জাবির ছাত্রী হলে নষ্ট হচ্ছে লাখ টাকার খেলার সরঞ্জামাদি

যৌথ প্রতিবেদন
 | প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৩, ১৫:৪৯

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ৮টি হল। এসব হলে কমনরুম ও অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকার অব্যবহৃত অবস্থায় পরে থেকে নষ্ট হচ্ছে লক্ষাধিক টাকার খেলার সরঞ্জাম।

পাশাপাশি হলগুলোতে বার্ষিক অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতীযোগিতার আয়োজনও অনিয়মিত। হল প্রতিষ্ঠাকালে কমনরুম থাকলেও বর্তমানে আবাসন সংকটকে দায়ী করে এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে সাধারণ ছাত্রীদের।

হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হলো কমনরুম। এখানে শিক্ষার্থীরা তাদের অবসর সময় পার করে থাকে। সময় কাটানোর জন্য থাকে কিছু খেলাধুলার উপকরণ যেমন, দাবা, লুডু, ক্যারাম, টেবিল টেনিস ইত্যাদি। একজন শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ, সামাজীকিকরণের অন্যতম প্রধান জায়গা এই কমনরুম।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি ছাত্রী হলের ভিতর ৭টি পুরাতন ও একটি নতুন। গত জানুয়ারিতে চালু হওয়া ১৮ নম্বর ছাত্রী হলে এখনো কমনরুম ও অভ্যন্তরীণ খেলার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অন্যদিকে, নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল, বেগম খালেদা জিয়া হল, শেখ হাসিনা হল, জাহানারা ইমাম হল, প্রীতিলতা হল, বেগম সুফিয়া কামাল হল, ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল ঘুরে দেখা যায়, কমনরুম থাকলেও সেগুলি বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরদের আবাসনের জন্য গণরুম ও রিডিং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যতিক্রম কেবল প্রীতিলতা হলে, সেখানে ছাত্রীদের অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার জন্য পেপাররুমকে বরাদ্দ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায়। বেগম খালেদা জিয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী তাজমিনা আক্তার তিসা বলেন, ‘ক্লাস টাইমের বাইরে অনেকটা সময় আমাদের হলে থাকতে হয়। কিন্তু অবসর সময় বা ছুটির দিনগুলো কাটানোর জন্য হলে কোনো বিশেষ সুবিধা নেই। শুনেছি, হলে ইন্ডোর গেমস এর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এটা কেবল নামেই। কোনো জায়গা নেই খেলার, কমনরুম গুলো এখন গণরুম।’

অপর দিকে, সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে নতুন চালু হবার পরপর হলগুলোতে কমনরুম সুবিধা বহাল ছিল। নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের সাবেক শিক্ষার্থী জিনিয়া বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন বিকেলে সবাই একসাথে আড্ডা দিতাম। ক্যারাম, লুডু, দাবা খেলতাম। শীতকালে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট আয়োজন করতাম নিজেরাই। তসেসব খুব আনন্দের দিন ছিলো। তবে, এখন শুনেছি আমাদের কমনরুমগুলো আর নেই। গণরুম করে ফেলা হয়েছে। বিষয়টা দুঃখজনক।’

আবার, প্রতি বছর হলের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের বিধি থাকলেও ২০১৯ সালের পর আর কোন অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় নি নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল, বেগম খালেদা জিয়া হল, বেগম সুফিয়া কামাল হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে। তবে ৩ বছর বিরতির পর ২০২৩ সালে প্রীতিলতা হল, জাহানারা ইমাম হল ও শেখ হাসিনা হলে বার্ষিক অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এ বিষয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের হল সুপার বেনজির বিউটি বলেন, ‘মেয়েদেরকে গণরুম থেকে রুমে শিফট করার পর হয়তো বিগত বছরের বার্ষিক অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলো আয়োজন করা হবে।’

প্রতিবছর বার্ষিক অভ্যন্তরীণ এই প্রতিযোগিতা আয়োজনে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭ হাজার টাকার কিছু বেশি; যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানান সংশ্লিষ্ট হলের ক্রীড়া শিক্ষকগণ। এছাড়া, হলে স্থানাভাবে এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম ও হলের ডায়নিংগুলোতে।

এদিকে, প্রত্যেক হলেই কমনরুমের দায়িত্বে ২-৩ জন করে কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। যাদের কাজ মূলত, প্রতিদিন মেয়েদের খেলাধুলার সরঞ্জাম সরবরাহ করা ও সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করা। কিন্তু বর্তমানে হলগুলোতে নিয়মিত খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তিন শিফটে দায়িত্বরত এই কর্মচারিদের কাজ এখন কেবল পেপার লাগানো ও দিন শেষে সেগুলি গুছিয়ে রাখাতেই সীমাবদ্ধ। কর্মচারীদের কারো কারো দাবি তাদেরকে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজের বাইরে অন্যান্য কাজ করানো হয়।

এ বিষয়ে জাহানারা ইমাম হলের কমনরুম এটেনন্ডেন্ট রওশন আরা বলেন, ‘আমরা তো এখন হলের সব কাজ-ই করি। কমনরুম না থাকলেও আমাদের অন্যান্য কাজ করতে হয়, কমনরুম ঝাড়ু দেওয়া, রিডিং রুমের টেবিল মোছা ছাড়াও আরও নানা কাজ আমরা করি”।

উল্লেখ্য, কমনরুম এটেন্ডেটরা সরকারি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। দিনে ৮ ঘন্টার ডিউটিতে কেবল পেপার আনা-নেওয়া ও ঝাড়া-মোছার কাজ করেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাসে ৮,২৫০-২০‌,০১০ টাকা বেতন পাচ্ছেন।

অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়ার স্থান সংকুলান করতে না পারায় নষ্ট হচ্ছে লক্ষাধিক টাকার সরঞ্জামাদি। বছরান্তে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এগুলির ব্যবহার হয়। সারাবছর এগুলি থাকে বাক্সবন্দী অবস্থায়। এভাবে পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে দামি টেবিল টেনিস বোর্ড, ক্যারাম, দাবা, তাস, লুডু, ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট ও নেট। এসব সরঞ্জাম কেনার হিসাব বা রশিদ চাইলেও হল কর্তৃপক্ষ তা হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তবে, মওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম মার্কেটের বিভিন্ন দোকান ঘুরে, এসব পণ্যের বর্তমান বাজারমূল্য যাচাই করে দেখা যায়, নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে ৯৮ হাজার ৯০০ টাকা, বেগম খালেদা জিয়া হলে ৪৫ হাজার ৪০০ টাকা, শেখ হাসিনা হলে ১৯ হাজার ৬৫০ টাকা, জাহানারা ইমাম হলে ১, লাখ ২ হাজার ১৫০ টাকা, প্রীতিলতা হলে ৩২ হাজার ৯০০ টাকা, বেগম সুফিয়া কামাতা হলে ১২ হাজার ১০০ টাকা, ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে ৪৮ হাজার ‌৫০০ টাকার সরঞ্জামাদি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্যে আবার অনেকগুলিই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সর্বমোট এই টাকার পরিমাণ ৩,৫৯,৬০০ টাকা।

এ বিষয়ে শেখ হাসিনা হলের শিক্ষার্থী নাবিলা বলেন, ‘হলের ভিতর আমাদের খেলাধুলা করার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। খেলার সামগ্রী সবই আছে, কিন্তু তা শুধু ঐ প্রতিযোগিতার সপ্তাহেই দেখতে পাই। আর, খেলবোই বা কোথায়, আমাদের তো জায়গাই নেই, সব এখন গণরুম।’

ছাত্রী হলে কমনরুম সংকট ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার বলেন, ‘অতি দ্রুত গণরুমের মেয়েদের কমনরুমগুলো থেকে সরিয়ে নতুন হলে স্থানান্তর করা হলে এই সংকটের সুরাহা হয়ে যাবে।’

উল্লেখ্য, পূর্বেও নতুন হলের আশ্বাস দিয়ে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও, বাস্তবে দেখা যায় নতুন হল সচল হওয়ার পরও বিলোপ হয়নি গণরুম ব্যবস্থার, ফলে খালি হয়নি কোনো কমনরুম।

[প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন উম্মে মহাসিনা; সানজানা আলম নির্জনা; জায়েদ হোসেন আলিফ ও বাবুল হোসেন। তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম আবর্তনের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী]

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :