কোভিড-১৯: বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য

ড. মো. আবদুল করিম
 | প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:২৪

কোভিড-১৯ অতিমারি সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়াকে শ্লথ করেছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করেছে। কোভিডের কারণে দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অর্জিত ৮ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিপরীতে কোভিডের কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালের প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ২ দশমিক শূন্য শতাংশ এবং ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে।

সরকার ঘোষিত বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা, বৈদেশিক সহায়তা, বেসরকারি খাত ও এনজিও সেক্টরের সমন্বিত প্রচেষ্টায় প্রকৃত প্রবৃদ্ধি অবশ্য অনেক বেশি অর্জিত হয়েছে। কোভিডের সময় দেশের রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার কারণে রপ্তানি আয় অনেক কমে যায়, লাখ লাখ মানুষ চাকরিচ্যুত হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন মারাত্মকভাবে কমে যায়। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ (১৯৯১-৯২) যা ২০১৯ সালে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। অথচ কোভিড-পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে বলে অনেক গবেষকের ধারণা।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতো, যা কোভিডের অব্যবহিত পূর্বে প্রায় ২০ শতাংশে নেমে আসে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্পোৎপাদন খাতে কোভিডের কারণে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২০২০ সালে ৪২ শতাংশে পৌঁছে বলে অন্য একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কোভিডের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম উন্নয়ন বিস্ময়। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য গুটিকয়েক পণ্যের ওপর নির্ভর বিধায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত Remittance-এর ওপর নির্ভরশীল বিধায় বাংলাদেশের অর্থনীতির অভিঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম।

তাই দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠা জনগোষ্ঠী অল্প আঘাতেই পুনরায় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। ২০২২ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৯০ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেছে। এ সংখ্যা বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।

দারিদ্র্য বহুমাত্রিক সমস্যা বিধায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শুধুমাত্র গড় আয় বৃদ্ধি করে টেকসই উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভবপর হবে না। এর জন্য তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা, দক্ষতা, উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র উদ্যোগে সহায়তা এবং আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উপযুক্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান অপরিহার্য। South Asian Network of Economic Modeling (SANEM) এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহ চেইনের অনিশ্চয়তাজনিত কারণে বাংলাদেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি পূর্ববর্তী বছরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতির এ হার সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্যের কারণে গবেষণাকৃত এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে, ৫০ শতাংশ লোক তাদের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়েছে, ৭০ শতাংশ জনসাধারণ মাছ/মাংস/ডিম খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে এবং ৭৫ শতাংশ লোক উচ্চসুদে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।

অবশ্য এদের প্রায় ২৮ শতাংশ জনসাধারণ হ্রাসকৃত মূল্যে কোনো না কোনো খাদ্যসামগ্রী ক্রয়ের সুযোগ পেয়েছে। মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে সাধারণ মানুষের অভাব-অনটন আরো বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত ২০২২ সালের গৃহজরিপ অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। দেশে দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালের ২৪ দশমিক ৩ শতাংশের তুলনায় ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে অতি দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে কমে এসেছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের মানদণ্ড Gini Coefficient ২০১৬ সালের ০ দশমিক ৩২৪ থেকে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়ে ২০২২ সালে ০ দশমিক ৩৩৪-এ দাঁড়িয়েছে। এ সূচকটি আরো বেড়ে গেলে ধনী-গরিবের বৈষম্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে টাকা ১৫,৯৮৮ এবং ১৫,৭১৫। ২০২২ সালে এটা বেড়ে যথাক্রমে ৩২,৪২২ এবং ৩১,৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটি একটি স্বস্তির লক্ষণ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করায় উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ বৈষম্য কমানোর অন্যতম উপায় হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বহুমাত্রিক সহায়তা প্রদান (ঋণ, শিক্ষার সুযোগ, দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, জীবন চক্রভিত্তিক রাষ্ট্রীয় সহায়তা ইত্যাদি)। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির কোনো বিকল্প নেই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) এবং ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ তে দক্ষ জনশক্তি তৈরির রূপরেখা বিস্তারিতভাবে বিধৃত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মানবহিতৈষী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ লিন্ডসে এল্যান চেনীর প্রতিষ্ঠিত ‘আন্ডার প্রিভিলেজড চিলড্র্যান্স প্রোগ্রাম (UCEP)’ বাংলাদেশের অনন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিষয়ক বিভিন্ন কোর্সসহ ইউসেপ-এর চল্লিশাধিক ট্রেড কোর্স, এসএসসি (ভোকেশনাল) কোর্স এবং ডিপ্লোমা কোর্সগুলো বাংলাদেশ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং কারিগরি শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত। ইউসেপ দরিদ্রবান্ধব, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রান্তিক যুবাদের শিক্ষা/প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। জার্মানি, জাপান ও সিঙ্গাপুরে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার যথাক্রমে ৭৩ শতাংশ, ৬৬ শতাংশ এবং ৬৫ শতাংশ যা বাংলাদেশে মাত্র ১৪ শতাংশ। এ হার ২০৩০ সালে ৪০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালে ৬০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দসহ ইউসেপ-এর মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। গত ১২ বছরে দেশের গৃহভিত্তিক পারিবারিক আয় ও ব্যয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে, শিক্ষার হার ৫৮ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আর্থ-সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ধনী-গরিবের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

ড. মো. আবদুল করিম, সাবেক মুখ্য সচিব, নির্বাহী পরিচালক, ইউসেপ বাংলাদেশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :