সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংকট: মিস্টার পিটার হাসের তৎপরতা

সম্প্রতি সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, রাজনৈতিক কর্মী, বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ এবং সংসদ থেকে পদত্যাগকারী দল বিএনপি নেতারা দফায় দফায় বিদেশি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে সভা করছেন বলে আমরা পত্রিকার সংবাদ থেকে জানতে পারছি। স্বাধীনতার ৫১ বছরে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের রাজনীতির এই দৈন্যদশা সমগ্র জাতিকে হতাশায় নিমজ্জিত করছে বললে কি ভুল হবে? অতীতে আমরা এরকম তৎপরতা দেখেছি। তাকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। যদি সেই সময় আমরা স্বাগত জানাতে পারি তবে আজ কেন পারছি না?

সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংকট ১৯৮৫ সালে হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে কারচুপি হয়েছিল, ১৯৮৮ সালের নির্বাচন ছিল প্রহসন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এসেছে। ১৯৯৬ সালে একতরফা নির্বাচন আমাদেরকে অসহযোগ আন্দোলনের পথে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেটি জনতার মঞ্চের আন্দোলনে সমাপ্ত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের আরেকটি নির্বাচন ১২ জুন হয়েছিল। এই নির্বাচনকেও সকল পক্ষ মেনে নিতে পারেনি। ২০০১ সালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং ২০০৬ সালের নির্বাচন বাতিল হয়েছে।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি একটি সরকার সেনা সমর্থনে ক্ষমতায় এসে নির্বাচন ব্যবস্থার এক যুগান্তকারী সংস্কার করেন। দীর্ঘদিন ধরে ২ কোটি ভুয়া ভোটার নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আসছিল তার অবসান ঘটে। ২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয় তাতে বেগম জিয়া অংশ নিতে চাননি প্রথম দিকে। তিনি মনে করেছিলেন তার নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তাদেরকে ক্ষমতাসীন সরকার হয়রানি করবে। পরে অবশ্য তিনি নির্বাচনি ট্রেনে যাত্রী হয়েছিলেন। সেদিন আমিও তাকে আমার একটি লেখার মাধ্যমে আহবান জানিয়েছিলাম নির্বাচনকে অর্থবহ করবার জন্য।

আমার সেই আহবান ছিল জাতির সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে। তিনি আমাদের আহবানে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বিধায় আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পেয়েছিলাম।

কিন্তু ১/১১ সেনাসমর্থিত সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন সকল দলের সাংসদরা! আর সেই সুযোগে ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা স্মরণ করলে কান্নায় বুক ভেঙে আসে। সেই কষ্টকে বহন করবার ক্ষমতা জাতি অর্জন করেছে কি?

১৯৭৫ সালে জাতির জনকের পরিবারকে নির্মূল করে দেওয়ার মানসে বাংলার মাটিতে এক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড দিয়ে শেষ হয়নি ক্ষমতা লোভের অবসান। ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়, ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদাসহ হত্যা করা হয় বেশ কিছু সামরিক অফিসারকে। এভাবে হত্যার রাজনীতি বাংলাদেশকে গ্রাস করে।

আমরা আর হত্যার রাজনীতি চাই না। আর সে কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে বিএনপি বাধাগ্রস্ত করতে চাইলেও জনগণ তাদের পক্ষে থাকেনি। ২০১৮ সালে তারা ভুল বুঝতে পেরে নির্বাচনে এসেছিল। আমাদের আশা ছিল তারা ২০২৪ সালের নির্বাচনেও আসবে। কিন্তু তারা বারবার বলছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে আসবে না। জাতি উৎকণ্ঠিত!

সেই উৎকণ্ঠা থেকে সমাজের অনেকেই আবার শরণাপন্ন হয়েছেন বিদেশ কূটনীতিবিদদের। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মিস্টার পিটার হাস এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একসময় প্রাসাদ রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। আজ সেই রাজনীতি আবার বাংলাদেশের আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করেছে।

১৯৭১ সালে আমরা কি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য? আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কি তাহলে নিঃশেষ হয়ে গেছেন?

বিদেশি শাসনকে আমরা ১৯৪৭ সালে বিতাড়ন করেছিলাম। আবার কি তবে আমরা নতুন কলোনিতে দেশকে রূপান্তর করতে যাচ্ছি?

রাজনীতিবিদদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাই। এভাবে দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেবেন না। আগে নিজেদের মাঝে আলোচনা করুন। জনগণের কাছে বিচার দিন। যদি সেখানে সমাধান না হয় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পেয়েছিলাম আমরা সকলে একসাথে লড়াই করেছিলাম বলে। আসুন আবার আরেকটি সংগ্রাম করি এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই। পরিহার করি বিদেশি কূটনীতিবিদনির্ভর রাজনীতি।যে রাজনীতিবিদ বিদেশিদের কাছে ধরনা দেবেন তিনি কি আর দেশপ্রেমী থাকেন? বিদেশের কাছে না গিয়ে দেশপ্রেমী রাজনীতিবিদ হতে কেবল আপনাদের ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। আমরা রাজনীতিবিদের মাঝে আলোচনা চাই। আমরা যেমন সন্ত্রাস বা বিশৃঙ্খলা চাই না, তেমনি বিদেশিদের নিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকে ঘৃণা করি। গণতন্ত্রকে সমুন্নত করতে আপনাদের ঐক্য জাতির প্রত্যাশা।

আমাদের ঐক্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাকে ঘিরে আমাদের রাজনীতি আবর্তিত হোক।স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেয় এমন রাজনীতিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। আমরা শান্তির বাংলাদেশ চাই।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়