বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিক, শরীরে ঢুকছে বিষ
প্রকাশ | ২৫ মে ২০২৩, ০৯:৫২ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ১০:৩১
বাতাস মানুষের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং দ্রুত নগরায়নের কারণে বাতাসে দূষণের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য, কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে মিশে থাকা প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত মিশছে পরিবেশে। এসব প্লাস্টিক তাপমাত্রা, অণুজীব এবং নানা কারণে ভেঙে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকে বা মাইক্রোপ্লাস্টিকে। যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং হুমকিস্বরূপ।
প্রতি বছর প্রায় আশি লক্ষ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা নদী-নালা-খাল-বিল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এখনো পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে তার সব যদি এক জায়গায় জড়ো করা হয় তবে সেই আবর্জনার স্তুপ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও উঁচু হবে। প্লাস্টিক আবর্জনার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ হল মাইক্রোপ্লাস্টিক। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে এবং রক্তে প্রবেশ করে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের বুকের দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। নীরব ঘাতক মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবসভ্যতাকে এক নজিরবিহীন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
প্লাস্টিকের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সাধারণত নারডল নামে পরিচিত। বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অন্যতম একটি উৎস ফসলি জমিতে ব্যবহৃত সার। এসব সার শুকিয়ে গেলে তাতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসে মিশে যায় বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। এমনকি সিনথেটিক কার্পেট ও কাপড় থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
সাধারণত ৫ মিলিমিটারের ছোট আকারের প্লাস্টিককে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ এক ইঞ্চির প্রায় পাঁচ ভাগ ছোট আকৃতির প্লাস্টিক কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। তবে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো আরো অনেক ছোট হয়। এমন সব অতিক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, যা খালি চোখে দেখা যায় না।
বর্তমান সভ্যতায় অনেকাংশেই প্লাস্টিক নির্ভর হয়ে পড়েছে। দিনের শুরু থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমরা প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করি। পানির বোতল থেকে যা কিছু আছে সবকিছু প্লাস্টিকের। বাজারের ব্যাগ প্লাস্টিকের। হোটেল-রেস্তোরাঁ খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে তেল দেওয়া হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার থেকে শুরু করে মুখরোচক খাবারের প্যাকেট প্লাস্টিকের।
প্রতিদিন সকালে ব্যবহার করা টুথপেস্ট শুরু করে ফেসওয়াশ, বডি ওয়াশ, নেইলপলিশের মত প্রসাধনী এবং ডিটারজেন্ট পাউডারের মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের খাবারের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
বর্তমানে প্রায় ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক এ পরিণত হয়। সমুদ্রের অতি ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর ধীরে ধীরে বড় থেকে বড় মাছগুলো সেইসব ছোট মাছগুলোকে খায়, একপর্যায়ে খাদ্য শৃংখল এর ধারাবাহিকতায় সেইসব মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব শরীরে চলে আসে । এত এত প্রাণীর দেহে ঘুরে মানুষের শরীরে আসলেও কোন প্রাণীর পাকস্থলীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক হজম হয় না। সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও সামুদ্রিক পাখির পেটে যাচ্ছে মাইক্রো প্লাস্টিক। প্লাস্টিক বা মাইক্রোপ্লাস্টিক অনেক প্রানির গলায় আটকে মারাও যাচ্ছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কোনো প্লাস্টিক থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি মাইক্রোপ্লাস্টিক নয়, বরং ইঞ্জিনিয়ারিং উপায়ে তৈরি করা মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা এসব পণ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন আমাদের স্বাঁস্থ্যঝুকি বাড়ছে, অন্যদিকে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এসব কসমেটিক ব্যবহারের পর তা পানির সঙ্গে মিশে ভেসে যাচ্ছে খাল, নদী কিংবা সমুদ্রে। বর্তমানে অনেক বোতলজাত পানিতেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।
এছাড়া টি-ব্যাগের চায়ে মিশে যেতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সাধারণত টি-ব্যাগ প্রাকৃতিক ফাইবার দিয়ে তৈরি হলেও তা এঁটে দিতে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিক। উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে এসব থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক চায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। প্রায় ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটন্ত পানিতে ১১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ন্যানোপ্লাস্টিক তথা সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। এ ছাড়া কাপড়ে ব্যবহৃত সিনথেটিক ফাইবার যেমন পলিইস্টার, নাইলন প্রভৃতিতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
এভাবেই প্রতিনিয়ত পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রাণিজগতের ওপর। এর ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য। ক্যানসার, হরমোনের তারতম্য, প্রজননপ্রক্রিয়ায় বাধা ছাড়াও মারাত্মক সব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে সারাদিন ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের রক্তে মিশে যাচ্ছে । এছাড়া আমাদের ফুসফুসেও অনেক মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে যা মানুষের শরীর থেকে নিঃশ্বাস হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই । মানুষের শরীরে যত মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলেও পিইটি প্লাস্টিক। সাধারণত পানির বোতলগুলো এই ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয়। এর পরেই পলিস্টারিন জাতীয় প্লাস্টিক মানব শরীরের সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী প্যাকেজিং করতে এ ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় এবং মানব রক্ত পাওয়া অন্যতম আরেক ধরনের প্লাস্টিক হল পলিথিন। এই উপাদান আমরা সবাই চিনি পলিথিন দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ বানানো হয়। বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক এমন সব রাসায়নিক নিঃসরণ করে যার এস্ট্রোজেনিক অ্যাক্টিভিটি আছে। অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কনা মানব শরীরে প্রবেশ করে এস্ট্রোজেন হরমোনের মতো কাজ করতে শুরু করে। এই বিষয়টি এস্ট্রোজেন অ্যাক্টিভিটি হিসেবে পরিচিত । বেশিরভাগ প্লাস্টিক সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসার পর এস্ট্রোজেনিক অ্যাক্টিভিটি তৈরি হয়। আমেরিকার ৯২ শতাংশ মানুষের শরীরে এই ধরনের ক্ষতিকারক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ১১ বছরের কম বয়সী শিশুদের দেহে এই ক্ষতির মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ। মানব দেহে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপর বিভিন্ন ক্ষতিকর অনুজীব বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে থাকা হরমোনের নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় ।
মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের দুই দল গবেষক বেশ কিছু গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের খাবার লবণ এবং চিনি নিয়ে পৃথক দু'টি গবেষণা উল্লেখযোগ্য। দেশের নামকরা দশটি ব্যান্ডের লবণসহ স্থানীয় দোকান থেকে খোলা লবণের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা চালানো হয় । প্যাকেটজাত এবং খোলা উভয় লবনে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক রয়েছে । প্রতি কেজি সামুদ্রিক লবণ ৩৯০ থেকে ৭৪০০ আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে । এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি । বঙ্গোপসাগর থেকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবার লবনের পলিস্টিরিন ইথিলিন, ভিনাইল এসিডেট , পলিথিন নাইলন, পলিথিন টেরেপ্তেরালের মতো প্লাস্টিক উপাদান পাওয়া গেছে । আরেকটি গবেষণায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চিনি আশঙ্কাজনক মাত্রায় ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। শুধুমাত্র চিনির মাধ্যমে প্রতিবছর বাংলাদেশের মানুষের শরীরে ১০ টনের ও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক এর কণা প্রবেশ করতে পারে । এছাড়া পাঁচটি ব্রেন্ডের টি ব্যাগের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় পলিটেট্রাফ্লুটো ইলিথিন, হাইডেন্সিটি পলিথিন, পলিকার্বনেট , পলিভিনাইল ক্লোরাইড, নাইনল ইথিনিল ভিনাইল অ্যাসিটেড, সেলুলস এসিটেড এবং এভিএস এর মত প্লাস্টিক কণা রয়েছে। বাজার সকল খাদ্য পণ্য নিয়ে গবেষণা করলে কেমন ভয়াবহ চিত্র উঠে আসবে তা সহজেই অনুমেয়। এসব খাদ্যপণ্য থেকে এত ভয়াবহ মাত্রায় প্লাস্টিক আমাদের রক্তে মিশে যাচ্ছে যে সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের দুধেও মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বর্তমানে বাতাসেও মাইক্রোপ্লাস্টিক ভেসে বেড়াচ্ছে যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকে লুকিয়ে রয়েছে এক্সেনোস্ট্রেজেন নামের বিষ। এটি শরীরে প্রবেশ করা মাত্র ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে হরমোনাল ইমব্যালেন্স দেখা দেওয়ার কারণে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
একাধিক গবেষণায় একথা প্রামাণিত হয়েছে যে, মাইক্রোপ্লাস্টিকে থাকা একাধিক রাসায়নিক আমাদের রক্তে মিশে যাওয়ার পর একে একে শরীরের একাধিক অঙ্গের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিতে শুরু করে। সেই সঙ্গে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটাই কমিয়ে দেয় যে নানাবিধ সংক্রমণের আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মাইক্রোপ্লাস্টিকে উপস্থিত যেমন ফ্লোরায়িড, আর্সেনিক এবং অ্যালুমিনিয়াম শরীরের পক্ষে ভাল নয়। একাধিক কেস স্টাডি করে দেখা গেছে এই রসায়নিকগুলো শরীরে নিয়মিত ঢুকলে বিষক্রিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
মাইক্রোপ্লাস্টিকে ‘ফেতালেটস’ নামক একটি রাসায়নিক শরীরে প্রবেশ করা মাত্র কোষের বিভাজনে নানা পরিবর্তন হতে শুরু করে, যা থেকে লিভার ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।