ননস্টিক প্যানের বিষাক্ত যৌগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর

প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০২ | আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০৫

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

আধুনিক যুগে রান্নাঘরে এসেছে আমূল বদল। বেড়েছে মডিউলার কিচেন কনসেপ্ট। সেই সঙ্গে গত কয়েক বছরে খুব বেড়েছে ননস্টিক প্যানের ব্যবহার। স্বাস্থ্যসচেতন বাঙালি ভাবছে, তেল কম খেতে হবে বলে ননস্টিকের প্যান দারুণ কাজে আসবে। যুগের পরিবর্তেনে রান্নাঘরে এখন ননস্টিক ফ্রায়িং প্যান, কড়াই, তাওয়ার দাপট। কিন্তু এই ননস্টিকে ভাজা খাওয়ার ফল কত মারাত্মক, তা সম্ভবত অনেকের ধারণাতেই নেই। গবেষণা বলছে, ননস্টিকের ফ্রাইং প্যান বা কড়াই স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রান্নায় এ পাত্রগুলো ব্যবহারের ফলে ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে।

গবেষকদের মতে ননস্টিকের বাসনপত্র তৈরি হয় ‘পারফ্লুওরোয়ালকাইল কম্পাউন্ড’ (পিএফসি) দ্বারা। এই যৌগকেই ভয়ের কারণ বলে চিহ্নিত করছেন। চিকিৎসকের মতে, ননস্টিক প্যান কিছু দিন ব্যবহারের পরেই রং উঠতে শুরু করে। ননস্টিকের পরত উঠতে থাকলে তাতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবারের সঙ্গে মিশে যায়, সেগুলো শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে।

 

সম্প্রতি আমেরিকায় পিএফসি যৌগকে ‘কার্সিনোজেনিক’ বলে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ, ক্যানসারের মতো মারণরোগের আশঙ্কা বাড়ে এই যৌগের ব্যবহারে। শুধু ক্যানসারই নয়, চিকিৎসকদের মতে থাইরয়েড, বন্ধ্যত্বের মতো রোগেরও কারণ এই পিএফসি।

 

ননস্টিকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মারণ রোগ ক্যানসারের বিষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ননস্টিক বাসনে যে টেফলনের প্রলেপ থাকে তা থেকেই শরীরে বাসা বাঁধছে হাজারো রোগ। ননস্টিকের বাসন এজন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।

 

ননস্টিক দিয়ে তৈরি রান্না করার জিনিসপত্রে যে ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে সেগুলো রান্নার সময় খাবারের মধ্যে চলে যায়। রান্নার সময় তাপ এসব জিনিসপত্র থেকে বিষাক্ত পদার্থ নির্গত করে, যা খাবারকে বিষাক্ত করে তোলে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ননস্টিক পাত্রে রান্না করলে কম তাপে রান্না করা ভালো। তবে শুধু যে ননস্টিক পাত্র থেকেই আপনার স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে, তা কিন্তু নয়। রান্নার আরো অনেক জিনিস থেকেই এই ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

 

ননস্টিকের সমস্ত পাত্রই টেফলন দিয়ে তৈরি করা হয়। এই টেফলন আসলে ‘পলিটেট্রা ফ্লোরো ইথিলিনে’-এর কোটিং। কোটিং এর খরচ কমাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টেফলনের সঙ্গে ‘পারফ্লোরোঅক্টানয়েট’ অ্যাসিড’- পলিমার দিয়ে প্রসেস করা হয়। ফলে উচ্চ তাপমাত্রায় ননস্টিকের পাত্রে রান্না করা হলে কিংবা পাত্রটি খুব তেতে গেলে ধোঁয়া উঠতে থাকে। এই ধোঁয়া খুবই মারাত্মক। যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে রক্তের সঙ্গে মেশে। আর যা কার্সিনোজেনিক।

 

ননস্টিক পাত্রে বেশি তেল দিয়ে রান্না কিংবা কিছু ভাজলে, সেই তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। প্রায় ২০০-২৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রা হয়ে যায়, ঘি দিয়ে কিছু ভাজলে তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রির বেশি উঠে যায়। তাপমাত্রার বৃদ্ধি বেশিরভাগ সময়ই আমরা বুঝতে পারি না। ফলে এই পাত্রের কোটিং বাষ্পীভূত হয়ে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে। রান্নার উপাদান বা খাবারে এই গ্যাস মিশে যায়।

 

চিকিৎসকদের মতে, যাদের খুব চুল ওঠে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের পিএফওএ পজেটিভ, টেফলনের পাত্র ব্যবহার করেন যারা, তার ৬৫ শতাংশই হাই কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভোগেন, মহিলাদের ৭০ শতাংশ আশংকা থাকে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার।

 

ননস্টিকের পাত্রে তেল কমে বেশি ভাজা যায়- এই ভেবে বেশি ভাজাভুজি খাবার এই পাত্রে খেলে সবচেয়ে বেশি বিপদ বাড়ে। প্রয়োজনে অল্প তেলে সাধারণ কড়াইয়ে ভাজলে উপকার। খুব কড়া করে ভাজতে ও ননস্টিকের পাত্রে স্টিলের হাতা খুন্তি দিয়ে রান্না করলে বিপদ বাড়ে। এক্ষেত্রে পিএফওএ প্রলেপ খুব সহজেই খাবারে মেশে। দীর্ঘদিন ধরে এই পাত্রের ধোঁয়া ইনহেল করলে, হঠাৎ করে জ্বরের প্রবণতা বেড়ে যায়।

 

এটি ভয়ঙ্কর রোগের পূর্বাভাস। এই পলিমারের প্রলেপ এক ধরনের অর্গানিক অ্যাসিড। যা নার্ভের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। হঠাৎ করে মনসংযোগের অভাব, স্মৃতিশক্তি কমে যায়। ননস্টিকের পাত্র চার-পাঁচ বছর টানা ব্যবহার করলে ক্ষতি বেশি।

 

বেশিরভাগই জানেন ননস্টিক মানেই টেফলন কোটিং। তা কিন্ত একেবারেই নয়। পলিটেট্রাফ্লোরো ইথিলিন বা টেফলনের কোটিং থাকলে অল্প তাপমাত্রায় রান্না করলে বিপদ কম। গ্যাস লো-তে দিয়ে, পানি দিয়ে ঝোল জাতীয় রান্না করলে ক্ষতি হয় না। বেশিক্ষণ ধরে ভাজাভুজি নয়। সাদা তেলে ভাজলে ধোঁয়া ওঠার আগে অবধি রান্না করলে নিরাপদ। ননস্টিকের পাত্র ধুতে স্কচবাইট ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে এই টেফলনের প্রলেপ ক্ষয়ে যায় দ্রুত, রান্না করলে সহজেই খাবারের সঙ্গে মেশে, কেনার সময় ভাল করে বুঝে নিন টেফলন বা পলিটেট্রাফ্লোরো ইথিলিনের কোটিং। লোহার ফ্রাইং প্যান ব্যবহার করা স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ।

 

ননস্টিক প্যান প্রি-হিট করবেন না। এটি গরম করার আগে খাবার বা কোনও তরল পদার্থ, যেমন - পানি ঢেলে দিন, যাতে তাপমাত্রায় টেফলন কোটিং ভেঙে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করতে না পারে। উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না না করার চেষ্টা করুন। ননস্টিক পটে খাবার রান্না করার সময় সর্বদা কাঠের চামচ ব্যবহার করুন।

ননস্টিক পাত্র পুরনো হয়ে গেলে এবং টেফলন কোটিং উঠে গেলে পাত্রটি পরিবর্তন করুন। ননস্টিকের পাত্র ধোয়ার সময় স্কচবাইট ব্যবহার করবেন না। কারণ এর ফলে এ টেফলনের প্রলেপ দ্রুত ক্ষয়ে যায়।

ননস্টিক প্যানের চেয়ে লোহার পাত্র ব্যবহার করা নিরাপদ। এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কম থাকে। এছাড়া চিনা সিরামক স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। সিরামিকের তৈরি কাপ, প্লেট ইত্যাদি জিনিসগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। আপনি মাইক্রোওয়েভ ওভেনে সিরামিক কাপে চাও বানাতে পারেন।

 

বিপদ এড়াতে ফিরে যেতে হবে পুরনো অভ্যাসে। বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে হবে স্টেনলেস স্টিলের বাসন। এ ছাড়া, ব্যবহার করতে পারেন সেরামিক বা কাস্ট আয়রনের বাসনও। তেল কম খাওয়ার অজুহাতে ননস্টিকের তাওয়া নয়, বরং স্টিল, কাস্ট আয়রন, লোহা বা সিরামিকের বাসনে অল্প তেল দিয়েই খাবারদাবার ভাজুন। এতেই শরীর থাকবে সুস্থ। তেল কম ব্যবহার করতে ভাপিয়ে রান্না করতে পারেন। এ ছাড়া, রান্নায় দই ব্যবহার করলে তেল কম দিলেও চলে।

 

(ঢাকাটাইমস/২৪ সেপ্টেম্বর/আরজেড)