বিধিনিষেধের আড়ালে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি ভাবছে?

প্রকাশ | ২৫ মে ২০২৩, ১৪:০৩ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ১৮:১৩

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ

আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যয়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে।একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শঙ্কিত! কারণ বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা, নিপীড়ন, নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শঙ্কিত করে তুলছে।

উন্নত দেশগুলো রাষ্ট্রীয় সীমারেখার দেয়াল তুলে শান্ত হয়নি, বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক কৌশল অবলম্বন করে তারা দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষদের আরও সুশীল বানাতে চাইছে। গণতন্রের পূজারী উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থে সুশীল বানানো প্রক্রিয়ায় ধনী দেশগুলোতে সেভাবে চাপ প্ৰয়োগ করে না, যেভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বেলায় যেভাবে কূটনীতিবিদরা সক্রিয় তাতে আমাদের স্বাধীনতা কি ক্ষুণ্ন হচ্ছে না? এ দায় কি কেবল নিপীড়িত মানুষের?

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নানা আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছে। কিছুদিন সেই চাপ কমেছিল। কিন্তু আবার নতুন করে চাপে ফেলা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি হতে পারে? বিরোধী জোটে যারা আছেন তারা বলবেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে একটি নির্বাচন করুন, সমস্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু আমার ভিন্ন রকম উপলব্ধি।

বাংলাদেশের সরকার নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত তাতে কারও কিছু যায় আসে না। যদি নির্বাচন মুখ্য বিষয় হতো তবে আরব রাষ্ট্রে বিরাজমান রাজতন্ত্র অবসানে তারা মনোযোগী হতো। সেখানে কেন গণতন্ত্রের জন্য মনোযোগ দেওয়া হয়না তার অনুসন্ধানে যারা লিখেছেন তাদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।এখানে কার্ল মার্কসের দর্শনের সাফল্য। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটাতে উন্নত দেশগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। তার পরেও আমাদের ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ গভীর ভাবনার বিষয়। এটি দেশের বিরোধী দলের দেন-দরবার বা তদবিরের ফলে হচ্ছে মনে করলে হয়তো ভুল হবে। সুষ্ঠু,অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি একমাত্র ভাবনা ওই সব বিধিনিষেধ আরোপের কারণ? একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট? আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের মনোযোগ এখানে একান্তভাবে কাম্য যাতে সরকার চাপের মুখে কোনো বড় রকম ভুল না করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাতিঘর। এক বিবৃতিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলেছে, তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনিও সুষ্ঠু নির্বাচন চান এবং আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সারা বিশ্বে যেভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে সেইভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে।

সম্প্রতি একটি পোস্টার আমার নজরে এসেছে। সেখানে লেখা আছে ‘আমার ভোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দিতে চাই।’ ওই পোস্টার নিয়ে দলের লোকদেরসঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বিদেশি দূতাবাসের আশীর্বাদ পেয়েছেন এবং আরেকটি মহল মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র যেসব বিধিনিষেধ দিচ্ছে তার লক্ষ্য হলো পর্যায়ক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল। এটাকে বিস্তৃত করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদের বক্তব্যের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।

পত্রিকাতে দেখেছি সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করবেএবং এখন আগের তুলনায় সরকার বিরোধী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না। অন্তত গত মঙ্গলবার গাবতলীতে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি আমানউল্লাহ আমানের জনসভা দেখে আমার ধারণা হয়েছে। ওইদিন ধানমন্ডিতে সভা হয়েছে বটে কিন্তু কিছু মানুষ বাস পোড়ানোর মতো বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার করছে। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের কাছে অনেকেই বলেন আগামী নির্বাচন যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় সেজন্য আন্দোলন করবেন। সেই আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ হবে সেটা ভাবা যায় কি? আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষই অবলম্বন করবে না যদি তারা কোনোভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আমাদের মনে পড়ে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমাদের সামাজিক শান্তি ও অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে।আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির যে পাঁয়তারা চলছে তা কোনোভাবেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে বলে মনে হয় না।কারণ যেই হারবে সেই দাবি করবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।

জনগণের কষ্ট সৃষ্টি করে কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়।  ভোট ও ভাতের  স্বাধীনতা অর্জনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি অর্জন করতে হয় তবে তা জনগণের কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যদিয়েই সম্ভব।  বাংলাদেশ আশা করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হয়েই থাকবে। তাদের আরোপিত বিধিনিষেধ কেন সেটা অনুসন্ধানে সময় না দিয়ে আমার সমস্যা নিয়ে আমি ভাবতে ও সমাধানের চেষ্টা করতে চাই। রাজনীতির লক্ষ্য হোক জনগণমুখী-কূটনীতিবিদমুখী নয়। আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে এবং সৎ মানুষগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য থাকতে হবে। আমি মনে করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবার সুযোগ আছে রাজনীতিবিদদের আলোর পথের সন্ধান দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বক্তব্য তারই প্রতিফলন।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে স্বপ্ন আমাদের সকলের। বিদেশি কূটনীতিবিদরা যেভাবে যুক্ত হচ্ছে তা থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব সরকারের ওপরবর্তায়। আমরা বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কার বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি। বঙ্গবন্ধুর শান্তি ভাবনা যেন আমাদের রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনে সেই কামনা করছি। তাহলেই কূটনৈতিক বিজয় অর্জন সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়