সন্তান, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা
প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৩, ২২:৫৯ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ২৩:০১
এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন আমার কাছের একটি পরিবারের কথা মনে পড়ছে এবং আফসোস হচ্ছে। প্রবাসীর এই পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যের বয়স প্রায় পাঁচ বছর। ছয় সদস্যের পরিবারটিতে এই শিশু সন্তান নিয়ে মহাবিপদে তার মা। এর পেছনে রয়েছে শিশুটির স্মার্টফোন আসক্তি। নিজের ব্যস্ততার সময়ে শিশুটির হাতে তার মা তুলে দিয়েছেন স্মার্টফোন। ভেবেছেন এর মাধ্যমে সন্তানকে লালন-পালনে বেশ উপকৃতই হবেন তিনি। কিন্তু দিনে দিনে অভিভাবকের পরিবর্তে সেই যন্ত্রই হয়ে উঠেছে শিশুটির বন্ধু। স্মার্টফোন ছাড়া এখন আর শিশুটির চলেই না। সন্তান যেন স্মার্টফোনের নেশায় না ডুবে যায়, সে জন্য কিছু বিষয় আপনার খেয়াল রাখা উচিত-
সময় যাওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিন: মাটি নরম থাকতে সেই মাটিকে যেকোনো আকৃতি দেওয়া যতোটা সহজ, তেমনি মাটি শক্ত হয়ে যাওয়ার পর সেটির আকৃতি পরিবর্তন করা ততোটাই কঠিন হয়ে যায়। অর্থাৎ শিশুদের স্মার্টযন্ত্রের আসক্তি থেকে দূরে রাখতে শুরু থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সন্তান খেতে না চাইলে বা কোনো কাজ না করতে চাইলে হুটহাট স্মার্টফোন দিয়ে বসবেন না। বরং সন্তানকে আপনি সময় দিন, বাস্তবতা বুঝিয়ে যেকোনো কাজ ঠিকভাবে করানোর চেষ্টা করুন।
আগে নিজেকে ঠিক করুন: যা আপনি করবেন না, তা অন্যকে করতে বলা অনুচিত। মানুষের সর্বপ্রথম ও প্রধান শিক্ষাঙ্গণ হলো মায়ের কোল। শিশুরা তার মা-বাবাসহ আশপাশের মানুষের কাছ থেকে শেখে। মা-বাবার স্মার্টফোন আসক্তি থাকলে সন্তানও এর বাইরে থাকবে না। তাই সন্তানের সামনে প্রয়োজন ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না।
সন্তানকে সময় দিন, দূরত্ব কমান: নিজেদের ব্যস্ততার কারণে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন দেবেন না। যত ব্যস্ততাই থাকুক, সময় করে শিশুর সঙ্গে কথা বলুন, গল্প করুন। এতে যেমন আপনার সঙ্গে সন্তানের হৃদ্যতা বাড়বে, তেমনই ভালো সময়ও কাটবে। সন্তানের সঙ্গে আপনার অযাচিত দূরত্বও তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা পাবেন।
ডিভাইসের সঙ্গে শিশুর দূরত্ব রাখুন: শিশুদের নাগালের মধ্যে স্মার্টফোন রাখবেন না। অনেক সময় আপনার সাহায্য ছাড়াই শিশুটি স্মার্টফোন ব্যবহার শুরু করবে। এভাবেই একসময় তার আসক্তিতে পরিণত হবে। তাই যথা সম্ভব আপনার অনুপস্থিতিতেও শিশু যাতে নাগাল না পায়, এমন জায়গায় স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসগুলো রাখুন।
উপহার হিসেবে স্মার্টফোন নয়: উপহার সবসময়ই আনন্দের, উৎসাহের। তবে অনেক অভিভাবকই সন্তানকে কোনো কাজে অনুপ্রাণিত করতে স্মার্টফোন উপহার দিতে চান। এতে শিশুটি নিজের কাজে মনোযোগী হয় ঠিকই, তবে ভবিষ্যতে শিশুটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একবার উপহার হিসেবে স্মার্টযন্ত্র পেলে পরবর্তী সময়ে যেকোনো কাজের জন্যই উপহার হিসেবে এমন যন্ত্র প্রত্যাশা করবে। সেক্ষেত্রে উপহার মনের মতো না হলে শিশুটি হতাশাগ্রস্ত হতে পারে।
শিশুর অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য: সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগীদের নিয়ে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সবশেষ জরিপ (২০২৩-এর প্রতিবেদন) বলছে, ভুক্তভোগীদের প্রায় ১৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের কম। এটি খুবই উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশে শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে ২০১৯ সালের ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া ১৯ শতাংশ শিশুই ইন্টারনেটের অপর প্রান্তের ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়েছে যৌনতাবিষয়ক অযাচিত বার্তা। ১২ শতাংশ যৌনতাবিষয়ক ছবি বা ভিডিও পেয়েছে। ৫ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তাদেরকে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন ছবি-ভিডিও পাঠানোর জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে। ৩২ শতাংশ শিশু, তাদের চেহারা, পরীক্ষার ফলাফল, ধর্ম নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে।
করোনা মহামারির সময় থেকে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমের অনলাইন নির্ভরতা, অবসর সময়ের আধিক্য, অধিক সময় বাড়িতে থাকা ইত্যাদি কারণে শিশুর অনলাইন ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে শিশুর সাইবার ঝুঁকি। ইন্টারনেটে বয়স-অনুপযোগী কন্টেন্ট, ভিডিও গেম, রিলস, ইত্যাদি তাদের মনোজগতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। যার ফলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করুন: এই সময়ে প্রযুক্তি থেকে শিশুদের দূরে রাখা বাস্তবসম্মত নয়। দক্ষ করে গড়ে তুলতেও শিশুদের স্মার্টযন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। কার্টুন দেখা, গেম খেলা—শিশুদের খুবই স্বাভাবিক প্রবণতা। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি কাজে তাকে সময় বেঁধে দিন। সময় শেষে তাকে বুঝিয়ে যন্ত্রটি সরিয়ে আনুন। এতে তার মধ্যে যেমন সময়ানুবর্তিতা তৈরি হবে, তেমনি পর্দার প্রতি আসক্তিও কমে আসবে।
নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতেই: শিশুরা কতক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, তা নির্ধারণের পাশাপাশি ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সুবিধার মাধম্যে শিশুর জন্য অনুপযুক্ত সাইটগুলো ব্লকও করতে হবে। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল হচ্ছে শিশুদের জন্য আপত্তিকর বা অনুপযুক্ত ওয়েবসাইট ব্লক বা ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ফিল্টার করার ব্যবস্থা। ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সুবিধাটি ব্যবহার করলে অনলাইনে অশ্লীল ওয়েবসাইট বা কনটেন্ট চালু হয় না। ফলে শিশুরা চাইলেও ওয়েবসাইটগুলোর কনটেন্ট দেখতে পারে না। এর পাশাপাশি চাইলে শিশুদের জন্য সাধারণ ইউটিউবের বদলে ‘ইউটিউব কিডস’ সংস্করণটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
শুধু তাই নয়, স্ক্রিন টাইম (ভিডিও বা কনটেন্ট দেখার সময়) নির্ধারণের মাধ্যমে শিশুদের ইউটিউবে ভিডিও দেখার সময়ও বেঁধে দেওয়া যাবে। ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সুবিধা কাজে লাগিয়ে অনলাইন জুয়া পরিচালনাকারী বিভিন্ন ওয়েবসাইটও ব্লক করে দেওয়া যায়। প্রতিদিন কোন সময়ে কতক্ষণ সন্তান ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে, তা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে দেওয়া যাবে। ফলে সন্তান আপনার অগোচরে তার জন্য উপযোগী নয়, এমন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে না পারার পাশাপাশি অতিরিক্ত সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে না।
নিজেও জানুন: সন্তানের নিরাপত্তার স্বার্থেই আপনাকে নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত জানতে হবে। নয়তো সন্তানকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে পদে পদে আটকাতে হতে পারে আপনাকে। আর নিজে যখন কোনো বিষয়ের ভালো-মন্দ দিকগুলো জানবেন তখন সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালনা করা সহজ হয়ে যাবে।
নিরাপদ ইন্টারনেট সম্পর্কে নিয়মিত জানতে মনে রাখুন এই ওয়েবসাইটগুলো: cyberawarebd.com, ccabd.org। বাংলাদেশে জানুয়ারি, মে এবং অক্টোবর মাসে বেশ কিছু বড় আয়োজন থাকে নিরাপদ ইন্টারনেট সম্পর্কিত। ওয়েবসাইটগুলো থেকে এ সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির বিষয়ে জানতে পারবেন এবং এর মাধ্যমে নিজের করণীয় ঠিক করতে সুবিধা হতে পারে আপনার।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন
.