পাঠ প্রতিক্রিয়া: শেষ কিস্তি
বঙ্গবন্ধু: বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি
প্রকাশ | ১১ মে ২০২৩, ১৯:১৯ | আপডেট: ১১ মে ২০২৩, ১৯:২৯
রাজনীতিতে তারকাসুলভ নেতা খুব একটা পায়নি বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন-বোনা আকাশের তারকা, রূপকথার নায়ক। তাঁর জন্মের শতবর্ষ পর মনে পড়ে, কীভাবে তাঁর নামে অসংখ্য সাধারণ বাঙালি হেলায় হেসে প্রাণ দিয়েছেন।
এই সবই চেনা কথা, জানা ইতিহাস—তবু শতবর্ষ পরে এসে ভাবতে ইচ্ছে করে, যতটা বলা হয়, ততটাই কি তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু গবেষক কবি জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম তাঁর লেখা ‘বঙ্গবন্ধু: বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্বিক কিংবদন্তি’ বইতে মমতা ব্যানার্জীর সত্য অনুধাবন সুন্দরভাবে তুলে দিয়েছেন—
‘এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়।’
বঙ্গবন্ধুর আর এক জরুরি মূলধন ছিল, আত্মত্যাগের সাহস, এমনকি দুঃসাহস। কৈশোর থেকে শুরু করে কত সময় যে মুজিব কারাগারে কাটিয়েছেন, ইয়ত্তা নেই। চল্লিশের দশকে, পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে। কত বার একাকী বন্দি বা সলিটারি কনফাইনমেন্টে থেকেছেন ইয়াত্তা নেই। তবুও কখনো তিনি হিংসাপরায়ন হননি। এই বিষয়ে লেখক তাঁর বইতে লিখেছেন—
‘প্রায় দুইযুগ ধরে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূলধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে, সম্মুখ নেতৃত্ব দিয়ে, জীবদ্দশার বিরাট একটা সময় ক্রমাগত জেল-জুলুম, অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়েও তাঁর হাত কখনও কারও মৃত্যু পরোয়ানার দায়ে রঞ্জিত হয়নি।’
১৯৫৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের পরিবর্তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন নেমে আসার পর শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা—অকুতোভয় প্রতিবাদী, জেদি, জাতীয়তাবাদী নেতা। নিয়ে এলেন তাঁর ছয়দফা দাবি, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের এক অসামান্য রাজনৈতিক চাল। সারা দেশ, বিশেষত গ্রামের মানুষ, প্রবল ভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল তাঁর এই কর্মসূচিতে।
১৯৬৯ সালে ৫ ডিসেম্বর তারিখটি লাল কালিতে রাঙিয়ে রাখার মতো। বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের একটি নতুন নাম দিলেন: বাংলাদেশ। বললেন, ‘‘এক সময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা হইয়াছে।...একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।’’
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের গণপরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে একাত্তরের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা-ভিত্তিক সংবিধানে অনুগত থাকার শপথ নিলেন। বিপদ বুঝে ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গণপরিষদকে স্থগিত করে দিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনও কথাই বললেন না। ঢাকার রাস্তায়, অলিতে-গলিতে তখন নেমে এসেছে মানুষের ঢল।
১ মার্চ থেকে ব্যাপক ধরপাকড় চলল, ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের ঘোষণা মুখে নিয়ে কারাবরণ করলেন—নয় মাসের কারাবাস—ফিরলেন বাহাত্তরের ৮ জানুয়ারিতে। ততদিনে বাংলার মাটি রক্তে ভাসিয়ে, অসংখ্য প্রাণ বলিদানের মূল্যে, লক্ষ লক্ষ নারীর মর্যাদাহানির পরে সফল হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। লেখকের বইতে যুদ্ধের একটি নৃশংস খন্ড চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন—
‘গর্ভবতী মাকে ধর্ষণ করার পর তার ভ্রুণ হত্যা করে পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠত তারা। তাদের এই উন্মত্ততা শ্বাপদের হিংস্রতাকেও হার মানিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যার উদাহরণ তারা সৃষ্টি করেছিল বাংলার ভূখন্ডে। এ যুদ্ধে কোনো সামরিক রীতি-নীতির অনুসরণে পরিচালিত হয়নি। সুপ্রতিষ্ঠিত ও অস্ত্রসচজ্জিত একটি সামরিক বাহিনী সেদিন প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার নিরস্ত্র অসহায় সাধারণ মানুষের ওপর।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তা মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের বিরাট স্তম্ভ। কেবল তা-ই নয়। সেই বাহাত্তরের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে শেখ মুজিব যখন লন্ডন হয়ে দিল্লিতে এলেন ১০ জানুয়ারি, তাঁর জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনা বরাদ্দ রেখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর। হিসেব পরিষ্কার। ভারতের স্বীকৃতির পর নবজাত বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশও স্বীকার করতে এগিয়ে আসবে। এই বিষয়ে লেখক তাঁর বইতে লিখেছেন—
‘বন্ধুত্বের সম্পর্কের নন্দনতত্ত্ব আলোচনায় যুদ্ধ পরবর্তী ঔদার্যের যে ইতিহাস সূচিত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, সে ইতিহাসও পৃথিবীতে একমাত্র।’
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে কী দেখলেন বঙ্গবন্ধু? দেখলেন, সাম্প্রদায়িক দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এ-ধারে ও-ধারে। সে এক নতুন পরিস্থিতি। মৌলবাদী দলগুলো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোপন প্রচার করছিল, শয়তানের হাসি হাসছিল। দেখলেন, তাঁর বহু সহ-নাগরিক মনে করছিলেন ভারতের ক্ষমতার ছায়ায় ঢোকানো হচ্ছে বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ধারালো হচ্ছিল আক্রমণ।
ব্যর্থ হল কি এত যন্ত্রণাভোগ, এত দাম দেওয়া? তবু আশা রাখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মনে করলেন, ‘অবাধ স্বাধীনতার আকস্মিক স্বাদ ও হাতে আসা নগদ অর্থ দিশাহারা করেছে অনেককে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও প্রতিষ্ঠান করে এদের দায়িত্ব-সচেতন করা হবে। দেশটা তো শুধু মধ্যবিত্তের না, গরিব দুঃখী মানুষের। তাদের অবস্থার পরিবর্তন যদি করতে পারি, তবেই অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। আমার দেশের মানুষ আমাকে জাতির পিতা বলে, কত জন আমার জন্য রোজা রেখেছে, জান দিয়েছে। আমার দায়িত্ব বড় বেশি।’
এবার আসি লেখক বঙ্গবন্ধুকে কেন বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্বিক কিংবদন্তি বলেছেন। এর দু-একটি কারণ এখানে উল্লেখ করলেই বিষয়টি প্রমাণিত হবে। ‘বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করে সামরিক শাসক সরকার। কর্নেল (অব.) শওকত আলীও অভিযুক্ত ছিলেন এই মামলায়।
জানা যায়, তিনি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, কী ভাগ্য আমাদের জন্য ভবিষ্যতে?’ বঙ্গবন্ধুর কোনো ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন হলো না। তিনি বলেছিলেন—‘জনরোষে পড়ে তারা এ বিচার করতে পারবে না। একটা নির্বাচন হবে যেখানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। কিন্তু সামরিক জান্তারা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।’ আদতে হয়েছিলও তাই। রাজনৈতিক আধ্যাত্বিকতা ছাড়া কি এটা আগাম অনুধাবন সম্ভব? ভাবুন তো ৭ই মার্চের অনন্য অবিকল্প শব্দমালা আর শারীরিক শৈলীর কথা?
বিশ্বের একমাত্র তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান; তিনিই কেবল অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ৮০-এর দশকে রেড আর্মি থাকবে না। পৃথিবী পশ্চিমে একমুখী ঝুঁকে পড়বে। তাই তিনি সময় বিবেচনা করে তার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সমগ্র জাতিকে এক মন্ত্রে দীক্ষিত করে।
অনেক সাফল্যের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু অত্যধিক বিশ্বাসপ্রবণতায় ভুল মানুষের ওপর বিশ্বাস করে ঠকেছিলেন। একাত্তর-পূর্ব যুগের গণতন্ত্রের প্রধান প্রবর্তক একাত্তরের পর ভুল মানুষের ওপর অধিক বিশ্বাসের ফলে তিনি গণতন্ত্রকে চুড়ান্ত সবলতা দিয়ে যেতে পারেননি। সেই না-পারার মূল্য চুকিয়েছেন নিজের প্রাণ দিয়ে।
১৯৭৫ সালে যখন দেশ-শত্রুদের হাতে তাঁর প্রাণ গেল, বিমূঢ় নবজাত দেশটি আবার পাকিস্তানে মিশে যাবেই, এমন আশঙ্কা যখন দুনিয়াজোড়া, তারপরও যে বাংলাদেশ রয়ে গেল, বেঁচে গেল, সাম্প্রদায়িক ও সামরিক শক্তির বোঝাপড়া করতে করতে নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল—পূর্ব বাংলার মানুষের সেই মনের জোর, রাজনীতির জোর, সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা কি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহ্য থেকেই স্ফুরিত হয়নি? তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা কি সেই ঐতিহ্যের ওপর ভর রেখেই দেশকে সাফল্যের মুখ দেখাননি? সামাজিক উন্নয়ন আর রাজনৈতিক স্থিতিতে দেশকে পৌঁছে দেননি? এ তো বঙ্গবন্ধুরই উত্তরাধিকার, তাঁর সর্বজনহিতের লক্ষ্য। ‘গরিব দুঃখী মানুষের মুক্তি’ নিয়ে তাঁর দুর্ভাবনার ফসল।
আসলে স্বাধীনতাই হোক, আর সর্বজনহিতই হোক, এ সবের উত্তরাধিকার বোধহয় অলক্ষ্য, অবয়বহীন। আপাত-ব্যর্থতা, সাময়িক পরাজয়, এমনকি নৈরাজ্য আর বিনাশের মধ্যেও তা লুকিয়ে বসে থাকে, অপেক্ষা করে চলে, সুযোগ পেলেই ছড়িয়ে যেতে থাকে, রাতারাতি উবে যায় না।