ইউপি সদস্য মাইকেল সংসার চালান রিকশা চালিয়ে
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মাইকেল ঢালী। বয়স ৪৪ বছর। এলাকার মানুষের কাছে অবশ্য তিনি ‘রিকশাওয়ালা নিউ মাইকেল’ নামে পরিচিত। রিকশা চালাতে চালাতে মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা জাগে তার। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি রিকশা চালানো বাদ দেননি। রিকশা চালিয়ে সংসার চালান, পাশাপাশি ভোটারদের সুখ-দুঃখের খবর জানতে রিকশা চালিয়ে বাড়ি বাড়ি যান।
মাইকেল পোরাগাছা গ্রামের বাসিন্দা। গত বছরের জানুয়ারিতে ইউপি নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন।
ওই গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাইকেল আবদুর রব ঢালী ও নীলুফা বেগম দম্পতির ছেলে। কিশোর বয়সে বাবা-মাকে হারান। পরে আট ভাই-বোনের সংসারে জীবিকার তাগিদে তিনি ঢাকায় গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা চালানোর কাজ শুরু করেন। ১০ বছর পর তিনি গ্রামে ফিরে যান। শুরু করেন রিকশা চালানো। গত ১৬ বছর ধরে তিনি রিকশা চালাচ্ছেন।
গত বছর জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর মার্চে শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাইকেল ঢালী। গত এক বছরে তিনি তার এলাকার দরিদ্র মানুষকে সরকারি নানা সহায়তা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন।
মাইকেল ঢাকা টাইমসকে জানান, রিকশায় গ্রামের মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পথে গল্প হয়। গল্প করতে করতে এলাকার দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সখ্য হয়। অনেক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে ভোটের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন না বলে অনেকের অভিযোগ। সেসব দেখে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা জাগে তার। ২০১৬ সালে তিনি ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কয়েক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। পরে গত বছর অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে তিনি আবার প্রার্থী হন। ভোটাররা তাকে জয়ী করেন।
মোক্তারেরচর ইউপি সূত্র ঢাকা টাইমসকে জানায়, গত বছর জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর মার্চে শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাইকেল ঢালী। গত এক বছরে তিনি তার এলাকার দরিদ্র মানুষকে সরকারি নানা সহায়তা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন।
পোরাগাছা গ্রামের আলমগীর ঢালী বাকপ্রতিবন্ধী। তার অভাবের সংসার, তবে কেউ তাকে সহায়তা করেছিলেন না। মাইকেল নির্বাচিত হওয়ার পর আলমগীরের পরিবারকে খাদ্যসহায়তার ভিজিডি কার্ড দিয়েছেন। আলমগীরের স্ত্রী ফুল মালা বলেন, ‘আমরা অনেক গরিব মানুষ। সহায়তা পাচ্ছিলাম না। মাইকেল ভাই নির্বাচিত হওয়ার পর আমরা প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছি। ভাই গরিব মানুষের জন্য কাজ করছেন।’
পোরাগাছা গ্রামের লোকরি মাতবর বয়স্ক ভাতা পেতেন না। ইউপি সদস্য মাইকেল তার কাগজপত্র নিয়ে সমাজসেবা কার্যালয়ে জমা দিলে বয়স্কভাতা পেতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা আমাদের পাত্তা দিতে চায় না। কিন্তু আমাদের গরিবের বন্ধু রিকশাওয়ালা মাইকেল আমাদের কষ্ট বোঝে। তাইতো বয়স্ক ভাতা পেয়েছি।’
মাইকেলের কোনো কৃষি জমি নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই শতাংশ জমিতে থাকা বসত ঘরে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকেন তিনি। রিকশা চালিয়ে দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পান। এই আয়ে সংসার চালান, ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করান।
মাইকেলের স্ত্রী লিপি বেগম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার স্বামীর শিক্ষা ও টাকা-পয়সা নেই। তবে তার আত্মাটা বড়। আমাদের মতো দরিদ্র মানুষের সেবা করার জন্য তিনি ইউপি সদস্য হয়েছেন। মানুষের কাজ করতে গিয়ে আয়-রোজগার কম হয়, সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাতে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই। আমার স্বামী যেন মানুষের ভোটের মর্যাদা রাখতে পারেন।’
ইউপি সদস্য মাইকেল ঢালী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চেষ্টা করছি সাধ্যমতো মানুষের পাশে থাকতে। জনপ্রতিনিধি হয়েছি, মানুষের অধিকার আদায়ে পাশে থাকছি। কিন্তু নিজের পরিবারকে তো বাচাতে হবে। তাই আয় করার জন্য রিকশা চালাই। রিকশা চালানো ছেড়ে দিলে সংসার চলবে কীভাবে?’
মোক্তারেরচর ইউপি চেয়ারম্যান বাদশা শেখ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ অনুযায়ী ৬ নম্বর ওয়ার্ডে যা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা সঠিকভাবে বিতরণ করছেন মাইকেল। মাইকেলের কার্যক্রমে ওই ওয়ার্ডের মানুষ সন্তুষ্ট। রিকশা নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের খোঁজ নেন তিনি।
এ বিষয়ে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শংকর চন্দ্র বৈদ্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সমাজের টাকাওয়ালা প্রভাবশালীরা জনপ্রতিনিধি হন। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জনপ্রতিনিধি হওয়ার নজির কম। মাইকেল ইউপি সদস্য হওয়ার পরও তার জীবিকার মাধ্যম রিকশা চালানো ছাড়েননি। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুবই ভালো ধারণা পেয়েছি। এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে খুবই ভালোবাসে। তিনি বর্তমান সমাজের জন্য এক বড় দৃষ্টান্ত। স্থানীয় প্রশাসন তার ভালো কাজের পাশে থাকবে।
(ঢাকাটাইমস/৪মে/এসএম)