জেনে নিন ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কিভাবে সাজানো-পাতানোও হয়!

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২৩, ১৭:০০ | আপডেট: ২৪ মে ২০২৩, ১৭:২৮

রুদ্র রাসেল, ঢাকা টাইমস

জজ মিয়াকে মনে আছে? বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে কিভাবে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিল তাঁকে। কিভাবে নির্যাতন করে ১৬৪ ধারায় ‘সাজানো’, বানানো’ স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল নিরীহ ওই যুবককে। কিভাবে বাধ্য হয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে জজ মিয়া বলেছিল—একুশে আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে সে নাকি নিজে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। এই স্বীকারোক্তির বিষয়টি ছিল আসলে একটি নীলনকশা, ষড়যন্ত্রের অংশ।

অথচ এই সাজানো, পাতানো স্বীকারোক্তির কারণে নোয়াখালীর সেনবাগের বীরকোট গ্রামের নিরীহ মো. জালাল ওরফে জজ মিয়ার জীবন, পরিবারই তছনছ হয়নি—দীর্ঘকাল প্রকৃত ঘটনাও আড়াল থেকেছে।

এ ঘটনার আগের বছরই ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রে ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২১ আগস্ট মামলায় জজ মিয়া নাটক তৈরির ক্ষেত্রে পুলিশ হাইকোর্টের এ রায় আমলেই নেয়নি।

তবে জজ মিয়া নাটক দিয়েই জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দি নেওয়ার ইতি ঘটেনি। এরপরও নানা সময়ে বেশ কয়েকটি মামলায় জোর করে স্বীকারোক্তি নিয়ে নিরপরাধকে ‘অপরাধী’ বানানোর খবর প্রকাশ হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনা মীমাংসার কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য অথবা প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে ব্যর্থতা ঢাকার জন্য কিংবা নিজে অথবা বিভিন্ন পক্ষকে অনৈতিকভাবে লাভবান করানোর জন্য তদন্তকারীরা কখনো-সখনো নানা কার্যকলাপ ঘটিয়ে থাকেন। জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দি আদায় এই বেআইনি কার্যক্রমের অংশ। যেটাকে ১৬১ বা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে অনেক নিরপরাধ ফেঁসে যান। আবার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহারের ধারাবাহিকতার কুফলও এ ধরনের ঘটনার পেছনে দায়ী।

জজ মিয়া নাটক কিংবা নারায়ণগঞ্জে কিশোরী খুনের মামলায় আসামিদের কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর ওই কিশোরীর জীবিত ফিরে আসা; চট্টগ্রামে হত্যা মামলায় আসামির স্বীকারোক্তির পর নিহত ব্যক্তির ফিরে আসা; বরিশালে স্বামী খুনের মামলায় স্ত্রীর কথিত স্বীকারোক্তির পর চোরদের হাতে সেই খুন হওয়ার তথ্য উঠে আসায় প্রশ্নের মুখে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ স্বীকারোক্তি। এমন আরও বেশ কিছু ঘটনা আছে।

এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তকারীদের নানা ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। বারংবার আলোচনায় এসেছে ১৬১ ও ১৬৪ ধারায় আদায় করা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। এর বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা তাই কখনো কখনো প্রশ্নের মুখে পড়ে।

জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় ‘মারাত্মক অপরাধ’

২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়ায় ৮ বছরের এক শিশুর মরদেহ উদ্ধারের মামলায় ২০২১ সালের ২২ আগস্ট জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় ‘মারাত্মক অপরাধ’ বলে উচ্চ আদালত মন্তব্য করেন। বগুড়ার সারিয়াকান্দির কাটাখালী গ্রামের মহিদুল ইসলামের ৮ বছরের ছেলেকে হত্যা এবং ওই ঘটনায় তারই ১২ বছরের আরেক ছেলেকে গ্রেপ্তার করে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করে থানা পুলিশ।

এ ঘটনায় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ৫ আইনজীবী হাইকোর্টে আবেদন করেন। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা (সারিয়াকান্দি থানার) তৎকালীন উপপরিদর্শক নয়ন কুমার লিখিত আবেদন দিয়ে তদন্তে ভুলের জন্য আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান।

শিশু হত্যায় দুই আসামির স্বীকারোক্তি, পরে শিশুটিকে উদ্ধার:

২০১৪ সালের এপ্রিলে ঢাকার হাজারীবাগে অপহৃত হয় পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া ছাত্র আবু সাঈদ। পরে হত্যার অভিযোগে মামলায় পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। ১৬৪ ধারায় দুজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে গ্রেপ্তার ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বিচারের শেষ পর্যায়ে শিশুটি উদ্ধার হয়।

পরে জানা যায়, আবু সাঈদ অপহৃত হয়নি। তাকে লুকিয়ে রেখে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। মামলার আসামিরা জানান, থানায় আটকে অমানুষিক নির্যাতনের পর তারা পুলিশের কথামতো স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হন।

স্বামী হত্যায় নারীর স্বীকারোক্তি, পরে জানা যায় চোরের হাতে খুন

২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বরিশালে নিজ ঘরে খুন হন রেজাউল করিম রিয়াজ। পুলিশ তদন্তে নেমে রিয়াজের স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজা ও তার কথিত প্রেমিক মাসুম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্থায় ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি স্বামী হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন লিজা।

পরে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে গোয়েন্দা বিভাগ তিন চোরকে গ্রেপ্তার করে। তারা রিয়াজের ঘরে চুরি করতে ঢুকলে জেগে ওঠায় তাকে কুপিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়।

পরবর্তীকালে সংবাদ সম্মেলন করে লিজা জানান, রিয়াজ খুন হওয়ার সময় তিনি অন্য কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তাকে অমানুষিক নির্যাতনসহ যৌন নির্যাতন করারও অভিযোগ করেন। এমনকি শেখানো স্বীকারোক্তি না দিলে আবারও রিমান্ডে এনে নির্যাতনের ভয় দেখানো হয় তাকে।

অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধারের পর হত্যার মামলা সাজিয়ে স্বীকারোক্তি

চট্টগ্রামে অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল পুলিশ বাদী হয়ে হালিশহর থানায় একটি হত্যা মামলা করে। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল জীবন চক্রবর্তী ও দুর্জয় আচার্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জীবন চক্রবর্তী আদালতে গাঁজা খাওয়ার ঘটনা কেন্দ্র করে দিলীপ রায়কে হত্যা করেছে বলে জবানবন্দি দেন। তবে এর কিছুদিন পরে দিলীপ রায় জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেন।

পরে দুর্জয় চক্রবর্তীর এক আবেদনে হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিলীপ এবং মামলার নথিসহ তদন্ত কর্মকর্তা ও দুই আসামিকে হাজিরের নির্দেশ দেন।

হাইকোর্টে শুনানিতে ফিরে আসা দিলীপ বলেন, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে সর্ম্পক ছিন্ন হয়। এ কারণে মামলার ভয়ে কিছুদিন বোনের বাড়িতে ছিলাম।’ অন্যদিকে আসামি দুর্জয় ও জীবন ক্রসফায়ার ও পুলিশের মারধরের ভয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন বলে জানান।

ধর্ষণ শেষে হত্যার পর শীতলক্ষ্যা নদীতে, পরে জীবিত ফেরত

২০২০ সালের ৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী নিখোঁজের এক মাস পর ৬ আগস্ট ওই ছাত্রীর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব এবং খলিল নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ওই বছরের ২৩ আগস্ট ওই ছাত্রী ফিরে এলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। পুলিশ নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে বলে আসামিদের স্বজনরা অভিযোগ করেন।

‘কতটা ভয়ংকর খেসারত কেবল ভুক্তভোগীই জানে’

এই ঘটনাগুলোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঢাকা টাইমস কথা বলেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট এলিনা খান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খানের সঙ্গে।

তারা বলেন, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে স্বীকারোক্তি ও জবানবন্দি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে জোরপূর্বক বা সাজানো স্বীকারোক্তি সর্বনাশ ডেকে আনে নিরপরাধ মানুষের জীবনে। একই সঙ্গে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে চলে যায়।

যে ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধ সম্পর্কে জানেনই না, তাকে ফাঁসিয়ে বা নির্যাতন করে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেওয়া ভয়ংকর। এর কতটা খেসারত দিতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগী হলেই অনুভব করা যায়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ও আদালত সংশ্লিষ্টরা পেশাগত শপথ মেনে সততা ও পেশাদারিত্বে অটল থাকলেই এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দি গ্রহণ করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ হতে পারে।

‘নির্দোষ দোষী হলে আসল দোষীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি মামলায় সত্যিকার দোষী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। একটি ফৌজদারি মামলায় যিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা থাকেন, তার সততা ও দক্ষতা দোষী ব্যক্তিকে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা থাকে।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন পেশাগত দায়িত্ব ও বিবেক বিসর্জন দিয়ে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হলে অনেক সত্যিকার দোষী ব্যক্তি আইনের আওতায় না এসে নির্দোষ ব্যক্তি সাজানো সাক্ষ্য-প্রমাণের কারণে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন।

এর ফলে একদিকে জনগণ বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারায়। অপর দিকে দোষী ব্যক্তিরা সমাজে নির্বিচারে জঘন্য কর্মকাণ্ড চালাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে স্বাভাবিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, জনগণের জানমাল বিপন্ন হয়।

যা বলছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বেশকিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হলেও সাজানো স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দি সাজানো হলে এটি অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। জজ মিয়ার ঘটনার মতো যদি কোনো স্বীকারোক্তি হয়, সেটি অবশ্যই মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আইনের বিধান লঙ্ঘন করে যদি স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় তা কখনোই মেনে নেওয়ার মতো নয়।’

এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উত্তরণের উপায় হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সঠিকভাবে আইন ফলো করা। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দুরভিসন্ধি না করা।’

এ ধরনের বিষয়গুলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কোন দৃষ্টিতে দেখছে প্রশ্নের জবাবে কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করি বা তদন্তকারী সংস্থা দিয়ে তদন্ত করাই। সেখানে এ ধরনের কোনো বিষয় উঠে আসলে আমরা স্পষ্ট প্রতিবাদ করি। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা বলি।’

‘সাজানো স্বীকারোক্তিতে আদায় করে বিচার হয় না প্রহসন হয়’

জিজ্ঞাসাবাদ বা স্বীকারোক্তি আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা আইনগুলো ব্রিটিশ আমলে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য, শাসন-শোষণ বজায় রাখার জন্য প্রণীত বলে উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না।

ঢাকা টাইমসকে এ আইনজ্ঞ বলেন, ‘কেউ স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে চাইলে থানায় বা রিমান্ডে নিতে হবে কেন? খোলা মাঠে বসেই তো স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে পারে। নিজের বাসায় বসেও স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রমাণ হয় যে, রিমান্ডের পর দেখা যায় যে আসামি এসে স্বেচ্ছায় একটা জবানবন্দি দিল।’

‘এই ধরনের জবানবন্দি যে বানোয়াট সেটা বোঝাই যায়। চাপ দিয়ে এটা করা হয়েছে। এটা বিচারকেরও মানা উচিত না। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনাও পুলিশ, অধস্তন আদালত ফলো করে না।’

সাজানো স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করেই আদালত অনেককে সাজা দিয়ে দেয় বলেও মন্তব্য করেন জেড আই খান পান্না। বলেন, ‘তার আগে দেখা হয় না, আসামি কতদিন রিমান্ডে ছিল, তার মেডিকেল করা হয়েছে কি না ইত্যাদি। এই ধরনের স্বীকারোক্তি আদায় করে যে বিচারটা হয় সেগুলো বিচারের নামে প্রহসন।’

‘সাজানো স্বীকারোক্তিতে সুষ্ঠু বিচার হতেই পারে না’

কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন এবং পরে বের হয়েছেন এমন অনেকেই এই ধরনের অভিযোগ করেন বলে উল্লেখ করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান।

ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আদালতে আইনজীবীরাও অনেক সময় মক্কেলের বিষয়ে এই কথাটি বলেন যে তার মক্কেলকে জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আইনের চোখে কমপ্লিটলি অচল (অগ্রহণযোগ্য)। যারা এটা ঘটান তারা আইনের বাইরে দিয়ে ঘটান এবং তারা নিজেরা অপরাধী হয়ে যান। নিজেরাই অপরাধ করেন।’

আসকের এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমাদের বিচার ব্যবস্থায় স্বীকারোক্তির একটি গুরুত্ব আছে। সাজানো স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সুষ্ঠু বিচার হতেই পারে না। জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি যদি আদায় করে, আর সেটা যদি চ্যালেঞ্জ করা না হয় বা পরিবেশ যদি চ্যালেঞ্জ করার না থাকে, সেই ক্ষেত্রে ন্যায্য বিচার পাওয়া দুরূহ একটা ব্যাপার।’

নূর খান বলেন, ‘দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, একটা মানুষকে চূড়ান্ত নিপীড়নের মধ্য দিয়ে বা চাপ প্রয়োগ করে যে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় এটা আইনের চোখে, মানবাধিকারের দিক থেকে এমনকি সংবিধানের দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য। এটা একটা অপরাধ এবং সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ায় একটি বাধা।’

‘প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা গেলেই উত্তরণ’

জোরপূর্বক শব্দটিই বেআইনি উল্লেখ করে মানবাধিকার আইনজীবী হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট এলিনা খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আইনে বলা আছে, যিনি স্বীকারোক্তি দেবেন তাকে এমন একটা জায়গায় বা নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে সুন্দর পরিবেশের একটি জায়গায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। যাতে ভয়মুক্তভাবে স্বীকারোক্তি দিতে পারে। যা জিজ্ঞাসা করা হয় তার উত্তর যেন ভয়মুক্তভাবে দিতে পারে।’

‘দ্বিতীয়ত বিচারকের কাছে স্বীকারোক্তি দিতে আসা ব্যক্তিকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, ভয়ের কিছু নেই। স্বীকারোক্তি না দিলেও তাকে পুলিশ কাস্টডিতে (হেফাজতে) পাঠানো হবে না। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে এমন নজির নেই।’

এলিনা খান বলেন, ‘জোর করে স্বীকারোক্তির গ্রহণযোগ্যতা নেই। সেটা আসলে স্বীকারোক্তি হয়ও না। এভাবে অনেকেই ভুক্তভোগী হয়। এটা ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। জানাজানি হলে বেঁচে (রক্ষা) যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, জানাজানি না হলে নীরবেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাজা পেয়ে যেতে পারেন।’

জিজ্ঞাসাবাদকারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করে তোলার পরামর্শ দিয়ে এ মানবাধিকার আইনজীবী বলেন, ‘যেন তারা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন। তাছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা গেলে এমন ঘটনা থেকে উত্তরণ ঘটবে।’

‘জোরপূর্বক জবানবন্দি বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে’

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জোরপূর্বক জবানবন্দি বা সাজানো স্বীকারোক্তি বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ধরনের বেআইনি বিষয়গুলো বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার সংশ্লিষ্টদের ন্যায় বিচার নিশ্চিতে আরও সোচ্চার হতে হবে। স্বীকারোক্তি আদায়ের ক্ষেত্রে আইনে যে নির্দেশনা রয়েছে, তা মেনেই স্বীকারোক্তি নিতে হবে।’

যা আছে সংবিধানে, কী বলছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো আসামিকে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করলে এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় বলা আছে, নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করলে ৭ বছর পর্যন্ত সাজা দেওয়া যাবে। ৩৩১ ধারায় বলা আছে গুরুতর জখম করলে ১০ বছর পর্যন্ত সাজা হবে।

আর সংবিধানে বলা আছে, কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি স্বেচ্ছায় দিতে হবে এবং সত্য ঘটনা হতে হবে। কাউকে ভয় দেখিয়ে বা নির্যাতন করে বাধ্য করা হলে সেটা অপ্রাসঙ্গিক ও অবৈধ হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৪মে/ডিএম/এআরডি)