মায়াবি বিশ্বস্ততায়

রিপনচন্দ্র মল্লিক
 | প্রকাশিত : ০৫ মে ২০২৩, ০৮:৫৩

মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টির শব্দে মাত্রই ঘুম ভেঙে গেল। লঞ্চের ছোট্ট জানালা দিয়ে কীর্তনখোলা নদীর বুকে বৃষ্টির দুমড়ে মুচড়ে আছড়ে পড়া দেখতেও বেশ লাগছিল। গত এক মাসেও এমন বৃষ্টি তার চোখে পড়েনি। এমন সময় লঞ্চের হুইসেলের বিকট শব্দে শেষমেশ বিছানা ছেড়ে উঠতেই হলো। বুঝতে বাকি রইলো না যে, এখনই সবকিছু গুছিয়ে নামতে হবে। গত কয়েক দিনের চরম মানসিক যন্ত্রণায় তার ঘুমই আসছিল না। দীর্ঘ নদী পথে রাতের একটানা ঘুমে মনে হচ্ছিল-শেষ কবে যে এমনভাবে আরাম করে ঘুমানো হয়েছিল, সে কথা আর মনে আসছিল না। শরীরটাও বেশ ঝরঝরে লাগছে। সারা রাত নদীর জলের ঢেউয়ের তালে তালে লঞ্চ যখন চলছিল; কেবিনে শুয়ে তখন তার মনে হচ্ছিল যেন সে দোলনায় দুলছে। জলের এমন দুলুনির তালে তালে নূপুরের চোখের পাতা কখন যে বুজে গিয়েছিল, তা একটুও টের পায়নি। এই তো মাত্রই কয়েক দিন আগে, এমন বৃষ্টিমুখর দিনে ঢাকা শহর ছেড়ে বরিশালে পাকাপাকিভাবে চলে এসেছে। এখন ভরা বর্ষা চলছে। আষাঢ় মাসের শেষ শুক্রবার আসতে এখনো দশ দিন বাকি আছে। দিন যেন কীভাবে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই নূপুর বুঝতে পারছে না। এই তো সেদিন বৃষ্টিভেজা দুপুরে তার বাবা ডেকে বললেন, ‘মা, তোমার যা কিছু কেনাকাটা করা দরকার, তা সব কিছু এই সপ্তাহেই কিনে শেষ করবে। বিয়ের শেষ মুহূর্তে কেনাকাটা বিষয়ে যেন আবার কোনো কিছুর ঝামেলায় না পড়ে যাই। সেদিকে খেয়াল রেখে কেনাকাটা সব শেষ করবে।’ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নূপুর শুধু মাথা নাড়ালো। যেন তার বাবা বুঝতে পারে-সে যা বলেছে, সব কিছু সেভাবেই হবে। বিয়ের আগেই সব কিছু কেনাকাটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বিয়েতে যে তার কোনো মত নেই, সে কথা কাউকে বুঝতে দিতে চাইছে না। বাবা তাকে কত কষ্ট করে বড় করে তুলেছেন। তা কেউ যদি বুঝতে নাও পারে; নূপুর খুব ভালো করেই বুঝতে পারে। এই পর্যন্ত তাকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে আসতে তার বাবার অবদানই সবচেয়ে বেশি ছিল। নূপুর যখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করে তখনই প্রায় তার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তেমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। তখন সে খুব হতাশ হয়ে পড়ে। ভেবেছিল- তাকে দিয়ে বুঝি আর কোনো কিছু করা সম্ভব হবে না। এই সুন্দর নির্মল জীবনের কাছে সে নিশ্চিতভাবেই হেরে যাচ্ছে। গ্রামের অন্য আরও পাঁচ-দশটা সাধারণ মেয়ের মতো তাকে বিয়েশাদি করে ঘরসংসারে মন দিতে হবে। এই বয়সেই বাচ্চা-কাচ্চার মা হতে হবে। তার মতন মধ্যম মানের একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে যে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব নয়, সে তখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিল। কিন্তু তার বাবা কালিপদ হালদার যিনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ ছিলেন না। সে অনেকটা জোর করেই নূপুরকে নার্সিংয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। তখনকার সময়ে সারা দেশের নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা ঢাকাতেই নেওয়ার নিয়ম ছিল। এখন তো দেশের অনেক শহরেই নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যায়। তখন শুধু ঢাকায় যাওয়া লাগত।

তার মনে আছে, যেদিন সে প্রথম তার বাবার সাথে নার্সিংয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসে। তার আগে কোনোদিন আসা হয়নি। প্রথম বারেই ঢাকার রাস্তায় জ্যাম দেখে সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। যেখানেই যেতে চায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় যানজটে আটকে থাকতে হয়। যদিও তার শিশুবেলা ঢাকায় কেটেছে। সে স্মৃতি তার কিছুই মনে নেই। সেই শৈশবে যখন তারা ঢাকায় বসবাস করেছিল; তখন তার বাবা ঢাকার আলজেরিয়া দূতাবাসে ছোট্ট একটি পদে চাকরি করতেন। বেতন যা পেতেন তাই দিয়ে এই রঙিলা ঢাকা শহরের কোনো একটি গলির ভেতরে, ছোটখাটো এক কামরার ঘরে কোনো রকমে তারা বেঁচে থাকতেন। তখন তাদের কোনো খোঁজ নেওয়ার মতন কোনো লোক ছিল না।

পরে নূপুর যখন একটু বড় হয়েছে। অল্প অল্প বুঝতে শিখেছে। তখন সে তার বাবা ও মায়ের মুখে শুনেছে, আলজেরিয়া দেশটি যখন ঢাকা থেকে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে চলে যায়, তখন তার বাবা বেকার হয়ে পড়েন। কোথাও কোনো চাকরি খুঁজে পাচিছল না। তখন সে কত প্রতিষ্ঠানে যে জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে ঘুরেছে-সেগুলোর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা এখন আর তার বাবার মনে নেই।

চারদিকে চাকরি খুঁজে খুঁজে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে একদিন সবাইকে নিয়ে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার ‘কালুরপাড়’ গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ঢাকা থেকে যখন ওদের সবাই গ্রামের বাড়ি চলে আসে; তারপর থেকে নূপুরের পুরো কিশোরী বেলা এই গ্রামেই কেটেছে। নিজেদের গ্রামে চলে আসার পর থেকে বেশ কিছু বছর পারিবারিক অভাব-অনটন তাদের লেগেই থাকতো। সে সময় নূপুর কয়েক বছর পিরোজপুরে তার মামা বাড়িতে থেকেছে। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। যে বছর সে অষ্টম শ্রেণি পাস করেছিল ওই বছরেই তার বড় মামা বিয়ে করে; তারপর থেকে আবার সে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসে। যদিও তার মামি আসতে দিতে চায়নি। বাড়িতে একটি মেয়ে থাকলে অনেক সুবিধা হয়। ঘরগৃহস্থের টুকিটাকি অনেক সে কাজ করতে পারে। এই ভেবেই তার মামি তাকে বাড়িতে ফিরে আসতে দিতে চায়নি। কিন্তু তার মায়ের অসুস্থতায় তাকে ফিরে আসতেই হয়েছিল। এখানে এসে নিজের গ্রামের স্কুলে সে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তারপর আর কোথাও যেতে হয়নি। নিজের গ্রামে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। তাই শিশুবেলার ঢাকা শহরের কোনো স্মৃতিই এখন মনে নেই। তার মনে যা কিছু আছে, তা নিজের গ্রাম আর মামা বাড়ির স্মৃতি ছাড়া আর কিছু সে তেমনভাবে চেনে না। এখন নার্সিংয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেই ঢাকা শহরকে নতুন করে দেখা। যেখানেই চোখ যায়, তার চোখ দুটো আটকে যায়। সে ভাবতে থাকে— আরে! ঢাকা শহরে এত মানুষ! এত গাড়ি! এত বড় বড় দালানকোঠা! ধুলাময় বাতাস আর বাতাস। এই শহরে সব কিছুতেই এত ঠাসাঠাসি যে, এখানে মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে। নূপুরের যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। নিজের গ্রামের সেই নির্মল বাতাসের শূন্যতা তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে। এসব দেখে তার খুব অসহ্য লাগতে থাকল। সে বিরক্ত হয়ে উঠতে থাকে। তবুও তার তেমন কিছুই করার নেই।

যা হোক- তারা গ্রামের বাড়িতে বসবাস করলেও তার মেজো জেঠা ঢাকায় বড় একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। নূপুরের মেজো জেঠার আবার অন্য রকমের গল্প আছে। অনেক বছর হয়ে গেছে- সে এখন আর হিন্দু নেই। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে সে তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এখন ঢাকায় এক খ্রিস্টান মালিকের নামকরা একটি কোম্পানিতে বেশ বড় পদে চাকরি করেন। ভালো বেতনও পান। গ্রামের বাড়িতে তাদের কোনো যাতায়াত না থাকায় তারা এখন অচেনা মানুষই হয়ে গেছেন। এই গ্রামের হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া তাদের আর কেউ চেনে না।

তবে নার্সিংয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় জেঠার বাসায় না গিয়ে সে ও তার বাবা তার ছোট মাসির বাসায় গিয়ে ওঠেন। তারা হিসাব করেই বাড়ি থেকে ঢাকায় গিয়েছে। সেখানে এক রাত থাকার পরেই সকালে ভর্তি পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা দিয়েই এবার সে খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। যেন সে এবার চান্স পেয়েই যাবে। তার আগে যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল, সেগুলোতে সে এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল না। এখন সে মনের ভেতরে অনেক সাহস পেয়ে গেল। পরীক্ষা দেওয়ার আগে মনের ভেতরে যতটা ভয় কাজ করেছিল, পরীক্ষা শেষে সেই ভয় আর থাকলো না। পরীক্ষা শেষে বাইরে বেরিয়েই তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করল- ‘বাবা, আমার পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমি সরকারিভাবে নার্সিংয়ে পড়তে চান্স পেয়ে যাব। আমাকে নিয়ে তুমি আর কোনো চিন্তা কইরো না।’

-কথাগুলো শুনেই তার বাবার মুখে একগাল হাসি ফুটে উঠেছিল। যেন অমাবশ্যা শেষে আকাশজুড়ে ঝকঝকে পূর্ণিমার চাঁদ হেসে উঠছে।

তার মনে আছে, ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়ে তার বাবা কত খুশি হয়েছিল, তা এখন কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পরের দিন রাতেই রেজাল্ট বের হলে তার বাবা মিষ্টি নিয়ে বাসায় এসে বললেনÑ ‘মা, আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নার্সিংয়ে পড়তে চান্স পেয়ে গেছ। এখানে যারা পড়তে চান্স পায়, তারা সবাই নার্সিংয়ে দেশের সেরা শিক্ষার্থী।’

-নূপুর কল্পনাও করতে পারেনি যে, দেশের এত ভালো মানের একটি মেডিকেল কলেজের অধীনে সে নার্সিং পড়তে চান্স পেয়ে যাবে। শোন মা, সরকারিভাবে পড়তে থাকা-খাওয়ার কোনো খরচই লাগে না। সবই সরকার দেয়। ভগবানের কৃপায় আমার বড় একটা দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল।

-কথাগুলো বলতে বলতে নূপুর দেখছিল তার বাবার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছে। চোখ দুটো ভিজে উঠতে শুরু করছে। নূপুর বলে উঠলো-বাবা, আমাকে নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। এই তো মাত্র কয়েকটা বছর। দেখতে দেখতেই চলে যাবে। আমিও পড়া শেষে খুব দ্রুতই সরকারি নার্স হয়ে যেতে পারি তার চেষ্টা করে যাব। তখন তোমার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। এরপর থেকে সে ঢাকায় থাকতে শুরু করে। প্রতি মাসেই নূপুরকে দেখতে তার বাবা ঢাকায় চলে আসত। বড় মেয়ে হওয়ায় সে তার বাবার চোখের মণি হয়ে আছে। ছোট বোন ঝুমুরকেও যে কম ভালোবাসে তা নয়। তাকেও খুব ভালোবাসে। ঝুমুর বয়সে নূপুরের থেকে দশ বছরের ছোট। দশ বছরের ব্যবধান কিন্তু একেবারেই কম নয়। পরে বড় হয়ে নূপুর তার মায়ের মুখে অনেক বারই শুনেছে যে, তারা একজন ছেলের আশা করেছিল। কিন্তু ঝুমুর হওয়ার পরে আর কোনো ঝুঁকি নিতে যায়নি। দুই বোনই তাদের বাবা-মায়ের চোখের মণি। তবে প্রথম সন্তান হিসেবে নূপুরের আদর যতটুকু পাওয়ার দরকার ছিল; তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছে। মেয়েকে দেখতে প্রতি মাসেই তার বাবা ঢাকায় চলে আসে। এসে সারা মাসের বাজার সদাই করে দিয়ে যায়। এমনকি প্রতি মাসে টাকা যা প্রয়োজন পড়ত তা পাঠিয়ে দিত। তবুও মেয়েকে এক নজর চোখে দেখার ছুতোয় সে ঢাকা চলে আসত। যা কিছু কেনাকাটা করা দরকার, সেগুলো কিনে বিকেলেই আবার বাড়ি চলে আসত। এইভাবেই দেখতে দেখতে একদিন নূপুরের নার্সিং পড়া শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে সে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করে। তবে কিছুতেই সেসব হাসপাতালে মন বসাতে পারেনি। শেষমেশ একদিন তার পিজি হাসপাতালে চাকরি হয়ে যায়। পিজি হাসপাতাল। যে হাসপাতালকে এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় নাম দেওয়া হয়েছে। সেই পিজি হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে চাকরি হয়। পিজি হাসপাতালের চাকরি তখনো খুব মর্যাদাসম্পন্ন ছিল। বেতনও বেশ ভালো দেয়। স্বায়ত্তশাসিত চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এখানে যে কেউ চাকরি পেয়ে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। নূপুরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কর্মজীবী মেয়ে হিসেবে নূপুরের ভাগ্য তখন থেকে খুলতে শুরু করে। তরতর করে সে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। পিজি হাসপাতালেই সে প্রায় তিন বছরের মতন থাকে। এই ছোট্ট জীবনে তার অনেক মানুষের সাথেই পরিচয় হয়। ঢাকায় নার্সিং পড়ার সুযোগে তার অনেক ছেলে বন্ধুদের সাথেও প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচয় হয়। তবে কখনোই সেই বন্ধুদের সাথে সে সশরীরে দেখা করতে যেত না। তাদের সাথে কথা যা বলার দরকার, সেসব কথা সব সময় মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই সে বলত। পিজি হাসপাতালে চাকরি করার কোনো এক সময়ে মৃদুলের সাথে কীভাবে যেন পরিচয় হয়ে যায়। সে কথা এখন আর নূপুর নিজেই বলতে পারবে না। সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার শ্যামল রঙের দেহে, ছেলেটিকে দেখতে ভীষণ মিষ্টি লাগত। গায়ে খুব বেশি মাংস ছিল না। লিকলিকে শরীর না বলে বলা যায় হালকা পাতলা গড়নের তার দেহখানা ছিল। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম এডিটর হিসেবে সে চাকরি করে। টেলিভিশনের পর্দার সে পেছনের মানুষ ছিল। টিভিতে যারা কাজ করে তাদের প্রতি আগে থেকেই নূপুরের মোহ ছিল। তাদের নিয়ে বলা যায় তার বেশ কৌতূহলও ছিল। সেই কৌতূহল মৃদুলের সাথে পরিচয়ের পর থেকে আরও বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে এক সময় নূপুর নিজেকে আবিষ্কার করে যে- সে অতল হৃদয়ে মৃদুলের প্রেমে ডুবে আছে। শুধু প্রেমে ডুবেই থাকেনি, কোনো একদিন নূপুর নিজেকে আবিষ্কার করে যে, সে মৃদুলের কাছে তার দেহের কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার মতো অবশিষ্ট রাখেনি। সে সবই তার মায়াবি বিশ্বস্ততায় বিলিয়ে দিয়েছে। দেশের এমন কোনো সুন্দর জায়গা নেই, যেখানে তারা বেড়াতে যায়নি। যেদিনই তাদের ছুটির দিন থাকত, তারা শহর ছেড়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ত দূরের কোনো গন্তব্যে। মন মাতিয়ে আবার ফিরে আসত। এমন রঙিন দিনগুলোর ভেতরেই একদিন নূপুরের সরকারি চাকরির চিঠি চলে আসে। যখন তার চাকরিটি হয়, তখনো সে মৃদুলের ভালোবাসার ঘোরের ভেতরে এমনভাবে ডুবে ছিল যে, তখনো সে চাকরিটি করবে নাকি করবে না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। সে ভেবেছিল, সরকারি চাকরি হলে ঢাকার কোনো একটি হাসপাতালে যদি নিয়োগ হয় তাহলে সে মৃদুলকে বিয়ে করে ঢাকা শহরেই থেকে যাবে। কিন্তু নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে সে খুবই হতাশ হয়ে পড়ে। বরিশালের একটি সরকারি হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়োগ দেয়। সে তখন সিদ্ধান্ত নিতেই হিমশিম খাচ্ছিল। কিন্তু তার বাবার স্বপ্ন মেয়ে সরকারি নার্স হবে। সে কথাও ভুলে যেতে পারছে না। এমন এক দ্বিধাদ্বন্দ্বে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেই সে পড়ে গেল। প্রেমে পড়ার আগে সরকারি চাকরি পাওয়াই তার ধ্যানজ্ঞান ছিল। এখন এই চাকরি হওয়ার পরে নূপুরের মনে কী যে ভীষণ কষ্ট লাগছে- সে কথা কখনোই কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারা যাবে না। তখন তার মনে হচ্ছিল-‘মৃদুলকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে কোনোদিনও সে একা থাকতে পারবে না। একবার ভেবেছিল-সরকারি চাকরি হয় হোক। সে কখনোই এই পিজি হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে যাবে না। এখানেই চাকরি করবে। তবুও মৃদুলকে রেখে কিছুতেই এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়া যাবে না।’ সরকারি হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে চাকরি হওয়ার এক সপ্তাহ পরের এক বিকেলের ক্লান্ত আলোয় নূপুর বললো-‘দেখ মৃদুল। আমি তোমাকে এই ঢাকা শহরে রেখে বরিশাল শহরে চলে যেতে পারব না। তোমাকে চাকরি করতে হবে না। তুমি চাকরি ছেড়ে দেও। আমি সরকারি চাকরি করব। তুমি অন্য কিছু করবে। আমরা দুজনে এক সাথে বরিশাল শহরে থাকব। নতুন চাকরির শুরুতে চাইলেও আমি ঢাকায় বদলি হয়ে আসতে পারব না। বদলি হয়ে আসতেও বেশ কিছুদিন দেরি হয়ে যাবে। তুমি তো জানো, সরকারি চাকরির বদলি হওয়া অনেক ঝামেলা, তারপরও ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে আসা যায়। তবে সেটা আরও বেশি ঝামেলা। উপর মহলের লোকজনকে ধরাধরি করে বদলি হতে হবে। সেই সাথে টাকা পয়সারও একটি বিষয় জড়িত আছে। আমি চাইÑতুমি আমার সাথেই বরিশাল শহরে চল। বিয়ে করে ওখানেই নতুন সংসার শুরু করব’ -নূপুরের কথাগুলো শুনে মৃদুল কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলে না। নূপুর আবারো জানতে চাইলো-‘কী হয়েছে? কি হয়েছে তোমার? কোনো কিছু বলছো না যে? এই শহর ছেড়ে আমার সাথে তুমি চিরদিনের জন্য চলে যেতে পারবে না?’

মৃদুল অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকে। মুখ দিয়ে তার কোনো কথা বের হচ্ছিল না। সে আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর নিচের দিকে মুখ নামিয়ে বলতে থাকে—‘শোন নূপুর, ‘অবশ্যই আমি পারি। তোমার জন্য আমি চাইলে সবকিছুই করতে পারি। আমি জানি তুমি আমাকে গভীরভাবে ভালোবাস। শুধু ভালোবাসই না, যাকে বলে পাগলের মতো করে ভালোবাস। আমিও তোমাকে নিজের মতন করেই অনেক ভালোবাসি। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি খুবই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটি ছেলে। গ্রামের বাড়িতে আমার মা অসুস্থ, বাবা, ছোট ভাই-বোন নিয়ে একটি পরিবার আছে। আমি যে চাকরি করি, মাস শেষে বাড়িতে আমার পাঠানো টাকায় গ্রামের বাড়ির সংসারটি কোনো রকমে টিকে আছে। ছোট ভাইটা এখনো পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। বোনটিও বড় হয়ে যাচ্ছে। আমি কীভাবে চাকরি ছেড়ে তোমার সাথে চলে যাই। ধরে নিলাম- আমি সব ছেড়ে তোমার সাথে চলে গেলাম। ওখানে গেলেই তো সাথে সাথে এই চাকরির সমান টাকা আয়ের মতন কোনো কাজ খুঁজে পাব না। এখন যে রকম টাকা আয় করি, এ রকম আয় করতে না পারলে আমি তো জীবন চালাতে হিমশিম খেয়ে যাব। আমার পরিবার-পরিজন খুবই অসহায় হয়ে পড়বে। এখন তুমিই আমাকে সিদ্ধান্ত দিতে পার যে, আমি এখন কী করতে পারি।’—মৃদুলের কথায় নূপুরও বুঝতে পেরেছে যে, তার নিম্নবিত্ত পরিবারের কথা ভেবে চাকরিটি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বাকিটা জীবন মৃদুলকে ছাড়াই তাকে থাকতে হবে। জীবনের প্রয়োজনে হয়তো নতুন কোনো মানুষকে নিয়ে বাঁচতে হবে। তবুও সে মৃদুলকে অনেকবার বুঝিয়েছে—‘তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকতে অনেক কষ্ট হবে।’ তখন দুজনেই দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। নীরবে দুজনেই দু পথে চলে আসে। এরপর থেকে তারা নিজেরাই নিজেদের দূরত্ব বাড়াতে শুরু করল। যখন নূপুর সরকারি নিয়োগপত্র হাতে পেল; তখন পিজি হাসপাতালে যে চাকরি তা ছেড়ে দেয়। তারপর একদিন সে ঢাকা শহর ছেড়ে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করতে চলে আসে। যেদিন ঢাকা শহর ছেড়ে চলে আসে, সেদিন সদরঘাট থেকে সন্ধ্যায় যখন বরিশালের দিকে লঞ্চ ছেড়ে দেয়; তখন আকাশে কোনো মেঘ ছিল না। সারা রাত তার লঞ্চের কেবিনে ঘুমিয়ে কেটেছে। বাইরের কিছুই টের পায়নি। সকালে যখন বরিশাল সদরঘাটে লঞ্চ ভিড়েছে তার কিছুক্ষণ আগে নূপুর বুঝতে পারল যে, বাইরে প্রচুর বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি ভেজা সকালেই নূপুর বরিশালের মাটিতে পা রাখল। বরিশালে এসেও তার মন কিছুতেই স্থির হতে পারছিল না। যখন তখন পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। বিষণ্নতায় মুছড়ে পড়ে সে। শুধু মৃদুলের কথা কেবলই মনে পড়ে। যেন সে তার জীবনের প্রিয় অধ্যায়। তার স্মৃতি যেন এখনো হৃদয়ের আয়নায় বারবার ভেসে ওঠে। শেষমেশ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুলকে ভুলে যেতে রাজি হয়েছে। কালিপদ হালদার তার মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলে পছন্দ করে রেখেছে। পংকজ বাড়ৈ। নিজেদের গ্রামেরই ছেলে। কেমিস্ট্রিতে পড়াশোনা শেষ করে এখন একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। নূপুর যখন স্কুলে পড়ে তখন এই ছেলের কাছেই প্রাইভেট পড়তে যেত। শৈশব থেকেই চেনাজানা ছিল। কিন্তু নিজের জীবনে তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হবে, কখনো কোনোদিনও একথা ভাবেনি। মানুষের জীবন এমনই; যা কখনো কেউ ভাবে না, তাই জীবনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। মৃদুলকে তার জীবন থেকে দ্রুত ভুলে যেতে, অবশেষে তার বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ে করতে সে কোনো দেরি করেনি। বরিশালে চলে আসার এক মাসের ভেতরেই আষাঢ়ের এক বৃষ্টিভেজা শুক্রবারের সন্ধ্যায় আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে পংকজের গলায় সে মালাবদল করে। তারপর দ্বিতীয় জীবনের শুরু হয়। বিয়ে হলেও কোনোভাবেই মন থেকে পংকজকে মেনে নিতে পারছিল না। নতুন পরিবেশ। পুরোনো স্মৃতি হৃদয়ে বারবার উঁকি দেয়। সব সময়ই তার স্বামী ও তার পরিবারের লোকজনদের সাথে অভিনয় করেই কাটাতে হয়। রাত্রিকালীন দাম্পত্য চাষাবাদে সে শুধু নরম মাটি হয়েই পড়ে থাকে। উর্বর মাটিতে লাঙলের ফলার কাজ পংকজ নিজের মতো করেই চালায়। সেখানে নূপুরের কোনো মানসিক প্রশান্তি থাকে না। এভাবেই তাদের সংসার চলছিল। বিয়ের মাত্র কয়েক মাস যেতে না যেতেই নূপুর বুঝতে পারে-তার স্বামী তাকে ভীষণ রকম ভালোবেসে ফেলেছে। ধীরে ধীরে নূপুরও সবকিছু মেনে নিতে থাকে। এভাবেই দুজনের জীবন চলতে থাকে। সময় যত গড়িয়ে যায়, নূপুরের পেট ফুলে ঢোল হতে থাকে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে পংকজের মনেও আনন্দের ঢেউ বাড়তে থাকে। দিন যত যেতে থাকে—পংকজের মনে বাবা হওয়ার তীব্র বাসনা আরও তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। আগের চেয়ে স্ত্রীর প্রতি আরও অনেক বেশি আদর যত্ন বাড়তে থাকে। নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করতে যাওয়া থেকে শুরু করে কখন কি খাবে, সব কিছুই ডাক্তারের রুটিন মতো চলতে থাকে। পংকজ যেন সব কিছু নিজেই তদারকি করে। এভাবে এক স্বপ্নের ঘোরের ভেতরে দিনগুলো তার কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু পংকজের চোখে মুখে যতটা খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে; নূপুরের মুখে তার অর্ধেকও খুঁজে পাওয়া যায় না। সব সময় তার মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হতে থাকে।

তখন বৈশাখ মাস। চারদিকে তীব্র গরম। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে থাকা পংকজের শরীর থেকে ঝরঝর করে ঘাম পড়ছে। ডাক্তার যখন অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে বললো-‘আপনাদের বংশের বাতি হয়ে আলো জ্বালাতে ফুটফুটে সুন্দর এক ছেলে হয়েছে। আপনার ছেলের জীবন হয়ে উঠুক গৌরবময়।’-কথাগুলো শুনতে শুনতেই পংকজ যখন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে ছেলের মুখ দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে; তখন পাশেই বিছানায় শুয়ে থাকা নূপুরের চোখে মুখে গভীর অন্ধকারের ছাপ ফুটে ওঠে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কেবলই তার চোখে মৃদুলের চেহারা ভেসে ওঠে। সে গভীর শঙ্কায় পড়ে যায়। সে চিরকাল এই বাতি জ্বালিয়ে রাখতে—তার মায়াবি বিশ^স্ততায় সত্য গোপনের শক্ত পথ খুঁজতে থাকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :