বাংলাদেশের ফুটবল ও নেতৃত্ব প্রশ্নে...

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৩৯

কামরুল হাসান নাসিম

অপরিক্ষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকর। বলেছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটস। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত নয়। অসাধারণ পর্যায়ের বা পরীক্ষিত জীবনধারীদের উদ্যোগে এই পৃথিবীতে সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। অর্থাৎ, বিদগ্ধশ্রেণিকর্তৃক চিন্তা করার আহবান ও ক্যানভাস বিতরণ করার উদাহরণ। কিন্তু, শিল্পী সংখ্যার অপ্রতুলতায় মানুষ ফলত দর্শক বনে একদিন গ্রহান্তরিত হচ্ছে। সঙ্গত বাস্তবতায় মানুষ কার্যত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে নেতৃস্থানীয় চরিত্রের সন্ধানকরত উৎসুক শ্রেণির মতো করেই প্রতিনিধিত্ব করে বসে রয়েছে। অথচ, বোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে নিজের জীবন,  সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীর কল্যাণে প্রত্যেকের ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল বা আছে। 

চিন্তা করার শক্তি মানুষকে আত্মজিজ্ঞাসায় ভাসায়। সেখান থেকেই তৈরি হয় বোধ। বোধ তখন পরীক্ষিত জীবনকে আলিঙ্গন করতে চায়। পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছেশক্তি মানুষকে বলয় দেখায়। বলয় জানান দেয়, তুমি এখন রাজনৈতিক চিন্তায় আচ্ছন্ন কিংবা সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে চাও। তোমার দেশের নিজেদের সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে, চল তবে ! চলার পথ তখনই আন্তর্জাতিক অভিযাত্রায় প্রবেশ করে গন্তব্য খুঁজে নেয়, যখন তুমি সেরাটা দিতে পারছো। কিন্তু, সেরাটা দিতে চাইলে তোমাকে আগে স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন দেখার মানুষ কম। চলুন, স্বপ্ন দেখে কার্যকর বক্তব্যে থিতু হয়ে বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে কিছু কথা বলাই যাক। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজ্যে ফুটবল খেলতে পারা ও এই খেলার দর্শক হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা রয়েছে। তবে, কার্যকর সংগঠক, মেধাবী খেলোয়াড় ও বুঝদার দর্শক তৈরি না হতে পারার দরুন, বাংলাদেশের ফুটবল সাংস্কৃতিক মনকোষে আবেগের কেন্দ্রীভূত উদ্রেক হলেও, আফসোস বাড়ছে! বৈশ্বিক চরিত্র ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কিংবা লিও মেসিদের ফুটবল দেখে মন ভালো করার চেষ্টা! অথচ, বাংলাদেশ বায়ান্ন বছরে একটা প্রত্যাশিত অবস্থানে চলে গেলেও যেতে পারত, এমন অভিমত গুটিকয়েক বিদগ্ধসত্তার, যারা মনে করেন, যে দেশ শেখ কামালের মতো উচ্চাভিলাসী সাংস্কৃতিক সংগঠক পেয়েছিল, তাঁর স্বপ্নগুলো ধারণে যেয়ে ফুটবলটা এগোতে পারতই! কেন থমকে গেল বাংলাদেশের ফুটবল? অনেকেই এখনো আফসোস করে বলেন, শেখ কামাল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ এর মধ্যে একাধিকবার করে বিশ্বকাপ ফুটবলই খেলে ফেলত! 

ধরে নিলাম আজকের বাস্তবতায় জামাল ভুঁইয়ারা মাঠে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করেছে। করছেও। গেল দুই বছর ধরে বাংলার দামাল ছেলেরা খেলছে বেশ। বাংলাদেশের স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের ফের্নান্দেস কাবরেরার অধীনে সব খেলার ফল নিজেদের অনুকূলে না আনা গেলেও, বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে যে, আমরা উন্নতি করতে পারছি। এই উন্নতিও হতো না, যদি বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলে বসুন্ধরা কিংস এবং নতুন করে শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুলিশ, সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবগুলো নতুন করে উদ্যোগে না ভাসত।

 সন্দেহ নেই যে, দেশের দুই ঐতিহ্যবাহী দল মোহামেডান ও আবাহনীর প্রছন্ন প্রভাব আজ অব্দি মানুষকে তাড়া করে। কিন্তু, তারা তা পারেনি। কী পারেনি? তারা মানসম্মত ফুটবল খেলার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। বরং, এক অতি মানবিক ফুটবল সত্তা ইমরুল হাসানের পেশাদারী পর্যায়ে অসামান্য ভুমিকায় তথা সাংগঠনিক ব্যঞ্জনায় সিক্ত হয়ে বসুন্ধরা কিংস যে আগামীতে এশিয়ার শক্তি হতে সময় নেবে না, তা বোঝা যাচ্ছে। 

প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট দাবী করে, হাভিয়ের ফের্নান্দেস কাবরেরা কোনভাবেই তাঁর ছেলেদের দ্বারা বৈশ্বিক মানের ফুটবল খেলাতে পারতেন না, যদি গেল কয়েক বছরে বসুন্ধরা কিংসের মত ক্লাবের অর্থবহ আগ্রাসন ধরা না দিত। অর্থাৎ, পথ ওই ইমরুল হাসানের বসুন্ধরাই দেখিয়েছে। 

বাংলাদেশি দার্শনিক ঈশ্বরমিত্র বলেছেন, সামাজিক চুক্তির ফসলে মানুষের অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণ হবে না, তবে সাংস্কৃতিক সমরে ব্যস্ত থাকতে যেয়ে স্মাবলম্বি শ্রেণী নিশ্চিতাকারে আর্থিক ক্ষতি জেনেও সাধারণদের কাতারে বসবে, যখন তাঁরা খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতায় থেকে সাফল্যের সন্ধানেও ব্যস্ত হবে। 

সাফল্য, মুলত অর্জন ও প্রাপ্তির যোগফলে নিষ্পত্তিকৃত। বাংলাদেশের ফুটবলে বিপ্লব করতে হলে প্রয়োজন, প্রথমত, ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবলকে ইন্ট্রিডিউস করা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলকে চাঙ্গা করা। তৃতীয়ত, জেলা ফুটবল লীগ বাধ্যতামুলক বন্দোবস্তে আইন করে দেয়া। চতুর্থত, বাংলাদেশ লীগে খেলা করা প্রতিটি ক্লাবের পেশাদার হওয়া। যেমন, ক্লাবগুলোর  নিজেদের স্টেডিয়াম থাকতে হবে। এমন আইনে বাধ্য করা। স্টেডিয়াম নির্মাণে রাষ্ট্র সহায়তা করতে বাধ্য থাকবে। 

পঞ্চমত, ইউরোপের দেশ জার্মানিতে একটি ফুটবল একাডেমি করা--- যেখানে দেশের চব্বিশটি পরিবারের মধ্যে বাবার দৈহিক উচ্চতা ছয় ফুট ও মায়ের দৈহিক উচ্চতা পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি আছে, এমন দশ বছরের শিশুদের ফুটবল স্কিলস দেখে ওই একাডেমীতে খেলা ও পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দুই বছর পরে আরো একটি চব্বিশ জনের নতুন ব্যাচ একাডেমিতে যোগ দেবে। ইউরোপের ট্রেইনার, ফিজিও ও সমন্বয়ক মিলিয়ে ত্রিশ জন দিয়ে শুরু হবে। দুই বছরে সে সংখ্যা ষাটে গিয়ে ঠেকবে। এতে করে আমরা আগামী দশ বছরের মধ্যে দুর্দান্ত পর্যায়ের স্কোয়াড গঠনে কিছু কোয়ালিটি খেলোয়াড় পেয়ে যাব। যারা, কখনই আগামী দশ বছরে বাংলাদেশে আসতে পারবে না। তাঁদের অভিভাবকদের বছরে দুই বার করে রাষ্ট্র কর্তৃক বাচ্চাদের সাথে দেখা করার বা সফর করার সুযোগ রাখা হবে। তাঁদের বয়স যখন আঠার কিংবা কুড়ি হবে, বিশ্বাস করি, তাঁরা বিশ্বমানের হয়েই বাংলাদেশকে সার্ভিস দেবে। তাঁদের উচ্চতা পরিণত  সময়ে ছয় ফিট দুই কি তিনে থাকবে, নিশ্চিতাকারে বলা যায়।  এমন উদ্যোগটির বাস্তবায়নে দেশি ও বিদেশি বহুজাতিক সংস্থা পৃষ্ঠপোষকতায় থাকবে। সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রনালয়েরও আলাদা বাজেট করতে বাধ্য করা হবে। 

সাফল্য তাই পেতে হলে সংগ্রামী ফুটবল সংগঠক দরকার। যারা ফুটবল ফেডারেশন পরিচালনা করবে। কারো ব্যক্তি পছন্দে শীর্ষ আসন নেয়ার প্রচলিত রুগ্ন রেওয়াজের পথে অন্তরায় হয়ে অন্য সুর ধরে বলতে হবে, ফুটবলের স্বার্থে শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের সংস্কৃতিসত্তাদের মূল্যায়ন কর। প্রয়োজনে, ফুটবল বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। ফুটবল মন্ত্রীর সাথে ফেডারেশনের  মানসম্মত সভাপতি ও অন্যান্য দক্ষ, সৎ ও আধুনিক সংগঠকদের পেলেই তো বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অনিবার্য বাস্তবতায় বর্তমান সভাপতি কাজী সালাহউদ্দীনকে বৈশ্বিক পর্যায়ে সমন্বয় করার জন্য ফুটবল দূত হিসাবে সরকার নিয়োগ দিক। মন্দ হয় না। সে যোগতাটা তাঁর আছে। কিন্তু, ফুটবল ফেডারেশন থেকে তাঁকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেয়ার সময় হয়েছে। সালাম মুর্শিদীদের ফেডারেশন থেকে অব্যাহতি দিয়ে ফ্রাঞ্চাইজি ফুটবলে মন দেয়ার তাগিদ রাখা যেতে পারে। কোনো ক্লাবের মালিক হয়ে তিনি সংগঠক হিসাবে জাত চেনাক। নতুন করে একটা ক্লাবের অর্থবহ দায়িত্ব তিনি নিক। 

রাষ্ট্র ও যেকোন সরকারকে বুঝতে হবে, দুই একটি ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের দ্বারা স্বার্থ সংরক্ষিত হয় না। যেমন, বাংলাদেশের নদী, পানি বিশেষজ্ঞ হিসাবে আপনাকে ডক্টর আইনুন নিশাতের দ্বারস্থ হতে হবে। একজন জামিলুর রেজা চৌধুরী কিংবা রেহমান সোবহানদের মত মানুষগুলোর বিষয়ভিত্তিক সাহায্য অতীতে নেয়া হয়েছে তো। ঠিক একইভাবে ফুটবলের জন্য প্রয়োজনে বাফুফে সহসভাপতি ইমরুল হাসানের মতো প্রফেশনাল ক্যারেক্টারকে যথাযথ দায়িত্ব দেয়ার মৌন সমর্থনে থাকতে হবে দেশপ্রেমিক সরকারকে, ক্লাবগুলোর কাউন্সিলরদের। ফিফা কিংবা এএফসির ডক্ট্রিন মোতাবেক ফুটবল ফেডারেশন চলুক, কিন্তু আমরা আমাদের ভাল না বুঝতে পারলে, সংকট কাটবে না। ফুটবলের সাফল্য পেতে হলে সব পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 

পূর্বসূরী দার্শনিক সক্রেটস এর আরেকটি মতবাদ ছিল এমন। তিনি বলেছিলেন, ব্যস্ত জীবনের অনুর্বরতা সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। ফুটবল ফেডারেশনে যারা দায়িত্ব পাচ্ছেন, সকলেরই নিজস্ব আলাদা পেশাজীবন রয়েছে। তাঁরা ব্যস্ত। ফুটবল হল সালাম  মুর্শিদীদের কাছে তাঁদের জীবনধারায় যৌগিক পর্যায়ের স্বস্তিসুলভ উপলক্ষ। ফুটবলে অনিবার্য সাফল্য, জীবনের মৌলিক ডিমান্ড  হয়ে তাঁদের অস্তিত্বে ভর করে না। সে কারণে সফলতার বীজ রোপিত হচ্ছে না।  তাঁদের চিন্তার খোরাকের বিস্তীর্ণ ক্ষেতটি অনুর্বর হয়ে পড়ছে পেশাগত ব্যস্ততায়, উদাসীনতায়। ব্যক্তি তাগিদে তা তাঁরা নিজেরা বুঝতে চাইবে না। এই জন্য তাঁদেরকে পথ দেখিয়ে বলতে হবে, ফুটবলে থাকতে চাইলে, এটা কর, সেটা কর। 

সৎ থাকাটাও জরুরী। আরেক গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন,  ”যে জীবন সৎকাজে ব্যয় হয় না তাকে কিছুতেই শিষ্ট বলা চলে না।” অথচ, ফুটবল ফেডারেশনের নেতাদের বক্তব্য রাখার যে ঔদ্ধত্য, তা তাঁদেরকে মহান করে না। তিনিই সৎ, যিনি দায়িত্ব নিয়ে বিতর্কের বাইরে বসবাস করতে পারেন। প্লেটো তো এও বলেছিলেন, যত ধীরেই হোক, কেউ যদি ক্রমাগত এগোতে থাকে তাকে কখনো নিরুৎসাহিত করো না।“ কিন্তু ক্রমাগত এগোনোর নন্দিত রুপে সজ্জিত হতে পারেনি বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশন। বাংলাদেশের সকল ফুটবলপ্রেমি জনশ্রেনীকে তাই বলব, ফুটবলের ক্রমবিকাশে মুল চালিকা শক্তি হল, কতকগুলি প্রকৃত মানুষের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের স্বপ্ন ও বাস্তবায়নে অদম্য হয়ে পথচলা নির্ধারণ করার সড়ক।  যে সড়কে পথিক হয়ে তোমার রাষ্ট্রের পতাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করে ময়দানে যাও। তখন, সাফল্য আসবেই।


লেখক: প্রধান সম্পাদক, ক্রীড়ালোক।