প্রবাসীদের ফ্রি টিকিটে দেশে আসার প্রলোভনে চোরাচালান, জিম্মি স্বজন

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:০৫ | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:৩৫

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস

বিদেশ থেকে ফ্রি টিকিটে দেশে আসার সুযোগ দিয়ে বিজ্ঞাপন। এরপর শর্ত দেওয়া হতো সঙ্গে কিছু নেওয়া যাবে না। টিকিটদাতার একটি লাগেজভর্তি অবৈধ স্বর্ণ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনী ও অন্যান্য মূল্যবান পণ্যসামগ্রীসহ নির্দিষ্ট ওজনের একটি লাগেজ ধরিয়ে দেওয়া হতো হাতে। বলা হতো বাংলাদেশে পৌঁছলে বিমানবন্দর থেকে লাগেজটি সংগ্রহ করবেন তাদের লোক। আর এই মালামাল বুঝে পাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই প্রবাসীর স্বজনকে জিম্মি করে রাখা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে চোরাচালান কারবারি চক্র।

সম্প্রতি এক প্রবাসীর বাবাকে জিম্মি করার অভিযোগে চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ডসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শান্তিনগরে অপহৃত প্রবাসীর বাবাকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের তিনজনকে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- খোরশেদ আলম (৫২), জুয়েল রানা মজুমদার (৪০) ও মাসুম আহমেদ (৩৫)।

শুক্রবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব জানায় সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের কাছ থেকে বিপুল স্বর্ণ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রসাধনী, অন্যান্য মূল্যবান পণ্যসামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। এসবের আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

 

খন্দকার আল মঈন বলেন, গত সোমবার রাতে যশোরের চৌগাছা থেকে সৈয়দ আলী মন্ডল (৬৫) সৌদি প্রবাসী ফেরত ছেলেকে নেওয়ার জন্য ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এসে নিখোঁজ হন। পরিবার সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুজি করে তাকে না পেয়ে ভুক্তভোগী আলীর মেয়ের  জামাই রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এছাড়াও পরিবার র‌্যাব-৪ এর উদ্ধারের জন্য আবেদন করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় র‌্যাব-৩ এবং র‌্যাব-৪ এর একটি যৌথ অভিযানে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ ও অপহৃত সৈয়দ আলীকে উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা উক্ত অপহরণের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন।

সৈয়দ আলীর ছেলে ও প্রবাসী নুরুন্নবীর বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, সৈয়দ আলীর ছেলে প্রবাসী  নুরুন্নবী চলতি বছরে ২০ আগস্ট উন্নত জীবনযাপনের আশায় সৌদি আরবে যান। কিন্তু সেখানে ভালো চাকরি সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় চক্রের মধ্যপ্রাচ্যের মূলহোতা আবু ইউসুফ এবং তার সহযোগীরা নুরুন্নবীর আর্থিক দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাকে বাংলাদেশে আসার ফ্রি বিমানের টিকেট দেওয়ার প্রস্তাব দেখায়। এ জন্য চক্রের দেওয়া স্বর্ণালংকারসহ বেশকিছু দামি কসমেটিক্স পণ্য, ইলেকট্রনিকস আইটেম, চকলেট ভর্তি লাগেজ দেশে নিয়ে আসতে হবে।

বিমানবন্দর এসে এই লাগেজ চক্রের দেশীয় অন্যতম মূল হোতা খোরশেদ আলমের কাছে পৌঁছে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। এই শর্তে রাজি হন প্রবাসী নুরুন্নবী। গত ৯ অক্টোবর প্রবাসী নুরুন্নবীর বাবা সৈয়দ আলী একই তারিখ রাতে ছেলেকে রিসিভ করতে ঢাকায় আসেন। কিন্তু চক্রের সদস্যরা অভিনব কৌশলে তাকে অপহরণ করে । ইউসুফের পাঠানো পণ্য নিরাপদে বুঝে পেতে সৈয়দ আলীকে জামানত হিসেবে জিম্মি করা হয়। 

 

গ্রেপ্তার প্রতারকদের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক চক্রে ১২ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। চক্রটি একজন বিমানযাত্রীর যে পরিমাণ মালামাল বহনের সুযোগ থাকে তার সম্পূর্ণটাই তারা ব্যবহার করত। শুল্ক ফাঁকি দিতে তারা এমন কৌশলে ৫/৬ বছর ধরে এভাবে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন পণ্য দেশে আনতো। যা দেশের মার্কেটে বিক্রি করত। আসছিল।  চক্রটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বসবাস করে এমন এলাকাগুলোসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিত। এটা দেখে কেউ যোগাযোগ করলেই ফাঁদে পরেন প্রবাসীরা। তাদের দেওয়া স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রীতে পূর্ণ ২৫ থেকে ৩০ কেজির ওজনের লাগেজ দিত।

লাগেজে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের পণ্য থাকে। এছাড়াও যারা ফ্রি টিকিটে দেশে আসতে চায় প্রথমে তাদের পাসপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয়। এরপর প্রবাসী বিমানে ওঠার পরে তার অজান্তেই স্বজনদের অপহরণ করে জিম্মি করত। এরপর প্রবাসী ব্যক্তি  ঢাকায় পৌঁছানোর পর চক্রের কয়েকজন সদস্য বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকে। পরবর্তীতে প্রবাসী যাত্রী বাংলাদেশে পৌঁছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা মালামালের লাগেজ চক্রের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করার পরে জিম্মি থাকা স্বজনকে মুক্তি দেওয়া হয়।

গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের সদস্যরা এসব স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান পণ্য রাজধানীর গুলিস্তান ও পল্টনসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করত। বিদেশ থেকে নিয়ে আসা একটি লাগেজের পণ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন মার্কেটে ১৫-২০ লাখ টাকায় বিক্রি হত। পরবর্তীতে মালামালের বিক্রিত টাকার লভ্যাংশ একটি অংশ খোরশেদ নিজে রেখে বাকি একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে ইউসুফের কাছে পাঠাত।  

গ্রেপ্তার খোরশেদ ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সৌদি প্রবাসী ছিল। বিদেশে বসে চক্রটি গড়ে তোলে। এরপর চলতি বছরের শুরুতে দেশে এসে চক্রের মূলহোতা হিসেবে দায়িত্ব নেয়। 

গ্রেপ্তারকৃত জুয়েল শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে আসা পণ্যগুলো নিজেদের কাছে রাখত। জুয়েলের গাজীপুরে সাইকেল ও রিক্সার পার্টসের ব্যবসা ছিল। বিদেশ থেকে আনা মালামাল বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে বের করার কাজও করতো। তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর ও ওয়ারি থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে মাসুম জুয়েলের কসমেটিক্সের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। একটা সময়ে গাড়ি চালক ছিলেন। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক মামলা রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/১৩অক্টোবর/কেআর/কেএম)