যুগের নাম শেখ হাসিনা যুগ

প্রকাশ | ১৭ মে ২০২৩, ১৮:০২ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৩, ১৮:০৭

শেখ স্বাধীন শাহেদ

১৯৬৫ সাল, নতুন গঠন করা Board of Intermediate and Secondary education, East Pakistan এর অধীন ম্যাট্রিক পরীক্ষা চলছে। কেন্দ্রের কড়াকড়ি তো ছিলই, ছিল সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অধিকার। ব্রিটিশদের দেখাদেখি পাকিস্তানের পরীক্ষকরাও শিক্ষার্থীরা কেউ প্রথম শ্রেনীর লেখা লিখতে পারে, তা বিশ্বাস করতেন না। বরং ফেলের সংখ্যাটা এত বেশি যে কেউ ম্যাট্রিক পাস করলে লোকজন তাকে দেখতো আসত। সবগুলি প্রশ্ন সঠিক লিখে আসতে পারলেই কেবল বুকে বল রাখা যেত যে ৪০ পাওয়া যাবে। একটা প্রশ্ন লিখতে না পারলেই আর ভরসা করা যেতনা। পরীক্ষকের কৃপা আর সৃষ্টিকর্তার অনুকম্পা এই দুইয়ের নিক্তিতে ঝুলে থাকত পরীক্ষার্থীর পাসফেল। এমন এক সময় সমাজ বিজ্ঞান পরীক্ষায় পাকিস্তান বিষয়ে ছিল কুড়ি নাম্বার। যেখানে একটা প্রশ্ন ছাড়লে ফেল করার সমূহ আশংকা থাকে, সেখানে সম্পূর্ণ কুড়ি নাম্বার না লেখা একজন পরীক্ষার্থীর কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন যিনি এবং কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছিলেন যিনি তিনিই শেখ হাসিনা। জনকের কন্যা, আমাদের দেশরত্ম।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সে দুর্দমনীয় সাহস তা তিনি পেয়েছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে তার বাবার গল্প শুনে শুনে। ক্রমে বিপদ এসেছে আর তা মোকাবেলা করে তিনি হয়েছেন আরও আরও সাহসী। দুঃসাহসিক নাহলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তাকে যখন ইউরোপ থেকে এক অর্থে রিফুজি করে বিতারিত করা হয় তখনই তিনি নিঃশেষ হয়ে যেতেন। তার কাছে মাত্র ৩০ ডলার, তার স্বামী চাকুরীহীন! এই অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি এলেন ভারতে। ইন্ডিয়াগেট সংলগ্ন পান্ডারা রোডের ১টা ফ্ল্যাটে বাংলাদেশের জনকের কন্যার ঠাই হল!

দুটি বেডরুম, একটি ড্রয়িংরুম। দেশ বিদেশের খবর শোনার জন্য একটি ট্রানজিস্টার! আর শেখ হাসিনার স্বামী ডা. ওয়াজেদ মিয়া ভাতা পেতেন ৬২ রুপি! এইতো বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির মেয়ের জীবন। সেনাবাহিনী রুম বুঝিয়ে দেবার সময় আরও তিনটা ‘সম্বল’ দিয়ে যায় চলে যাওয়ার সময়। (১) কারো কাছে পরিচয় না দেওয়া, (২) বাইরে বের না হওয়া, (৩) দিল্লীর সঙ্গে যোগাযোগ না করা! আহারে জীবন! আহা জীবন।

জীবন আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে যখন ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজী দেশাই। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর অন্যান্য কাজগুলোর মত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়াও ভাল ভাবে গ্রহণ করেননি। অলিখিতভাবে তাকে বলে দেয়া হল, চলে যাও, ভারতে তোমাদের থাকা হবেনা! বিদ্যুৎ বিল দেয়া বন্ধ করে দিল মোরারজি সরকার। গাড়ির সুবিধা তুলে নিল। একই সময়ে বাংলাদেশে চলছে আওয়ামীলীগকে আমলীগ করার হীন পায়তারা। বেহায়া মুশতাকের সঙ্গে জেনারেল ওসমানী আওয়ামীলীগের মোড়কে পাকিস্তানি দোসরদের পা চাটছেন। জেলের মধ্যেই খুন হলেন জাতীয় চারনেতা। অন্য যারা ছিলেন, সবার নামেই হুলিয়া জারি হল। দেশে থাকতে পারলেন না কেউই। যারা ছিলেন তারা রাজনীতির সঙ্গে থাকতে পারেন নি। থেকেছেন ঝড়-জঙ্গলে, অথবা বন বাঁদারে পালিয়ে। মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামীলীগকে নিয়ে ব্যবসা করলেন। কেউ না থাকায় নিজেই কমিটি করেন, নিজেই ভাঙেন। জিয়াউর রহমান জানিয়ে দিলেন, শেখ মুজিবের নামের আগে বঙ্গবন্ধু থাকলে আওয়ামীলীগকে নির্বাচন করতে দেয়া হবেনা। সাজেদা চৌধুরিরা তা মানেন নি। বরং সাজেদা চৌধুরি প্রস্তাব করলেন, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে এনে আওয়ামীলীগের সভাপতি করার। সেখানেও বাধা আসল। মিজানুর রহমানরা তো ক্ষমতার লোভেই এ সিদ্ধান্ত মানলেন না। অন্যান্য যারা তারা বললেন, ও বাচ্চামেয়ে! ওকি পারবে? সাজেদা চৌধুরির জবাব ছিল, ‘বাচ্চা হলেও বাঘের বাচ্চা’ (উত্তরন, জুন, ২০১৪)।

স্বয়ং এম ওয়াজেদ আলী তার ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের প্রতিহিংসার রাজনীতিতে নিজের পত্নীকে জড়াতে দিতে চাননি। চাননি ইন্দিরা গান্ধীও বঙ্গবন্ধু তনয়ার নিরাপত্তার কথা ভেবে। সাজেদা চৌধুরিকে সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘Not now. By time will come. I will say, not now।’ ইন্দিরা গান্ধি এবং ওয়াজেদ আলীর শঙ্কা অমূলক ছিলনা। কারণ ইতোমধ্যেই জিয়া তার ‘I will make politics difficult for the politicians’ কাজে শতভাগ সফল হয়েছিলেন।

আর এত প্রতিকূলতার মাঝে বাঙালির আশার শেষ বাতিঘর শেখ হাসিনার জবাব ছিল এমন ‘পার্টিই যদি ভেঙে যায় তাহলে আমি পরে দেশে গিয়ে কি করব। হয় এখন, নাহয় কখনোই না।’ বিদেশে থাকা অবস্থাই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামীলীগের কাউন্সিল হয়। শেখ হাসিনাকে করা হয় সভাপতি। শতবাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি তার বাবার রেখে যাওয়া স্বপ্নকে পূরণ করতে এলেন প্রিয় বাংলাদেশে। জিয়ার কড়া প্রহরা, সেনা শাসনের রক্তচক্ষু, আওয়ামীলীগের নামে জিয়ার কুকুরদের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে সেদিন বৃষ্টি স্নাত ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। আবালবৃদ্ধবনিতা, হিন্দু মুসলিম খৃস্টান, কোটিপতি থেকে রাস্তার ফকির সবাই সেদিন তাদের হাসু আপাকে স্বাগত জানায়। আর সবার অন্তরালে প্রিয় হাসু আপা বৃষ্টির জলে নিজের চোখের পানি যেন লুকিয়েছিলেন।

সেই যে শুরু, তারপর তার সামনে যে বাধাই এসেছে, তাকে তিনি জয় করেছেন। তাকে তো মেরেই ফেলার চক্রান্ত হয়েছে বিশ বারের বেশি! গণতন্ত্র উদ্ধার করার সংগ্রামে নির্যাতিত হয়েছেন। ১৯৯১ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর দল ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে আবার। তিনি অটুট ছিলেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি প্রহসনের নির্বাচন করলে, কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়েন। শেখ হাসিনা লড়াই করেছেন। ২০০৪ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য হামলায় তাকে মৃত্যুর কোল থেকে এদেশের মানুষের দোয়াই কেবল ফিরিয়ে এনেছিল। তিনি তারপরেও ভয়ে চুপসে যাননি।

২০০৭ সালে সেনা শাসনে সময় তিনি কানাডা অবস্থান করছিলেন। তার দেশের ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। তিনি আল-জাজিরা টেলিভিশন মারফত এদেশের ১৪ কোটি জনগণকে জানিয়ে দিলেন ‘বাংলাদেশে আমার জন্ম, ঐ মাটিতেই আমার মৃত্যু হবে। কোন হুমকিই আমাকে দেশে ফেরা হতে বিরত রাখতে পারবেনা ‘ তিনি দুরধিগম্য। সব বাধা ভেঙে দেশে আসলেন আজকের এই দিনে। কেউ তাকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি তৈরি হয়নি যে শেখ হাসিয়াকে ভয় দেখাতে পারে। আমেরিকার কথাই বলি। আমেরিকার একটা সাধারণ র‍্যাপার গায়ক যদি র‍্যাপের সঙ্গে বাংলাদেশকে হুমকি দেয়, এদেশের বহু লোক আছে যারা ভয়ে চুপসে গেছে। যখন দেশের আইন অমান্য করে জোড়পূর্বক ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান রাখা হয়, তখন বহুবার আন্দালিব রহমান পার্থসহ এদেশের বহু নেতা ভয়ে প্যান্ট ভেজাতেন। অনেক টিভি শোতে তারা তা বলতেনও। এক টিভি শোতে আন্দালিব বলছিলেন ‘আমার ফোনে সর্বোচ্চ খালেদা জীয়ার ফোন আসে। আর ইউনুসের ফোনে হিলারি ক্লিনটন এর কল আসে।’ সেই হিলারি ২০১১ সালে ১৬ জানুয়ারি যখন ইউনুসের পক্ষ থেকে ঐ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সুপারিশ করতে টেলিফোন করেন তখন এ প্রান্ত থেকে শেখ হাসিনার স্পষ্ট জবাব, ‘এটা আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যপার। আপনি চিন্তিত হবেন না।’ কোন পর্যায়ের কঠিনীকৃত মানসিকতা থাকলে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রিকে এভাবে কেউ উত্তর দিতে পারে তা নিয়ে একদিন গবেষণা হবে।

সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল শেখ হাসিনার দিকে তারও পর যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন পদ্মাসেতু হবে নিজেদের টাকায়। সারা বিশ্ব একদিক তিনি অদম্য একদিক। বিশ্বব্যাংক মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। বিশ্বব্যাংক ঘুরল ৯০ ডিগ্রী, তিনি ১৮০ ডিগ্রী। কোন কোন বিশ্বনেতা বলে বসলেন, বাংলাদেশ আবার তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হতে চলেছে। এদেশের জ্ঞানপাপীরা বলল, ধ্বংস হয়ে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ফখরুলরা বলল, পিলার ও বসবেনা! আরও কত কি? কিন্তু বাস্তবে আজ আমরা কি দেখছি। পদ্মাসেতুও হচ্ছে, আমাদের জিডিপিও ৭.৭! আমরা একই বছর হেফাজতে মতো ধর্মীয় ধুরন্ধরদের দেখি। আমরা দেখেছি এরশাদ চাচা পানি এগিয়ে দিয়েছেন তাদের, খালেদা ম্যাডাম মদদ দিয়েছেন তাদের। এমনকি স্বাধীনতা বিরোধী জোট শেষ পর্যন্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে তো নালিশ করেছেই। কিন্তু ন্যায় এবং সাংবিধানিক পবিত্রতা রক্ষায় শেখ হাসিনাকে কেউ টলাতে পারেনি। একই ধারাবাহিতা আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার সময়েও। পাকিস্তান তার এদেশীয়  বাচ্চাকাচ্চাদের বাঁচাতে মায়া কান্না শুরু করল। পাকিস্তানের দোসর হল তুরস্কও। তারা চিঠি পর্যন্ত লিখে থামাতে চাইল শেখের বেটিকে।

কিন্তু রক্তে যার আবহমান বাংলার সবচেয়ে সাহসী ধারা প্রবাহমান তাকে ভয় দেখানো যায়না। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান এবং তুরস্কের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে জানিয়ে দেয়, ‘এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। কোন মাতবারী বাইরে থেকে করা যাবেনা।’ অন্যদিকে, সেই পাকিস্তানেরই বুদ্ধিজীবীরা আজ চিৎকার করে বলছে, খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানাদে! আর তুরস্ক রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশরত্মের ভুমিকায় স্যালুট জানিয়ে গেছে মাথা নিচু করে। ঋষি সুনাক বাধ্য ছাত্রের মত এক ধরনের জুবুথুবু হয়েই বলেন, ‘আমার মেয়েরা আপনাকে(শেখ হাসিনা) অনুসরণ করে, আপনার মতো হতে চায়।’ পদ্মাসেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বিশ্বব্যাংকের মুখের সামনে শেখ হাসিনা সাঁটিয়ে দিয়ে আসেন পদ্মাসেতুর চিত্রকর্ম। সে সময় বিশ্বব্যাংকের এমডির মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সময় শেখ হাসিনাকে জন্ম দেয়নি। শেখ হাসিনা নিজেই নিজের একটা সময় তৈরি করেছেন। The Sheikh Hasina's Era.

লেখক- শেখ স্বাধীন শাহেদ, এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।