শুভ জন্মদিন প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের কবি নজরুল ইসলাম

প্রকাশ | ২৫ মে ২০২৩, ১০:২৫ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ১০:৫১

তৌহিদ এলাহী

কবি নজরুল তার বিদ্রোহী কবিতায় অনেক কিছু হতে চেয়েছিলেন। ইস্রাফিলের শিঙ্গার হুঙ্কার হতে শুরু করে কুমারীর প্রথম পরশ। তার বিদ্রোহ ছিল প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তবে এ কবিতা লেখার সময় নিজে সরাসরি কিছু বলেননি। তার বিদ্রোহের জন্য ধর্ম, মিথ ও বাস্তবতার সকল শক্তি অর্জন করতে চেয়েছেন।

বিদ্রোহী কবিতায় অনেক কিছু হতে চাইলেও সবচেয়ে বেশি হতে চেয়েছেন দেবী দুর্গা। দুর্গা অর্থ অপরাজেয়। পুরাণ মতে, দুর্গা অসুর ও মহিষাসুর বধ করার জন্য বিভিন্ন দেবতা হতে দশটি শক্তি বা অস্ত্র প্রাপ্ত হন। এগুলো হলো শঙ্খ, চক্র, পদ্ম, তলোয়ার বা খড়্গ, তীর-ধনুক, ত্রিশূল, দণ্ড বা গদা, বজ্র বা অশনি, সাপ, অগ্নি। বিচ্ছিন্নভাবে সংগৃহীত নিচের লাইনগুলো পড়ুন:

{{আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।–(অগ্নি)

-

আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,-(বজ্র)

-

আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, (ত্রিশূল, দণ্ড/ গদা)

আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড! (শঙ্খ, চক্র)

-

--অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না (খড়্গ)

-

--ধরি বাসুকির ফণা জাপটি (সর্প)}}

-

প্রত্যেকটি অস্ত্রের পৌরাণিক ব্যাখ্যা যেমন আছে, নজরুলীয় ব্যাখ্যাও টু দ্যা পয়েন্ট। উদাহরণ হিসেবে, শঙ্খ হলো সৃষ্টির প্রতীক। পুরাণ মতে, শঙ্খ থেকে উৎপন্ন শব্দেই প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই জীব জগতে। চক্র অর্থাৎ আবর্তন। দেবী দুর্গার হাতে চক্র থাকার অর্থ হলো সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে রয়েছেন দেবী নিজে।

যাই পরের ধাপে। এসবে কবির আর পোষাচ্ছিল না । এবার ডাইরেক্ট বলে দিলেন:

{{আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।

দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?}} - আনন্দময়ীর আগমনে দিলেন গালি দেবী দুর্গাকে, কিন্তু ইংরেজ বুঝে ফেলল। তিনি ঝি মেরে বৌকে বুঝিয়ে বৌ এর দ্বারা হাতকড়া পরে জেলে ঢুকলেন।

এ গেল এক রূপ, অন্য পৃষ্ঠাটি দেখা যাক। তিনি ইসলামী পুনর্জাগরণ ও মুসলিম ঐতিহ্যকে ধারণ করতেন মনেপ্রাণে। বিশ্বাস করতেন ধর্মের মর্মবাণী শ্বাশত। তৎকালীন সময়ের বিদেশি  শোষণ, ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ থেকে রক্ষা করার জন্য ও সাম্যের মর্মবাণী হতাশাগ্রস্ত জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডেকেছেন উসমান-উমরদের (রাঃ)-

(আবুবকর উসমান উমর আলি হায়দর

দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!

কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,

দাঁড়ি-মুখে সারি-গান –লা-শরিক আল্লাহ!)- খেয়া-পারের তরণী

-

(উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!

আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু!) - উমর ফারুক

ধর্মের নামে ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিতে উপমহাদেশের তেত্রিশ কোটি মানুষকে দুশো বছরের পরাধীনতার শিকল হতে মুক্তি দিতে নজরুল ধর্মের মধ্যে থেকেই সকল ধর্মের মানুষের কাছে পৌছেছেন। তিনি জানতেন, যারা শোষিত নিগৃহীত তারা ভারতবর্ষের সন্তান। ধর্মের নামে ভেদাভেদ জাতিকে মুক্তি দেবে না, ডুবিয়ে মারবে। আমাদের ভেদাভেদ অন্যদের সুবিধা দেবে।

“হিন্দু না ওরা মুসলিম”– ওই জিজ্ঞাসে কোন জন কাণ্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র – কাণ্ডারী হুঁশিয়ার।

শুভ জন্মদিন প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের কবি। প্রিয় মাতৃভূমি হোক নজরুলের সাম্যবাদী ও সাম্প্রদায়িকতাহীন বাংলাদেশ। হোক আমাদের সকলের, সকল ধর্মের আর শুধু মানুষের।

(গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।)-মানুষ

 

লেখক: অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মুন্সীগঞ্জ