দেশের উন্নয়নে আচরণগত মনোভাব জানা জরুরি

প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:১৩

আশিকুর রহমান অমি

বর্তমান সময়ে সমতার বিশ্ব কায়েমে ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ধনাত্মক মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থা।উদাহরণ টানতে গেলেই আমরা দেখি আশির দশকের শেষের দিকে মালয়েশিয়া দেখলো যে তাদের অর্থনীতি কৃষি থেকে শিল্পে পরিবর্তন এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও শিক্ষায় মূল বাঁধা হিসেবে দেখা দেয় তাদের সকল নাগরিকের উদাসীন মনোভাব।

তৎকালীন মালয়েশিয়ায় বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থ্যায় তাদের নাগরিকদের উদাসীন মনোভাব তাদের দেশের উন্নয়নের গতিকে পেছনে টেনে ধরেছিল। মালয়েশিয়া সেসময়ে উত্তরণের পথ হিসেবে তাদের আমলাদেরকে ব্রিটেনের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যাটিটিউড বা আচরণের বিষয়ে পড়ালেখা বাধ্যতামূলক করে। একইসাথে পড়ালেখা করে দেশে ফিরে এসে সেসব আমলাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রশিক্ষকদেরকে সাথে নিয়ে আচরণগত মনোভাব সম্পর্কে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে প্রথমেই তাদের মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের তৈরি করা হয়। এভাবে ক্রমশঃ কসরত চলতে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে  মাঠ পর্যায় পর্যন্ত।

এখন আমরা মালয়েশিয়ায় যতটুকু বাহ্যিক অবকাঠামো ও স্থাপত্যশৈলী দেখতে পাই ও পর্যটন সুবিধা নিতে যাই তার পেছনে এই ধনাত্মক মনোভাবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে ইদানীং সময়ের অধুনা মন্ত্রণালয়গুলোতে ভবিষৎবাদীদের দেখা যায়।অনেকেই প্রবাস থেকে ভবিষ্যৎবাদ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে পলিসি ও পরিকল্পনার ভবিষ্যত বিচার বিশ্লেষণ করেন।

আজকের সময়ে তরুণ নেতাদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা এ জাতিকে কিভাবে গড়ে তুলবেন। যেমনটা আমরা দেখেছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করেছিলেন কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমে।বঙ্গবন্ধু কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে বাজেট দিয়েছিলেন এবং বাজেট বক্তৃতায় সরকারের  ভবিষ্যত পরিকল্পনা, রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের  স্পষ্ট দিক নির্দেশনাও বাতলে দিয়েছিলেন।

বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র সঙ্গায়ন ও কর্মসূচি ভিত্তিক আলাপে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ থাকলেও অনুশীলনে তা খুঁজে পাওয়া দুর্লভ হয়েছে নানাবিধ কারণে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির পর জাতীয় চরিত্রের যে অধঃপতন হয়েছিল এবং যে ধ্বংসাত্মক মনোভাব তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে জাতিকে ফিরিয়ে আনা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এখনো আমরা এদেশের জনগণ অনেকেই অনায়াসে অপপ্রচার, প্রপাগান্ডা করি।এখনো আমরা অফিস আদালতে কিংবা বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে প্রথাগত প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধাচারণ করে বিকল্প রাস্তা খুঁজি।

এখনো অনেকেই নিয়ম কানুন মেনে চলার চর্চা থেকে নিজেদের বিরত রেখে ক্ষমতা প্রদর্শনের পসরা সাজিয়ে নিজেদের জাহির করবার প্রয়াস করি।অথচ উন্নত দেশগুলোর দিকে আমরা লক্ষ্য করলে দেখি সেখানে নাগরিকরা কারো বিপদ দেখলেই এগিয়ে আসে। সংকট আসলে সমালোচনা নয় বরং তারা তা মোকাবেলা করে।

বর্তমান সময়ে এই ছোট ছোট আচরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ।শুধু আচরনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ উন্নত হতে পারেনি বরং উন্নয়নশীল থেকে অনুন্নত হয়েছে।আবার আচরণের কারণেই অনেক দেশ ও জাতি অনুন্নত থেকে ধীরে ধীরে উন্নয়নশীল এবং উন্নত হয়েছে। এদিক থেকে বলতে গেলে ব্রিটিশরা যাওয়ার পর সাউথ আফ্রিকার যে দুর্গতি ঘটেছিল কেবলই তা তাদের নাগরিক আচরণের কারণে।আবার পাকিস্তানের অবস্থা দেখলেই আমরা বুঝতে পারি তারা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে শুধুই তাদের ঋণাত্মক মনোভাবের কারণে।

ঢাকা শহরের যানজট বা অন্যান্য সমস্যার মূলেও রয়েছে এই আচরণগত সমস্যা। কোন কর্তৃপক্ষ কাউকে ছাড় দেয়না কিংবা সকলে মিলে একই প্লাটফর্মে সমবেত হয়ে সহযোগিতা পোষণ করেনা।যার ফলে শুধুমাত্র ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনার জন্য শত শত কর্তৃপক্ষ থেকেও কোন লাভ হয় না।বরং যত বেশি কর্তৃপক্ষ তত বেশি সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।এর মূলেই রয়েছে এই আচরণগত সমস্যা। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করবার পর যারা দেশ শাসন করেছে তাদের নেতৃত্বে এদেশে পলায়ন মানসিকতা তৈরী হয়েছিল যা একজন ব্যক্তির চিন্তা থেকে শুরু করে তার সামাজিক স্বাতন্ত্র‍্য ও জাতীয়তাবোধের ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আজকের দিনে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে বিদ্যুতের পর্যাপ্ত ব্যবহার ও অপচয় রোধের কথা বললে এবং জ্বালানী সাশ্রয়ের আহ্বান জানালে আমরা অনেকেই আমাদের প্রথাগত ঋণাত্মক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলি।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আমাদের পরিমিত ব্যয়ের কথা বলেন তখন আমরা অনেকেই আমাদের সংকট মোকাবেলা না করে বরং সমালোচনা করি এবং উদাসীন ও পলায়ন মানসিকতা পোষণ করি।

এক্ষেত্রে আমাদের সকলকে বুঝতে হবে রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও স্পষ্ট পরিকল্পনা এখন অধুনা বৈশ্বিক রাষ্ট্র পরিচালনার মূল মন্ত্র। সেক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সচেতন থাকা খুবই প্রয়োজন। বৈশ্বিক বাস্তবতা ও আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের বিষয়টিও এখন সময়ের সাথে খুবই প্রাসঙ্গিক।

এদিকে একইসাথে আমরা সম্প্রতি গণমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি দেশের গুটিকতক আমলা যাদেরকে সরকার কর্তৃক দেশের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের জন্য সরকারি যানবাহন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তারা সে যানবাহন তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন।এক্ষেত্রেও কিন্তু জ্বালানী সাশ্রয়ের পরিবর্তে তা অপচয়ই হচ্ছে। আবার শুধু আমলারাই নন আমরা যারা এদেশের সাধারণ জনগণ রয়েছি তারা ট্রাফিক আইন অমান্য করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি ও কায়দা কানুনকে প্রায়শই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছি।

এক্ষেত্রে কিন্তু সরকারের আহ্বানই যথেষ্ট নয়। আমাদের নাগরিক সমাজকে এই আচরণগত ত্রুটি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। তা না হলে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো বৃহৎ আকারে রূপ নিয়ে আমাদের দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।দেশের জনগণকে সরকারের দেশ পরিচালনায় সহায়তা করতে হবে। এক্ষেত্রে ধনাত্মক মনোভাবাপন্ন আচরণের কোন বিকল্প নেই।

তবে স্বস্তির খবর এই যে গত এক যুগে বাংলাদেশের  অগ্রগতিকে কেউ লাগাম দিতে পারেনি। বিগত ২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে যেখানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে সেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছয় গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ২১.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে । এমনকি বাংলাদেশে স্বদেশী অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন এবং মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, মাতারবাড়ি পাওয়ার প্ল্যান্ট, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বড় বড় প্রজেক্টে অর্থায়নের পরেও আজ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তবে বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গতি ঊর্ধ্বমুখী থেকে কিছুটা নিম্নমুখী হওয়ায় আবারও সেই আচরণগত এক ধরনের পলায়ন মানসিকতা আমাদের গুটি কতক দ্বিধাবিভক্ত জনগোষ্ঠীর মাঝে দেখা গিয়েছে। তবে যারা দ্বিধাবিভক্ত তারাও কিন্তু এদেশেরই নাগরিক। তাই তাদেরকে সহ দেশের সকল স্তরের নাগরিক সমাজকে স্বদেশী উন্নয়ন ও অধুনা আচরণগত মনোভাবের বিষয়ে অবগত এবং সচেতন করতে হবে।দেশের সংকট কিংবা সম্ভাবনায় উদাসীন নয় বরং ধনাত্মক মানসিকতা সম্পন্ন আচরণই কেবল আমাদের দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সর্বোত্তম নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য আরও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নিশ্চয়তা দিতে পারে।

লেখক - আশিকুর রহমান অমি,

সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

(ঢাকাটাইমস/০১এপ্রিল/এমএম)