অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বৃক্ষ নিধন রোধ করুন, বৃক্ষ রোপণ করুন

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২৩, ১৫:৫৫

জুনায়েদ মাসুদ

'বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু' একথা শোনেনি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। তবে ক'জন এ কথাটিকে গলাধঃকরণ করতে পেরেছে তা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট। যে নৌকা নদী পার করে সে নৌকায় ফুটো করা কি আদৌও বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে? অবশ্যই নয়। অক্সিজেন আমাদের বেচে থাকার নেয়ামক আর বৃক্ষ তার একমাত্র উৎস। অক্সিজেন ছাড়া শুধু আমরা মানুষেরাই নই সৃষ্টিকুলের কোনো প্রাণীর

পক্ষে বেচে থাকা সম্ভব নয়। একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষ যখন এটা জানবে, বুঝবে এবং অনুধাবন করতে পারবে তখন সে বৃক্ষ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন থাকবে।

বৃক্ষের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আমরা যেমন স্নান করি এবং শুভ্র বস্ত্র পরিধান করি তেমনি বাড়ির চারপাশে যত্নপূর্বক একটি বাগান করে রাখা ভদ্রপ্রথার একটি অবশ্য কর্তব্য হওয়া উচিত।'

সাম্প্রতিক রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে নগর উন্নয়নের নামে ডিভাইডার সংস্কার প্রকল্পে নির্বিচারে গাছ নিধনের ব্যাপারটি জাতীয় আলোচনায় এসেছে। যা প্রশাসনের অপরিনামদর্শীতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আরো উন্নত শ্রেণির গাছ লাগানোর আশ্বাস দেয়। তবে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

একটি সুস্থ নগরীতে যেখানে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা জরুরি সেখানে ঢাকা নগরীতে রয়েছে ৮ শতাংশেরও কম। যার পেছনে বিভিন্ন ধরনের অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন প্রকল্প দায়ী। ইতোপূর্বে, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় পার্ক, ফুটপাত, বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের জন্য অসংখ্য গাছ নিধন করা হয়েছে।

নগর উন্নয়ন মোটেও অসমীচীন কিছু নয় তবে গাছ কেটে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা মোটেও ভালো কিছু হতে পারেনা৷ সাম্প্রতিক জরিপে এসেছে যে, বিগত দশকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোর তুলোনায় ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। আর যার পেছনে পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা অপরিকল্পিতভাবে গাছ নিধনকে দায়ী করেছেন।

নগর উন্নয়ন লক্ষ্যে গাছ কাটা হলেও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে অবশ্যই আরো বেশি বৃক্ষ রোপণ করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। সে অনুযায়ী প্রশাসনের উদ্যোগ দেখা গেলে তা দীর্ঘস্থায়ী ফল প্রকাশ পায়না।

উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ঢাকা নগরীর উন্নয়ন তরান্বিত করলেও আমাদের কিছু বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হবে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ। সিইজিআইএর হিসাব বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ হারে ক্ষতি হচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশের জিডিপির আকার ছিল ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। সেই হিসোবে প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি ডলার। অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি নদী ভাঙন, ক্ষরা, অনাবৃষ্টি, জলচ্ছাসসহ আরো বিভিন্ন আকস্মিক প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঘটনা অহরহ ঘটছে যার ফলে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে৷ ফলে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জাতিসংঘের আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বহুবিধ কাজের প্রধানত সাতটি কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তন্মধ্যে বৃক্ষরোপণের হার বৃদ্ধি অন্যতম একটি পদক্ষেপ।

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে বৃক্ষরোপনের চেয়ে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি আর হতে পারে না। প্রয়োজনের তাগিদে গাছ কাটা হলেও দেশগুলোকে বৃক্ষ রোপণের হার বাড়াতে হবে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানায়, “বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস দূর করতে হবে”। বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূর করতে গাছের বিকল্প নেই। গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন করতে বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে। পরিবেশবাদী এবং বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে বৃক্ষনিধন বন্ধ করার দাবির পিছনে এটি একটি বড় যুক্তি। 

নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। এ অবস্থার আশু পরিবর্তন আবশ্যক। এ লক্ষ্যে অধিক হারে বৃক্ষরোপণের জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। জাতীয় গণমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও এ মহৎ উদ্যোগের অংশীদার করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।

জুনায়েদ মাসুদ, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা