৫৩তম স্বাধীনতা দিবসে আমরা কেমন আছি?

প্রকাশ | ২৬ মার্চ ২০২৩, ১১:০৯

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ

আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধা সকল শহীদদের স্মরণে।  স্মৃতি বিজড়িত এই দিনটি শুধু নয় ১০ মাস যুদ্ধের মধ্যে কাটিয়েছিলো বাংলাদেশ। শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধান চেয়েছিলো বাঙালি।  ধৈর্য্যের এক চরম পরীক্ষা দিয়ে আমরা পার করছিলাম পাকিস্তানিদের শুভ বুদ্ধির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় । কিন্তু সেদিন তারা আমাদের দাবি মেনে নিতে পারেনি।  ১৭৫৭ সালে মীরজাফরের বেইমানি আমাদের মুক্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছিল ইংরেজ বাহিনী।  ১৯৪৭ সালে আবার আমরা বন্দি হই  আরেক ছলনা জালে। নতুন করে শুরু হয় সংগ্রামের। সেই সংগ্ৰামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৯৭৫ সালে আমরা নতুন ধরণের পরাধীনতার মুখোমুখি হই। আরেক মুক্তি আসে ১৯৯০ সালে গণ অভ্যুর্থানের মধ্য দিয়ে। তবুও যেন সংগ্রামের শেষ নেই। আজ ২০২৩ সালে এসে আমাদের নতুন সংগ্রাম।মানুষ ভীষণ কষ্টে আছে।  নীরবে সহ্য করছে সেই কষ্ট।  মীরজাফর বাংলার বুকে যুগে যুগে আসে।  আজকের মীরজাফর টাকা পাচারকারী, আজকের মীরজাফর ব্যাংক ঋণ খেলাপি।  আজকের মীরজাফর ওই পাচারকারী -ঋণ খেলাপির দোসর। 
 
তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা একান্ত জরুরি স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে।  আরবের তপ্ত মরুতে, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে কিংবা শীতল বরফ মাড়িয়ে অর্জিত টাকা কিভাবে পাচার হয়েছে তা আমাদের সকলে জানা।  কিন্তু তাদের বিচারের আওতায় আনবার প্রক্রিয়াটা ধীর ও অস্পষ্ট বিধায় জনমনে সংশয়। সেই সংশয় দূর করা সরকারের দায়। সমাজে যারা চেয়ার এ আছেন তাদের দিকে তাকিয়ে আপমর  জনতা। 

১৯৭১ সালে যেই সুযোগ পেয়েছে সেই লুটপাট করেছে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের সম্পত্তি। সেই সাথে লুটপাট হয়েছে হিন্দুদের সম্পদ।  দেশ স্বাধীন হয়েছে, অসাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে স্থান পেয়েছে কিন্তু সুযোগ পেলে একটি মহল তাদের উপর আগ্রাসী হয়। জনসেবার মানসে যারা সরকারি পদে আছেন তাদের কর্মকান্ডে জনমনে সংশয় ও হতাশা সৃষ্টি করছে। চারিদিকে এতো বিশৃংখলা যে, সেই হতাশা ও সংশয় আরও গভীরে প্রবেশ করছে। 

ভালো একটি রাজনৈতিক পরিবেশ আমরা আজও অর্জন করতে পারিনি।  ফলে সব সময় একটি সংশয় জাতিকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা হারিয়েছি  অনেক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংগ্রামে আরও বেশি যেন হারিয়েছি আমরা।  দুর্নীতির সংগ্রামে লড়াই করে ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সালে আমাদের হারাতে হয়েছে ৫৭ জন সামরিক কর্মকর্তাকে।  কিন্তু দুর্নীতিকে আমরা এখনও হারাতে পারিনি। এভাবেই কি এক অপূর্ণ সংকুচিত স্বাধীনতা আগামী প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে? 

আমরা যে অফুরন্ত স্বাধীনতা চাই তার জন্য জাতিকে  হয়তো আরও সংগ্রাম করতে হবে। আমাদের মাঝে নানা প্রবণতা আছে যা আমাদের স্বাধীনতাকে সংকুচিত ও কণ্টকিত করছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কতৃত্ববাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ।  সরকারি কর্মকর্তা বা যাদের চেয়ার আছে তাদের অনেকের মাঝে ক্ষমতা প্রদর্শনের নিষ্ঠূর মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা যে যথাযথ হয়নি তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। সেজন্য শিক্ষক হিসেবে সামান্য হলেও দায়ভার আমাকেই নিতে হবে। 

সরকার স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেখানে আছে বেশ কিছু ব্যর্থতা। বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরেও নাগরিককে যথাযথ সন্মান প্রদর্শনে শাসকরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অর্থবহ স্বাধীনতার চিন্তা থেকে অবরোধবাসিনী মাতৃকুলকে বিভিন্ন ভাবে সরকার থেকে সম্মান দেয়া হলেও তাদেরকে আক্রমণ করা হয়েছে বা তাদের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে।  আমাদের মাঝে অপরকে দাসে পরিগনিত করবার মানসিকতা বেড়েছে। বুদ্ধিজীবী মহল থেকে ন্যায্যতার অভাব ধ্বনিত হচ্ছে। সরকার কেবল যেন প্রশংসা শুনে চায় যদিও তারা মুখে বলে গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। সমালোচনা করলে খুবই ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু বাস্তবতাকে না বলতে দিলে  স্বাধীনতা কি অর্থবহ হতে পারে? বঙ্গবন্ধু নিজেই আত্ম-সমালোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে অনেক কথা বলেছেন যা আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে জানতে পারি।
 
সমকাল পত্রিকায় এসেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুরমান আলী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরি হারিয়ে এখন উবার চালক। তেমনি উপাচার্যদের রোষানলে পড়ে অবিচারের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকেই চাকরি হারিয়েছে বিগত দিনগুলোতে। অনেকেই বাধ্য হয়েছে চাকরি ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিতে।  

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক সহকর্মী উপাচার্যের রোষানলে পড়ে প্রায় দেড় বছর সাময়িক বরখাস্ত আছেন। বিচারের নামে কেবল কালক্ষেপণ চলছে। আর যিনি এই প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেছেন তিনি রাজনৈতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। শতবর্ষের ইতিহাস ভেঙে নতুন দুর্নীতির ইতিহাস গড়ছেন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক। এরকম একটি বেদনার পরিবেশে আমরা উদযাপন করছি ৫২তম স্বাধীনতা দিবস।

আজ যদি আমাদের বিচার চাইবার জায়গা থাকতো তবে কয়েক কোটি অভিযোগের পাহাড় সৃষ্টি হতো সরকারি দপ্তরগুলোর অনাচারের বিবরণ দিতে।  বিচার চাইবার জায়গা যেমন সংকুচিত হয়েছে, তেমনি সংকুচিত হয়েছে স্বাধীনতা। 

সেদিন পড়ন্ত বিকেলে এক অফিসে গিয়েছিলাম নারী নির্যাতনের একটি অভিযোগ নিয়ে যখন মিডিয়া উত্তাল এক জেলা জজ ও এক জেলা প্রশাসকের কর্মকাণ্ডের সমালোচনায়। তিনি খুব সুন্দরভাবে বললেন, স্যার আপনার সমস্যার সমাধান করতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না, তবে যদি আপনি উপর থেকে একটু লিখিয়ে আনতে পারেন। তিনি ক্ষমতাবান, তবে ক্ষমতা প্রয়োগে স্বাধীন নন! 
এর আগে আমি গিয়েছিলাম জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে। তারা ঘটনাটি শুনে বলেছেন সেটা মানবাধিকার লংঘন। এর পরে গিয়েছিলাম অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে। সেখান থেকেও জেনেছি যে বিষয়টি মানবাধিকার লংঘন। বিচারকরা বলেছেন আইনের লঙ্ঘন। বিষয়টি মন্ত্রীকে পর্যন্ত অবহিত করেছি। কোনো উত্তর মেলে নি। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে মন্ত্রীদের অসহায় অবস্থাও দেখি। আর এসব যেন গা সহা হয়ে যাচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে এরকম অসহায় জীবন যাপনেই কি তবে আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে? স্বাধীনতা দিবসে এমন একটি প্রশ্ন না করে হয়তো নীরবে থাকতে পারতাম। কষ্টের মাত্রাটা এতো বেশি যে নীরবে সহ্য করবার ক্ষমতাটুকু হারিয়েছি আজ । পাঠকের কাছে তাই ক্ষমা চাই।   

পাড়ার সবজি ওয়ালা বলে, আমরা জিনিসের দাম বাড়াই না ওই আড়তে বাড়ানো হয়েছে। ৩০-৪০ টাকার শসা ১০০ টাকা। যেখানে এক হালি লেবু ১০ টাকা সেখানে একটি লেবু ১০ টাকা। রোজার মাসে মুসলিম হয়ে এভাবে যারা দাম বাড়াতে পারে সেখানে জনগণ-সরকার অসহায়। কে পারে রুধিতে ওই সিন্ডিকেটকে? আমরা মুখে বলি বঙ্গবন্ধুর কথা, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, যে নীতি নৈতিকতার কথা বলেছেন তা কি করছি? বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করে যারা মন্দ কাজ করছে তাদেরকে কি সরকার চিনতে পারছে না? 

মুক্তিযুদ্ধ দেখা একটি মানুষ আমি। আমাকে এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কি তবে বাকি জীবনটা পার করতে হবে? ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হলে দেশ বিচারহীনতার দায় থেকে মুক্তি পাবে। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, আমরা কি সেই অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেছি?

গণজাগরণ মঞ্চের এক নেতার সঙ্গে দেখা। জানতে চাইলাম কেমন আছেন? বললেন করুন এক কাহিনী। শক্ত একটি কথা বললেন: লাশ হয়ে বেঁচে আছি।  ঋণে জর্জরিত! আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। মানুষ কাঁদছে- রোজার মাসে যেভাবে জিনিস পত্রের দাম বেড়েছে, আমার বলবার ভাষা নেই। লিখে কী হবে, কে শুনবে? স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হয়তো আরও এক সাগর রক্ত দিতে হবে।  আশার ভেলা ভাসিয়ে মহাসমুদ্রের মাঝে স্বাধীনতার সন্ধানে আমরা সবাই। 


পুলিশ ঘুষ খায় বলেছে বিধায় চিত্রনায়িকা মাহিকে ওমরাহ হজ থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করে। বাক স্বাধীনতা আছে মানে মাহি ঢালাওভাবে বলতে পারেন না পুলিশ ঘুষ খায় সামাজিক মিডিয়াতে। তেমনি গাজীপুর পুলিশ যেভাবে বিমানবন্দরে এসে গ্রেপ্তার করেছে বা তাকে রিমান্ডে নেয়ার দাবি করেছে সেটাও যুক্তিযুক্ত হয়নি। একজন প্রেগন্যান্ট মহিলাকে কীভাবে বিবেচনা করতে হবে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। আদালত জেলে পাঠিয়ে দিয়ে যে ভুল করেছিল সেটাকে সংশোধন করে জামিন দিয়েছে। আদালত সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা আছে। সেটা থেকে উত্তরণের চেষ্টা যে নেই তা আমি বলছি না। তবে আইনের সুস্পষ্ট লংঘন দেখেও জনগণ আদালতে যেতে সাহস পায় না। কারণ, আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। স্বাধীনতা দিবসে এমন একটি কথা বলে আপনাদের স্বাধীনতার আনন্দকে আমি সীমিত করে দিচ্ছি কি? এরকম একটি পরিবেশ আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে দেয় নাকি? দার্শনিক মিল বলেছেন, অসুখী সক্রেটিস হওয়া ভালো সুখী শুকর থেকে। আর এসব বিবেচনায় আমি সক্রেটিসের ‘অন্যের ক্ষতি করো না’ নীতিটিকে মনে করি উপযুক্ত সামাজিক আদর্শ- অর্থপূর্ণ স্বাধীনতার মূল নীতি।  আমাদের সবার ভাবা উচিত, আমার কাজের দ্বারা অন্যের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিনা। 

ফরিদ আহমেদ, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।