত্যাধুনিক যে এটি শত্রুপক্ষের চোখ অনায়াসেই ফাঁকি দিয়ে গভীর সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকতে এবং চলাচল করতে সক্ষম। ২০২১ সালে এই তিন দেশ অকাস চুক্তির ঘোষণা দেয়। যার আওতায় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার যুদ্ধের সরঞ্জামবিষয়ক সহায়তার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়, এই জোট গঠনের অন্যতম লক্ষ্য হলো দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে।

অকাসে থাকা দেশত্রয়ী ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও সামরিক উপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সবশেষ পারমাণবিক সাবমেরিন প্রযুক্তি বিনিময় করেছিল ১৯৫৮ সালে। এর কয়েক দশক পেরিয়ে গেছে। পৃথিবীতে এখন অস্ত্রের খেলা। অস্ত্র বিক্রি সবচেয়ে বড় ব্যবসা। আর পৃথিবীতে মাত্র ছয়টি দেশের হাতে পারমাণবিক সাবমেরিন আছে। দেশগুলো হলো, যুক্তরাষ্ট্র,রাশিয়া,চীন,ব্রিটেন,ফ্রান্স ও ভারত। বর্তমান সময়ে চীন নতুন এক সময়ে প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তীব্র প্রতিযোগীতার মুখোমুখি হচ্ছে। মূলত একক নেতৃত্বের বিষয়টি এখন থাকছে না। স্নায়ুযুদ্ধ এখনও চলছে। তবে তার রুপটা একটু ভিন্ন।

মাত্র কিছুদিন আগেই, চীনের বেলুনকান্ড বিশ্বে মোটামোটি ভালোই উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। এই দুই দেশ গত কয়েক বছর ধরেই তীব্র প্রতিযোগীতাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। অস্ত্র,ব্যবসায়-বাণিজ্য,কূটনীতিসহ প্রতিটি বিষয়েই এই দ্বন্দ্ব বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্ব কতটা উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে কিছুদিন আগেই তার প্রমাণ দিয়েছে আকাশে ওড়া বেলুন। এই বেলুন আমাদের পরিচিত কোনো সাধারণ বেলুন না। সে কারণেই বাগযুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বাকযুদ্ধই নয়, তীব্র উত্তেজনাও সৃষ্টি হয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। আর কৌশলগতভাবে ভারত ও অষ্ট্রেলিয়া কাছাকাছি এসেছে। বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে একে অপরের সাথে।

বিশ্বে এখন চলছে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার এক ধরনের প্রতিযোগীতা। শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে এক দেশ অন্য দেশের কাছাকাছি আসছে, সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে সমমনা দেশগুলো একে অপরের ঘনিষ্ট হচ্ছে এবং এর ফলে বিশ্ব ক্রমশই দুই বা ততোধিক বলয়ে বিভক্ত হচ্ছে। প্রতিযোগীতাপূর্ণ বিশে^ শক্তিধর দেশগুলো স্বাভাভিকভাবেই নানাভাবে উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সেই উত্তেজনার পারদ এমনিতেই অনেক উপরে উঠে আছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে ফিরেছে শান্তির সুবাতাস। মধ্যপ্রাচ্যের দ্বন্দ্বের দুটি দেশ সৌদি আরব ও ইরান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে একমত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের ঘনিষ্ট মিত্র হলেও ইরানের সাথে গত কয়েক বছর ধরেই সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। এই সম্পর্ক স্থাপনের ফলে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলা ইয়েমেনের যুদ্ধ এখন শান্তিতে রুপ নিতে পারেন বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আর এর পেছনে রয়েছে চীন। অর্থাৎ চীন এই সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতা করে নিজের মধ্যপ্রাচ্যে উপস্থিতি জানান দিয়েছে। এখানে চীনের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য বিশ^ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ন। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের প্রভাব রয়েছে। জ্বালানির তীব্র সংকটে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি বিশ্বে সরবরাহ করা হয়েছে। চীনের এই মধ্যস্থতার সাফল্যের পর চীনকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্কের বিষয়েও কিছু করতে পারেন এমন আশাই করা হচ্ছে।

এর আগে জানা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল বা মে মাসে রাশিয়ায় সফরে যেতে পারেন চীনের প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের ওই সফর খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে কারণ বিশ^ এখন চাইছে এই যুদ্ধ বন্ধ হোক। যদি চীন সৌদি আরব ও ইরানের মতো কোনো ম্যাজিক্যাল কিছু করতে পারে তাহলে চীন প্রতিযোগীতায় কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকবে এটা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ভূমিকা যখন জোরালো হতে শুরু করবে তখন সেখানে আরও প্রতিযোগীতা শুরু হবে। এতিদন যুক্তাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র সৌদি আরব এবং রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্টতা রয়েছে ইরানের।

সুন্নি ও শিয়া অধ্যুষিত দেশ দুটি চুক্তিতে আসায় ওই অঞ্চলে শান্তির বাতাস বইছে। যদিও চুক্তির পর তাৎপর্যপূর্ণ হলো চুক্তির বাস্তবায়ন করা। এর আগে চীন ইউক্রেনে শান্তি আনার জন্য ১২ দফা প্রস্তাব উত্্থাপন করেছিল গত মাসে। যদিও পশ্চিমা দেশগুলো তা নাকচ করে দেয়। প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সামরিক ও কূটনৈতিক কৌশল কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশ ওপরের দিকে উঠে আসতে চাইছে যার মধ্যে চীন অন্যতম দাবীদার। ক্ষমতা বলতে বোঝায় আর্থিক সামর্থ্য,রাজনৈতিক দূরদর্শিতা,প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন যা অন্য দেশের থেকে এগিয়ে থাকে এবং উন্নত অবকাঠামোর সমন্বয়। পৃথিবীজুড়ে বহু বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

বর্তমান সময়ে চীনের দক্ষ কূটনীতি এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। এরই মধ্যে হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চীনের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন। এতদিন হন্ডুরাস তাইওয়ানের মিত্র বলে পরিচিত ছিল। সেক্ষেত্রে তাইওয়ানের সাথে সরাসরি আগের মতো মিত্রতা ধরে রাখা হয়তো সম্ভব হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বুহুদিন রেষারেষি থাকলেও করোনার উৎস নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং সেই উত্তেজনার পর বিশে^র মনোযোগ ঘুরে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। এর মধ্যেই তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারপর হঠাৎ বেলুনের আবির্ভাব ঘটে এবং আলোচনার জন্ম দেয়। চীন যদি তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বসে থাকবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে চীন বিশ্বে নেতৃত্ব এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে এই প্রতিযোগিতা আও তীব্র হবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, পাবনা।