কক্সবাজারের নাজিরারটেকে শুঁটকি শুকাতে ব্যস্ত শ্রমিকরা

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:০৫ | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১৪:২৮

ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার

দেশের বৃহৎ শুঁটকি মহাল কক্সবাজারের নাজিরারটেক। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয় এখানকার শুঁটকি। আর এ খাত থেকে সরকারের লাখ লাখ টাকা রাজস্ব অর্জিত হচ্ছে।

কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে এখন চলছে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। তবে আগামী ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

এই ২২ দিন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা কঠোর নজর রাখবেন। এ সময় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মানতে হবে জেলে, আড়তদার, বিপণনকারী, গুদামজাতকারী ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের। আর আইন অমান্যকারীকে মৎস্য আইনে সাজা দেওয়া হবে। এরপর মাছ ধরা শুরু হলে পুরোদমে মহালে কর্মব্যস্ত থাকবে শ্রমিকরা। তখন শীতের মৌসুমেও রোদের আলোতে মাছ শুকাতে সুবিধা হয়।
শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের ধারণা এ বছর মৌসুমের ২ মাস পার হয়ে গেলেও বর্তমানে আগের চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদন ও রপ্তানি হচ্ছে নাজিরারটেকের শুঁটকি। আর এসব শুঁটকি উৎপাদনে নিয়োজিত আছেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে শুধু মাত্র নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় দুই থেকে আড়াইশ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
নাজিরারটেক নামক বিস্তুত ১০০ একর এলাকায় শুঁটকি মহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সাগরের বেঁড়িবাঁধ এবং বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার ওপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়।

নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে গিয়ে দেখা যায়, শুঁটকি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কর্মচাঞ্চল্য। যার যার মত সবাই ব্যস্ত। এভাবে নারী-পুরুষসহ প্রায় চার-পাঁচ হাজার শ্রমিকের আয়-রোজগারের উৎস এই নাজিরারটেক।

রোদে শুকানো হচ্ছে শুঁটকি। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের নয়মাস এখানে শুঁটকি উৎপাদন চলে। তবে, সাগরের বেড়িবাঁধ এবং বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার ওপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। দেশে প্রথমবারের মতো শুঁটকি উৎপাদনে জাতীয় মৎস্য পুরস্কারপ্রাপ্ত শাহ আমানত ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমান উল্লাহ আমান রাসায়নিকমুক্ত অর্গানিক শুঁটকি উৎপাদন করে যাচ্ছেন। নিত্যদিন পর্যটক ও ক্রেতার ভিড় বাড়ছে তার শুঁটকি মহালে।  

নাজিরারটেক মহালে ছোটন নামে এক ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন সোলাইমান ও ফাতেমা।

তারা বলেছেন, বছরে ৭-৮ মাস শুঁটকি মহালে কাজ করছে এককালিন দেড় লাখ টাকা করে। থাকা ও খাওয়া মালিকের। মহালে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত থাকতে হয়। মাচার পাশে থেকে মাছ পরিচর্যা করতে হয়। বর্তমানে তাদের মহালে অনেক মাছ রয়েছে।

ব্যবসায়ী ছোটন জানান, তার শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে আছে। তাদের কাজও ভালো। এবছর নতুন তিনজন শ্রমিক কাজ করছেন।
তাদের পাশের আড়তে শুধু বড় বড় পোয়া মাছ শুকানো হচ্ছে, সেখানে কথা হয় শ্রমিক হোসাইন ও সোলাইমানের সাথে।

তারা বলেন, দুইমাস আগে থেকে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। এখন শুধু বড় বড় পোয়া মাছ শুকানো হচ্ছে। মাচা ও উপরে আজকে অনেক মাছ তোলা হয়েছে। এভাবে রোদ থাকলে ১০-১২ দিনের মধ্যে একদশ শুকিয়ে যাবে মাছ। তারপর ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিদেশে নিয়ে যাবেন মাছগুলো।

শুঁটকি ব্যবসায়ী মো, শহিদুল শাহী শহিদ জানান, শীত মৌসুম শুরুর আগে থেকে নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এবছরও রুপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা পোপা, টেকচাদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যামাছসহ ১৮-২০ প্রজাতির শুঁটকি এ মহালে উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পক্ষ থেকে শুঁটকি উৎপাদনে শ্রমিকদের সামান্য প্রশিক্ষণ এবং ভাতা পেলেও তা যথাযথ নয় বলে দাবি করেন তিনি। শ্রমিকদের আধুনিক ও সঠিকভাবে শুঁটকি উৎপাদনের আরো বেশি মৌলিক ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়ার গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তাহলে এই নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে। বর্তমানে কোস্ট ফাউন্ডেশন বিভিন্ন সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাদের মতো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসলে সবাই উপকৃত হবে।


মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির অর্থ সম্পাদক কায়সার জানান, কক্সবাজারের আবহাওয়া শুঁটকির শুকানোর জন্য খুবই উপযোগী। লবণাক্ত আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচা মাছ শুকানোর জন্য এই মহালে আনা হয়ে থাকে। উৎপাদনও খুব ভালো হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারের নাজিরারটেকের শুঁটকি নিতে এখন দেশ-বিদেশের সকল মানুষ নিজেই এসে এবং পার্সেল যোগেও নিয়ে যাচ্ছে। যা এই শুঁটকি মানুষের চাহিদা এবং প্রোটিনের বড় একটি অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে।
অপরদিকে কিছু ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, কিছু অসাধু শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা কীটনাশক ব্যবহার করছে। যার ফলে মানুষ শুঁটকি খেলে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে।

নাজিরারটেকের শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের এই বৃহৎ শুঁটকি মহালে দিন দিন উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উক্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মৎস্যজীবীদের মাঝে কোন প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

তারা আরো বলেন, কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও কক্সবাজারের শুঁটকি না নিয়ে কক্সবাজার ছাড়তে চান না। এছাড়া অনেক শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী এই মহাল থেকে পাইকারী হারে মাছ কিনে তা বিভিন্ন বাজার ও মহল্লায় নিয়ে বিক্রি করে থাকে।

সূত্রে আরো জানা গেছে, গত ৮০ দশকের শুরু থেকে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক এলাকাসহ মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, টেকনাফের বাহারছড়া, শাহপরীরদ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে। সেই থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন মহালের শুঁটকি দেশে ব্যাপক প্রচার প্রসার লাভ করে। এরপর মধ্যপ্রাচ্য, সৌদিয়া, দুবাই, হংকং ও কুয়েতসহ বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু করে ব্যবসায়ীরা। শুঁটকি রপ্তানি করে প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এবং সরকার এ খাত থেকে পাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।

নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমূখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ কোম্পানী জানান, প্রায় ১শ একর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা এ শুঁটকি মহালে রয়েছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ত। দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি মহাল হলো এই নাজিরারটেক। এখন শুঁটকি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক ও প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ী। প্রতিদিন প্রায় দুইশ টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হচ্ছে।

স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলর শাহেনা আকতার পাখি বলেন, নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল দেশের বৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এখানকার শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং সরকারের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিলে আরো লাভবান হওয়া যাবে। সরকারও অর্জন করবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।

কোস্ট ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক (টিম লিডার) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুঁটকি মহালে কোস্টের অনেক প্রকল্প কাজ করছেন। তারমধ্যে নিরাপদ শুঁটকি, পোল্ট্রি (খাদ্য), কোল্ট স্টোরেস, কাঁকড়া চাষ, শ্রমজীবী মহিলাদের জন্য ব্রেস্ট কর্ণার ও সকল শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ব্যবসায়ীদের দাবি-অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শুঁটকির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত হলে পর্যটক, ক্রেতা ও পরিবহন অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে।  

বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ করে ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। শুধু কক্সবাজারে নয়, এখানে উৎপাদিত শুঁটকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। দেশের মানুষের প্রোটিনের বড় একটি অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে। এমনকি শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান জানান, পর্যটন শিল্পে আরেকটা ধাপ এখন শুঁটকি। পর্যটকদের এখন নিয়মিত কেনাকাটায় মাত্রা যোগ হয়েছে এখানকার শুঁটকি। দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকি মহাল কক্সবাজারের নাজিরারটেক এলাকা। এখানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবসময় তদারিক করা হয়। মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে সচেতনতার প্রোগ্রামও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

(ঢাকা টাইমস/০৮অক্টোবর/এসএ)