‘আমার সংসার আছে’ নারীর দায়িত্ব অবহেলার যুক্তি নয়

প্রকাশ | ১১ এপ্রিল ২০২৩, ২০:৪৯

সামিনা রশ্নি

আমার সংসার আছে-সোস্যাল মিডিয়া খুব সরব এর বিপক্ষে প্রচারণা। মা-বাবার দায়িত্ব নিতে না চাওয়া মেয়েরা নাকি এই অযুহাতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের এমন ছবি দেখে হাসি থামে না বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীমার।

তিনি বলেন, দেখেনতো এমন কোনো মেয়ে আছে যে তার মা-বাবার দায়িত্ব এই তিন শব্দে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে। সংসার জীবন প্রায় এক যুগের। এর মধ্যে দশ বছর ধরে মা আমার সঙ্গে। বাবা নেই ভাইরাও যার যার সংসারে ব্যস্ত। আমার নিজের সংসারটাইতো মায়ের। সন্তানদেরকে মা আগলে রেখেছিলো বলেই না নিশ্চিন্তে অফিস করতে পেরেছি। মায়ের শরীরটা এখন ভালো না। নিয়মিত ডাক্তারের দরবারে হাজিরা দিতে হয়। মায়ের সবকিছু নিজে করি। আমার স্বামীও সাপোর্ট করেন। মায়ের কখন কোন ঔষধ খেতে লাগবে সব মনে করিয়ে দেন। কই আমিতো বলিনি আমার সংসার আছে। ঠিক আমার শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রাম থেকে আসলেও দায়িত্বে কোন ত্রুটি রাখি না। সব যদি সমানভাবে সামলাতে পারছি বলেইতো অশান্তি আসে না।

সেই রকম একজন নাদিয়া। বিয়ের পর বাচ্চা পেটে আসলে শাশুড়ি চলে যান নিজের মেয়ের কাছে। ওর সংসার সামলাতে নাকি কষ্ট হচ্ছে। তখন নিজের মাকে নিয়ে আসেন। সেই থেকে এখন অবধি মা-তেই আস্থা নাদিয়ার। বাবা ছোট ভাইটাকে নিয়ে কষ্ট করে থাকেন। তারপরও কখনো মুখফুটে বলেননা তোর মাকে পাঠিয়ে দে। নিজে ঢাকায় এসে নাতি নাতনিকে দেখে যান।

বেসরকারি সিটি ব্যাংকের লোন বিভাগের কর্মকর্তা নীলা (ছদ্মনাম) সম্প্রতি মাকে নিয়ে ভারত সফর করে এসেছেন। লম্বা ছুটি পাওয়ায় স্বামীর কাছে সন্তানদের রেখে মাকে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন। করোনায় বাবাকে হারানো মা যেন একাকীত্ব অনুভব না করেন সে চেষ্টা। শ্বশুর বাইর।

এটা হল সমাজের একটা অংশের চিত্র। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে একজন নারী সংসারের খুব কম বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে একজন কর্মজীবী নারীর পক্ষে হয়ত মা-বাবার দায়িত্ব নেয়াটা সহজ হতে পারে। কিন্তু একজন গৃহিণী। স্বামীর আয়ের কথা চিন্তা করে অনেক সময় তিনি সেটা এড়িয়ে চলেন। বিষয়টা আর্থিক স্বচ্ছলতার উপর নির্ভর করে। নারী নিজেই যখন পরনির্ভর তখন পিতা-মাতাকে আশ্রয় দিতে সক্ষম হননা।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আগে একটা সময় নানিরা খুশি হত নাতি কোলে আসলে, মারা গেলে খাট কাঁধে তুলে কবর পর্যন্ত নিতে পারবে। আর মা-বাবা খুশি থাকেন বৃদ্ধ বয়সের খুটি মনে করে অথবা বংশের ধারক-বাহক হিসেবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে সে চিত্র। এখন মেয়েকেই অনেকে যক্ষের ধন মনে করেন। বৃদ্ধ বয়সে তারাই যে মা-বাবার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন, দেখা শুনা করে থাকেন।

এ বিষয়ে ফ্রিল্যান্স জেন্ডার অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ড নিলুফার আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান সময়ে মেয়েদের মানসিকতার অনেক বদল হয়েছে। শুধু তাই নয় নারীদেরকে নিয়ে বদলেছে আমাদের সমাজেরও মনোভাব। মেয়েরা এখন যে কোন দায়িত্ব নিতে অগ্রগামী। সংসারের অযুহাতে পিছপা হয়না মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনে। পারিপাশ্বিক নানান সমস্যার কারণে কিছু ব্যতিক্রম আছে,  তারপরও মেয়েরা এখন বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব পালনে অনেকাংশেই এগিয়ে।’

নারীর কোন কিছু এমনিতেই খুব একটা নজর কাড়ে না সমাজের। নেতিবাচক দোষ খুঁজে বের করতেই হয়। অনেক পিতা-মাতাকে সমাজে ছোট হয়ে থাকতে হয় মেয়ের সংসারে থাকে বলে। অথচ ছেলে যদি বৃদ্ধাশ্রমেও রেখে আসে সেটার কোন সমালোচনা হয়না।

করোনা ভাইরাসের মাঝে দেখা গেছে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অনেকেই রাস্তায় ফেলে গেছে সেবা করার ভয়ে। আবার পত্রিকার পাতা খুললে হরহামেশাই দেখা যায় শিক্ষিত বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মা ভিক্ষা করছেন। যার উদাহরণ ২০২০ সালে ভাইরাল হওয়া ময়মনসিংহের বৃদ্ধ ভিক্ষুক সালেমুন নেছা। আবার অনেক সন্তানকে মা-বাবা নিজের স্বর্বস্ব বিক্রি টাকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠায়। তাদের অনেকেই দেশে ফেরেন না, ভুলে যান মা-বাবার দেনার কথাও। এই রকম অবহেলার শিকার মা-বাবার খবর আসে রোজ পত্রিকার পাতা জুড়ে। অনেক সন্তান পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের বোঝা মনে করেন। ঝামেলা মনে হয়। ফল হিসেবে অনেক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে জীবন কাটাতে হয়। এই আলোচানা ভিন্ন। তবে নারীরা যে ‘আমার সংসার আছে’ এই অযুহাতে মা-বাবার দায়িত্ব নিতে চায়না এমনটা সঠিক নয়। নারীরা তার কর্তব্য থেকে কখনো পিছপা হয় না। বিয়ের পর মেয়েরা পর হয়ে যায় এমন মানসিকতার দেয়ালও ভাঙতে শুরু করেছে আমাদের সমাজের। আর এটা সম্ভব হয়েছে নারীর দৃঢ় ইচ্ছা শক্তির জোরেই।

 

লেখক: ফ্রিল্যান্সার