ঈদ লেগেছে শেরপুরের কামারপাড়ায়

প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৩, ১৩:১৩ | আপডেট: ১৮ জুন ২০২৩, ১৩:৫০

সুজন সেন, শেরপুর

আসছে কোরবানি। কোরবানি শব্দটি আরবি (কুরব) ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করাই কোরবানি। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তার নামে পশু জবেহ করাকে কোরবানি বলে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট কিছু হালাল পশু জবাই বা কোরবানি করা হয়।

আর এই ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন কামার শিল্পীরা। টুংটাং শব্দই বলছে ঈদ লেগেছে কামারপাড়ায়। দিন রাত চলছে চাপাতি, দা, বঁটি, ছুরি তৈরি ও শানের কাজ। নাওয়া-খাওয়া ভুলে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।

শেরপুর জেলার পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন বাজার বা কামারপাড়া ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যন্ত জনপদের কামাররা এখন মহাব্যস্ত সময় পার করছেন। লাল আগুনের লোহায় কামারদের পিটাপিটিতে মুখর হয়ে উঠেছে কামার দোকানগুলো। টুংটাং শব্দটি এখন তাদের জন্য এক প্রকার ছন্দ।

জানা যায়, শেরপুর শহরের বিভিন্ন দোকান থেকে লোহা কিনে সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে দা, বঁটি, চাকু, চাপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করছেন কামাররা। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রাংশের প্রভাবে কামার শিল্পের দুর্দিন চললেও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে জমে উঠে তাদের এই হস্ত শিল্প।

শ্রীবরদীর ভায়াডাঙা এলাকার কামার শিল্পী দিলীপ বলেন, সারা বছর এই কোরবানির ঈদের জন্য অপেক্ষায় থাকি। এ সময়টিতে যারা কোরবানির পশু জবাই করেন তারা প্রত্যেকে চাপাতি, দা, বঁটি, ছুরি তৈরি করেন। বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে এ সময়টিতে কাজ বেশি হওয়ার কারণে লাভও বেশি হয়। তবে লোহা আর কয়লার দাম বেশি থাকায় মজুরিও একটু বেশি নিতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদের পরিচিত কিছু গ্রাহক দা, বঁটি, ছুরি বানানোর অর্ডার দিয়ে গেছে এবং শান দেওয়ার অর্ডার পেয়েছি। পাশাপাশি নতুন বঁটি, ছুরি তৈরি করছি। বিশেষ করে  কোরবানির ৩-৪ দিন আগে গ্রাহকের আনাগোনা আরও বেড়ে যাবে বলেও জানান তিনি।

ঝিনাইগাতীর সদর বাজারের কামার শিল্পী রতন মিয়া, আবু মিয়া ও জাকারিয়া জানান, এক সময় তাদের বেশ কদর ছিল, বর্তমানে তা আর নেই। তাই সারা বছর তেমন কোনো কাজ থাকে না। তবে ধান কাটার মৌসুম ও কোরবানি উপলক্ষে তাদের কাজের চাহিদা বেড়ে যায়। এসময় তাদের দৈনিক ১০০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় হলেও, ব্যয় বাদে তাদের হাতে থাকে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।

তারা আরও বলেন, বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতেই মূলত কিছু কামার এখনো এ পেশায় জড়িয়ে আছেন। এছাড়া পরিশ্রমের তুলনায় এ পেশায় সাধারণত আয় ও সম্মান উভয়ই কম। তাই অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।

তারা এ পেশার ভবিষ্যৎ নিয়েও এখন চিন্তিত, কারণ এ কাজের সময় আওয়াজ হয় বলে শহরে তেমন কেউ তাদের দোকান ভাড়া দিতে চায় না। আগামীতে এ পেশা টিকিয়ে রাখা খুব কষ্ট হয়ে পড়বে বলেও তারা মত প্রকাশ করেন।

কামারি হাজী ইয়াসিন জানায়, এই এক মাসের কাজের ওপর তাদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া জামা-কাপড় সহ বছরের খোরাকি নির্ভর করে। যদিও কামার শিল্পের আনুষঙ্গিক কয়লা ও লোহার দাম লাগামহীনভাবে উঠানামা করতে থাকে। তাই কামাররা বাপ-দাদার এ পেশাকে ধরে রাখতে কয়লা ও লোহার দাম নিয়ন্ত্রণ ও সহজ শর্তে ঋণের দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।

ক্রেতা নিজাম মিয়া ও ফয়জুল্লা বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার লোহার দাম অনেক বেশি হওয়ায় লোহার তৈরি জিনিসের দামও অনেক বেড়েছে। দা ২৫০-৩৫০ টাকা, ছুরি ১৫০-৪০০ টাকা, বটি ৩০০-৫০০ টাকা, চাপাতি ১,০০০-১৫০০ টাকা করে বেচা-কেনা হচ্ছে।

ক্রেতা ইউসুফ বলেন, কামাররা দেশীয় প্রযুক্তিতে লোহা আগুনে গরম করে পিটিয়ে তৈরি করেন দা, ছুরি তৈরি করেন। এখানে নিজেদের সুবিধা মত ওইসব জিনিস তৈরি করা যায়। সেগুলো খুব টেকশই হয়।

নকলা শহরের যাত্রী ছাউনির পিছনের লোহার তৈজসপত্র তৈরির কারিগর মঞ্জু মিয়া বলেন, গ্রাহকের অর্ডার সামাল দিতে ইতোমধ্যে দোকানে বাড়তি কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছি। প্রতি কেজি ৮৫ টাকা দরে দুই মণ কাঁচা লোহা কিনে এনেছি।

মঞ্জু মিয়া আরও বলেন, আগে নকলা শহরের প্রাণকেন্দ্রের কাচারী মসজিদ মোড় থেকে পূর্বদিকে যাওয়ার রাস্তায় বেশ কিছু কামারের দোকান ছিল। আর তাদের অবস্থানগত পরিচিতির জন্যই নকলা শহরের জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকার নাম করন করা হয়েছিল কামারপট্টি।

(ঢাকাটাইমস/১৮জুন/এসএ)