জালিয়াতির মাধ্যমে পিজিসিবিতে চাকরি: তিনজনের নামে দুদকের মামলা

প্রকাশ | ২৯ মার্চ ২০২৩, ১৭:৪৭

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া সনদপত্র তৈরি করে 'চাকরি নেওয়ার অভিযোগে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) জুনিয়র তড়িৎবিদ মো. শামছুর রহমানসহ তিনজনের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বুধবার দুপুরে দুদকের সদরদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। 

মামলার অপর দুই আসামি হলেন- বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানার পাঁচ নম্বর কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্য্যাডভোকেট সালাউদ্দিন জোয়াদ্দার মামুন।

দুদক জানায়, ২০১১ সালের ২৭ জুন থেকে ২০১৩ সালের ১২ মে পর্যন্ত অসৎ উদ্দেশে অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার অভিপ্রায়ে পরস্পর যোগসাজসে প্রতারণা, জালিয়াতি ও অসদাচরণের মাধ্যমে প্রকৃত জন্ম তারিখ গোপন করে ভুয়া বয়স সম্বলিত সনদপত্র তৈরি ও ব্যবহার করে 'টেকনিক্যাল অ্যাটেনডেন্ট' পদে ঢাকায় পাওয়ার গ্রীড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের চাকরির ব্যবস্থা করা ও চাকরি নেওয়ার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় শান্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছেন। তাই দুদকের সহকারী পরিচালক জি এম আহসানুল কবীর বুধবার ঢাকার সজেকা-১ এ একটি মামলা করেছেন।  মামলা তদন্তের সময়ে অন্য কারোর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুদকের মামলার প্রধান আসামি মো. শামছুর রহমান ১৯৯০ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানার বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ওই বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শিক্ষা (নবম-দশম শ্রেণি) এর ১৯৯৩-১৯৯৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। তার কোনো শিক্ষা বিরতি ছিল না। তিনি ১৯৯৫ সালে ওই বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে যশোর বোর্ড থেকে প্রথম শ্রেণিতে এসএসসি পাস করেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিমিটেডের  (পিজিসিবি) বিভিন্ন প্রকল্পে ‘কাজ নাই, বেতন নাই' ভিত্তিতে গাড়িচালক পদে চাকরি করেন। চট্টগ্রামের জিএমডি উত্তরের পিজিসিবি'র দপ্তরে ড্রাইভার পদে যোগদান করার সময়ে তিনি জীবন-বৃত্তান্তের সাথে এসএসসি পাসের সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দেন।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তার দেওয়া প্রতিটি ডকুমেন্টে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ ছিল ১৯৮০ সালের ২৪ জুন। পিজিসিবির প্রকল্পে কর্মরত থাকাবস্থায় গত ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পিজিসিবির রাজস্ব খাতের 'টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্ট' পদে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ওই বিজ্ঞপ্তির আলোকে তিনি গত ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি ওই পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। ওই পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পাস। আর সাধারণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩০ বছর। কিন্তু ওই তারিখে মো. শামছুর রহমানের বয়স ৩০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় তিনি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার সাহাপুর আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি  পাসের একটি ভুয়া সনদপত্র দিয়ে পিজিসিবিতে চাকরির জন্য আবেদন করেন। ওই সনদপত্রে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ ছিল ১৯৮২ সালের ২৪ জুন।  পরবর্তীতে পিজিসিবির নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় গত ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল তার নামে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়। নিয়োগপত্রের নির্দেশনা মোতাবেক তিনি  ওই বছরের ১২ মে পিজিসিবির জিএমডির ঢাকার কেন্দ্রীয় দপ্তরে টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্ট পদে যোগদান করেন। ওই পদে যোগদানের পর প্রত্যেক পিজিসিবির টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্টদের স্ব স্ব কর্মস্থল থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করা হয়। ইতোমধ্যে মো. শামছুর রহমান তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুজ্জামানের কাছ থেকে ২০১১ সালের ২৭ জুন  তারিখের স্বাক্ষরে ১৯৯৪ সালে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের একটি ভুয়া সনদ সংগ্রহ করেন। তিনি ২০১৩ সালের  ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম পূরণ করে তার কর্তৃপক্ষ বরাবর দাখিল করেন। পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টমশ্রেণি পাস উল্লেখ করলেও বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেন বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আর বিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত সনদপত্র পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দাখিল করেন। অর্থাৎ তিনি চাকরির মূল আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত সাহাপুর শহীদ আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটির তথ্য পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমে গোপন করে পরিকল্পিতভাবে বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নেওয়া নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ সংযুক্ত করেন। তার মূল আবেদনপত্র পিজিসিবির প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষিত থাকায় এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়াটি তার কর্মস্থল ঢাকা কেন্দ্রীয় জিএমডির থেকে সংঘটিত হওয়ায় তিনি উল্লিখিত প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পান।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন পাওয়ার পরে তার চাকরির চুক্তি স্থায়ীকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ৮ মার্চ তারিখে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে পিজিসিবির বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্তকালে তার চাকরি আবেদনের সঙ্গে দাখিলকৃত সাহাপুর আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসামি মো. ওয়াহিদুজ্জামান ২০১১ সালের ২৭ জুন তারিখে স্বাক্ষরিত বিদ্যালয়ের স্মারক নং ১৩/৯০ তারিখ মূলে প্রদত্ত শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটিও সঠিক নয়। আসামি মো. শামছুর রহমান ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সহায়তায় অসৎ উদ্দেশ্যে ওই সনদটি তৈরি ও গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে, মো. শামছুর রহমান ১৯৯২ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও সনদটিতে ১৯৯৪ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তার প্রকৃত জন্ম তারিখ ১০৮০ সালের ২৪ জুন এর জায়গায়  ১৯৮২ সালের ২ জুন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্যদিকে, পিজিসিবির বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে বিদ্যালয়ের প্যাডে ২০২১ সালের ২২ আগস্ট লিখিত বিবৃতিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দাবি করেন যে, মো. শামছুর রহমানের নামে ই স্যুকৃত সনদটি যথাযথ আছে।

তিনি বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করেন যে, মো. শামছুর রহমান ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।  বিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৮২ সালের ২৪ জুন। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসামি মো. ওয়াহিদুজ্জামান কমিটিকে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য  দিয়ে বিবৃতি দেন। অনুসন্ধানকালে প্রধান শিক্ষক আসামি মো. ওয়াহিদুজ্জামান এই মর্মে বিবৃতি দেন যে, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও পাঁচ নম্বর কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন জোয়াদ্দার মামুন ও দলীয় লোকজনের চাপে তিনি উল্লিখিত সনদটি দিতে বাধ্য হন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সনদ নেওয়ার সময়ে তার জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখানোর বিষয়ে যে তথ্য দেন তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন করান। ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর অন্যদিকে, তাকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের প্রত্যয়ন প্রদান করা হয় ২০১১ সালের ২৭ জুন। ওই জন্ম সনদ ব্যবহার করে পরবর্তীতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করেন।  অনুসন্ধানের সময়ে মো. শামছুর রহমান ১৯৯৫ সালে এসএসসি পাসের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন যে, এসএসসি পাস সনদে তার জন্ম তারিখ ভুল ছিল। জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে তিনি তার জন্ম তারিখ সংশোধন করেন। অনুসন্ধানে মো. শামছুর রহমান ভুয়া ও জাল সনদপত্র দাখিলের মাধ্যমে পিজিসিবিতে চাকরি নেওয়ার সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মামলার অপর আসামি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার পাঁচ নম্বর কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন জোয়াদ্দার মামুন মো. শামছুর রহমান জাতীয় পরিচয়পত্রধারী এবং এসএসসি পাস হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো যাচাই-বাছাই না করে তার জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করেছেন।

ঢাকাটাইমস/২৯মার্চ/এএ/ইএস