​মেয়র সাদিককে নিয়ে নতুন আতঙ্ক

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৩৯ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৪৩

আলম রায়হান

বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে আছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জনগোষ্ঠীর আশা-ভরসার কেন্দ্র। বিপরীতে বিরুদ্ধ পক্ষ তাঁকে নিয়ে আছে আতংকে। একই ধারায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী রাজনীতিতে বেশ কয়েকজন নেতা গড়ে উঠেছেন যারা স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছে ভরসার কেন্দ্রস্থল। আর বিরুদ্ধ শক্তির কাছে মূর্তমান আতংক! এই ধারায় বাংলাদেশে বিশেষভাবে আলোচিত ছিলেন ফেনীর জয়নাল হাজারী। নারায়ণগঞ্জে আছেন শামীম ওসমান এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় এরকম আরো কিছু আলোচিত নেতা আছেন। যারা দলের পদের চেয়েও আগানো। এই তালিকায় বরিশালে আছেন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু বরিশালের রাজনীতিতে তার অবস্থান অসাধারণ উচ্চতায়।

আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্রে একই খতিয়ানভুক্ত হলেও মেয়র সাদিক আছেন ভিন্ন অবস্থানে। কারণ তিনি হচ্ছেন উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতির দুই বিশাল ঝর্ণাধারার উত্তরাধিকার। এ ছাড়াও তিনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যালীলায় রক্তস্নাত। সেই কালরাতে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মনি এবং বরিশালের মেয়র সাদিকের দাদা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে কিলিং মিশনের ঝাকঝাক তপ্ত বুলেটের অপারেশন চলে প্রায় একই সময়ে এবং আজকের দুই মেয়র সেদিন ছিলেন শিশু এবং ছিলেন পরিবারের আহত-নিহতদের সঙ্গে। আর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেমন শিশু রাসেলকে ঘাতকরা রেহাই দেয়নি, তেমনই আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে রেহাই দেয়া হয়নি শিশু শুকান্ত বাবুকেও। সেদিন দাদা ও ভাইসহ পরিবাবের ৬ সদস্যের লাশের রক্তের বন্যায় পড়েছিল আর এক শিশু সাদিক। যিনি এখন বরিশালের মেয়র। এ পদে তিনি থাকবেন ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত।  কিন্তু এখানেই কী শেষ? সম্ভবত না। আর এ কারণেই তাঁকে নিয়ে নতুন আতংক তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই আতংক ৭৫-এর থিংকট্যাংকের!

অনেকেই জানেন, রাজধানীর পর অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে বরিশাল নিয়ে ৭৫-এর থিংকট্যাংক একটু বেশিই কনসার্ন। আবার এর ঐতিহাসিক বাস্তবতাও আছে। বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়েছে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। আর গৌরবের এই ইতিহাস বরিশালে সৃষ্টি হয়েছে এক সপ্তাহ আগে, ৮ ডিসেম্বর। এবং দুর্ধর্ষ পাক সেনারা শিয়ালের মতো চুপিসারে পালিয়ে গেছে। এদিকে জীবনপণ লড়াই করে যারা বরিশাল হানাদারমুক্ত করেছেন তাঁরা ভারতে যাননি। আর বরিশালের যারা ভারতে হিজরত করেছিলেন তাঁরা এসেছেন বরিশাল হানাদারমুক্ত হবার পর। এর আগে কেবল মনসুরুল আলম মন্টুর নেতৃত্বে ৫০-৬০ সদস্যের বিএলএফ এর একটি প্রশিক্ষিত ও উন্নত অস্ত্রধারী দল বরিশাল মুজিব বাহিনী প্রধান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ক্যাম্পে রিপোর্ট করেন আশকর ক্যাম্পে।  কিন্তু তখন যুদ্ধ করার মতো তাঁদের কোনো প্রতিপক্ষ ছিলো না।  কারণ ততদিনে বরিশালের মুক্তিযুদ্ধের যবনিকাপাত হয়েছে।

এই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল। কিন্তু এই বরিশাল অর্জিত চেতনার ধারক হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বরং আর এক কলংকের সৃষ্টি করেছে ১৫ আগস্টের কাকডাকা ভোরে। বিশাল আনন্দ মিছিল হয়েছে বরিশালে। জাতির পিতার ছবির অবমাননা করা হয়েছে প্রকাশ্যে। এই অপকর্মের হোতাদের মধ্যে নূরুল ইসলাম মঞ্জু ছাড়া অনেকেই আওয়ামী রাজনীতিতে স্থান করে নিতে পেরেছেন। আর ১৫ আগস্ট অতি উৎসাহীদের শিরোমনী তো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই মহান জাতীয় সংসদে এমন পদ পেয়েছেন যে পদ প্রতি সংসদে মাত্র একটি থাকে। ১৫ আগস্টের ঘটনা প্রবাহ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘বেলা অবেলা’ গ্রন্থে খান আলতাফ হোসেন ভুলুকে উদ্ধৃত করেছেন, বরিশালে খন্দকার মোশতাকের মিছিলে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অন্যতম ছিলেন আ স ম ফিরোজ। একই তথ্য জাহাঙ্গীর কবির নানকও জানিয়েছেন সৈয়দ বোরহান কবীরের উপস্থাপনায় ‘ইনসাইড বাংলাদেশ’- এর টকশোতে।

বুঝতে কারোরই অসুবিধা হবার কথা নয়, মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বরিশাল ৭৫-এর পট পরিবর্তনে স্পষ্ট ইউটার্ন নিয়েছে। এবং এই অঞ্চলে চলে গেছে ৭৫ থিংকট্যাংকের রাজনীতির ধারক-বাহক বিএনপির নিয়ন্ত্রণে। এর কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ৭৫ পূর্ববর্তী আওয়ামী সরকারের আমলে বরিশালে বেপরোয়া আওয়ামী জুলুম। বিপরীতে ছিল আবদুর রহমান বিশ্বাসের নমনীয় রাজনৈতিক প্রবণতা এবং সকলকে সম্পৃক্ত করার উদারতা। পরে বরিশালে বিএনপির শক্ত ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মজিবর রহমান সরোয়ারের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব ও অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায়। এদিকে বৈরী এই রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে অন্যরকম দক্ষতায় শেষপর্যন্ত টিকে গেছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এবং তিনি পুরো বিভাগে আওয়ামী লীগের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। প্রতিপক্ষরা তাঁকে ভিতর-বাইরে কোনোভাবেই ‘সাইজ’ করতে পারেনি। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্টের পরও তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। তাঁর প্রতি গুলি হয়েছে একাধিকবার। প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন ভাগ্যক্রমে। পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিরুপায় হয়ে তাঁর প্রাকৃতিক মৃত্যুর অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করে ৭৫-এর থিংকট্যাংক। কিন্তু তাদের হিসাব এলোমেলো হয়ে যায় হাসানাত পুত্র সাদিকের রাজনীতিতে আসা এবং বরিশালের মেয়র পদে আসীন হওয়া। এরপরও পরাভব মানেনি প্রতিপক্ষ। বরিশাল থেকে ঢাকায়, অনেক কলকাঠি নাড়া হয়েছে। ফলে নগরবাসীর প্রত্যাশা অনুসারে তিনি উন্নয়ন কাজ করতে পারেননি বলে অনেকে মনে করেন। এর সঙ্গে গত ১২ জুনের মেয়র নির্বাচনে সাদিক আবদুল্লাহ মনোনয়ন না পাওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী অংশ এবং বাইরের অনেকেই বগল বাজাতে শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিষয়টি হয়তো তারা বিবেচনায় নেননি। আর যারা রাজনীতির গভীরের ইকোয়েশন বিবেচনায় নিয়েছেন তাদের মতে অন্যরকম আলামত এরই মধ্যেই অনেকখানি স্পষ্ট। তা হচ্ছে, সদর তথা বরিশাল-৫ আসনে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার জোর সম্ভাবনা।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি ধারণা উল্লেখ করা চলে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষদের এ অংশটি মনে করেন, আগামী সম্ভাব্য সংসদ নির্বাচন নানান দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘনীভূত জটিলতায় ভরপুর। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি হচ্ছে, দলের রাজনীতিকে অধিকতর জোরালো করা। ফলে বরিশাল সদর আসনে কোন শীতের পাখিকে মনোনয়ন দেয়া অথবা কোন শক্তির অনুরোধের ঢেঁকি গেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে এবার প্রায় অসম্ভব। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজধানী ঢাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই বরিশাল বিভাগের বাস্তবতায় গুরুত্বের কেন্দ্রে রয়েছে বরিশাল সদর আসন। ফলে সেরনিয়াবাত সাদিককে নিয়ে ৭৫-এর থিংকট্যাংক এবারও সম্ভবত হতাশ হবে। এর সঙ্গে দলের ভিতর তাঁর বিনাশ কামনাকারীদের প্রতিভূ কথিত যে ঈশ্বর সাদিকের ভিতর হায়না দেখেছেন তিনি হয়তো আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণার পর আয়নায় রাজনৈতিক মেষশাবক দেখবেন!

আলম রায়হান: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক