চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা কি ফিলিস্তিন সংঘাত দীর্ঘায়িত করবে?

প্রকাশ | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:০৬ | আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:৪৩

শাহনূর শাহীন

ফিলিস্তিনের গাজায় চলছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। যেই বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে এই সভ্য পৃথিবীর মানুষেরাই। শুধু মানুষ বললেই হবে না, পুরো ৮শ কোটি মানুষের নেতৃত্বে থাকা কতিপয় স্বার্থান্ধ মানুষের নীরবতা ও একপক্ষীয় সরবতা হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু, বুড়ো এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা অনাগত মানবজীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে নানা বলয়ে বিভক্ত। সব কিছুর মূলে রয়েছে অর্থ ও বাণিজ্য। কখনো কখনো একচেটিয়া নিরাপদ বাণিজ্যের স্বার্থে ঐতিহাসিক রীতি ও নীতি থেকে দূরে সরে যায়। পরিবর্তন হয়ে যায় শত্রু-মিত্র। পশ্চিমা পরাশক্তির শ্যেনদৃষ্টি পড়লে সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতিও পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেকোনো শাসকের ওপর মহাপ্রলয় নেমে আসার জন্য যথেষ্ট। আর যদি নিজ পক্ষীয় মিত্র হয় সেক্ষেত্রে সাতখুন মাফ। 

বর্তমান বিশ্বে একক দেশ হিসেবে করলে অন্যতম শীর্ষ পরাশক্তির তালিকায় শুরুতেই থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের নাম। এদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরীক্ষিত ও উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ঐতিহাসিক এবং যৌক্তিক ও নৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে দেশটির মৌলিক নীতিমালা প্রস্তুত ও কার্যকর হয়ে থাকে। কিন্তু তথাপিও মার্কিনিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে অরাজকতা তৈরি, যুদ্ধাবস্থা টেনে আনা, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করাসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি মার্কিন নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই রুষ্ট থাকে। অন্যদিকে স্বমতের নেতাদের বিপক্ষেও তারা সরব হয় যখন সেখানে মানবিক ও নৈতিক কারণ থাকে এবং ওই শাসক তাদের আজ্ঞাবহ না হয়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী তারা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলে বেড়ালেও যেসব শাসক তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে লেজুরবৃত্তি করে তাদের ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসন চুপ থাকার নীতি অবলম্বন করে।

এখানে বাণিজ্যিক অঙ্কটাই প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা শক্তির ভূমিকার কতটা যৌক্তিক, কোথায় কতটুকু প্রয়োজন-নিষ্প্রয়োজন সেসব বিষয়ে ভিন্ন আলাপে আরো স্ববিস্তারে আলোচনা করা যেতে পারে। আজকের আলোচনায় সম্প্রতি চীনা প্রেসিডেন্টের সফর ও ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে আশা ও শঙ্কার কথা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে চীন-রাশিয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারেও সংক্ষেপে আলোকপাত করা সংঘত মনে করছি। পশ্চিমাদের আচরণ ও চরিত্রে মানুষ, মানবতা, মানুষের অধিকারের বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। মানবাধিকার নিয়ে উচ্চকন্ঠ থাকলেও কোথায় যেন একটা ঘাটতি সব সময় লক্ষ্য করা যায়। অতি সম্প্রতি ফিলিস্তিন সংকটে বিষয়টা জোরালোভাবে স্পষ্ট হয়েছে। স্পষ্টতই ইসরালে এসে পশ্চিমাদের মানবতা হোঁচট খায়। এমনকি তাদের অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বারবার মারাত্মকভাবে আহত হয় মধ্যপ্রাচ্যে এসে। পুরো আমেরিকা ও ইউরোপের চরিত্র অনেকটা একইরকম। এরা সারা পৃথিবীজুড়ে অস্ত্র বাণিজ্য, অন্যান্য অর্থ বাণিজ্য ও ভৌগোলিক রাজনীতিতে প্রভাব ধরে রাখতে চায়। এক্ষেত্রে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মৌলিকভাবে সংঘাতে জড়াতে চায় বলে মনে হয় না। কিন্তু স্বার্থের দ্বন্ধে আঘাত আসলে তারা চুপ থাকে না।

নৈতিকভাবে সিদ্ধ হোক কিংবা অশুদ্ধ হোক, বৈধতার মোড়কে কিংবা মুখোশের আড়ালে কূটনৈতিক রাজনীতিতে তারা স্বার্থোদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্ট করে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের দেশ। এরা মৌলিকভাবে বহিঃরাষ্ট্রের ব্যাপারে, তাদের শাসন পদ্ধতির ব্যাপারে, ভালো-মন্দের ব্যাপারে, তৃতীয় দেশের নাগরিকদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। তারা শুধু বাণিজ্যিক দিকটা ঠিক থাকলে যেকারো সাথে সম্পর্ক রাখতে এবং জোরদার করতে বদ্ধ পরিকর। সেই সঙ্গে এরা নিজের দেশে জনগণের প্রতি অত্যন্ত কঠোর এবং নিজস্ব সীমানার চারপাশে সর্বোচ্চ প্রভাব প্রতিষ্ঠায় প্রবল বিধ্বংসী এবং সমস্ত প্রকার নীতি-নৈতিকতার উর্ধ্বে। এদের কাছে নিজ সীমানা বিস্তার ও ক্ষমতা ধরে রাখতে স্বয়ং শাসকের পর এমনকি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির জন্যও অধিকার বলতে কিছু থাকতে নেই। এদের সামনে কারোরই কথা বলার কোনো অধিকার থাকে না। গত কয়েকমাসে চীনে একাধিক মন্ত্রী দায়িত্বপালনকালে হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যান। রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। যাদের অনেকেই আর কখনোই জনসম্মুখে আসার সৌভাগ্য লাভ করেন না। এছাড়াও শক্তির পরীক্ষায় ভূমি দখলের যুগ পার করে এই আধুনিক সময়ে এসেও দেশ দুটি এখনো সেই আদীম চিন্তা চেতনা লালন করে। পশ্চিমারা কারো ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোথাও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা করলে সেটার ওপর একটা বৈধতার মোড়ক লাগানোর চেষ্টা করে। অথচ ও চীন-রাশিয়ায় সেসবের বালাই নেই। কোনো রাখঢাক ছাড়াই এই দুই দেশের কর্তারা যেকোনো সময় যা তা করতে পারেন। 

মাত্রা বিশেষে এরকম শাসক পৃথিবীতে নিশ্চয়ই আরো অনেক আছে। তবে এতটাও বেপরোয়া জবাবদিহিহীন শাসক এই মহাবিশ্বে আর কেউ অন্তত নেই। অনেকে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কথা বলতে পারেন। আলোচ্য নিবন্ধে তাকে রাখতে পারছি না বলে দুঃখিত। কেননা পিয়ংইয়ং নেতাকে সভ্য পৃথিবীর অংশই মনে করতে পারছি না আপাতত। এত কিছু বলার কারণ হলো বিশেষত চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও তার দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতি পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ফিলিস্তিন সংকটের যোগসূত্র পরীক্ষা করা। ইউক্রেনে যেমনিভাবে রাশিয়ার হামলাকে কোনোভাবেই যুক্তির নিরিখে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না তেমনিভাবে ফিলিস্তিনে ইসরালের আধিপত্য ও নৃশংসতাকে কোনোভাবেই বৈধতা দেয়ার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রতিযোগীতায় পশ্চিমা শক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন দেয়া রাশিয়ার পক্ষে অনুমিতই ছিলো। আপাতত এই সমর্থন প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই, যতক্ষণ না ইউক্রেন ও পশ্চিমারা প্রবলভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। 

কিন্তু আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে চীন-মার্কিনি বরফ গলতে শুরু করায়। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর মধ্যকার বৈঠক নিয়ে দুই পক্ষই ব্যাপক আশাবাদী। বিশেষত মার্কিন প্রশাসন দুই নেতার বৈঠকের আগে যা কল্পনা করেনি তার থেকেও বেশি কিছু অর্জন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মিস্টার বাইডেন আলোচিত এই বৈঠককে দুই নেতার সবচেয়ে সৌহার্দপূর্ণ ও ফলপ্রসূ বৈঠক আখ্যা দিয়েছেন। গত এক দশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক নানান কারণে দুই দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। বৈশ্বিক কোনো সম্মেলনে দুই নেতার একসঙ্গে উপস্থিতিও রীতিমতো সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে উঠেছিলো সাম্প্রতিক সময়ে। এমনকি কখনো কখনো উপস্থিতি নিশ্চিত হলেও মুখোমুখি হওয়ার কল্পনা করা ছিলো দুঃসাধ্য। অতিসম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে পর্যন্ত হাজির হননি শি জিনপিং। এই পরিস্থিতিতে ক্রমগতভাবে বৈরিতার দিকেই ধাবিত হয় চীনা কর্তৃপক্ষ।

বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে দারুণ কূটনৈতিক সাফল্যের সাক্ষর রাখতে সক্ষম হন শি। রীতিমতো ম্যাজিক দেখিয়ে ইরান-সৌদি আরবের তীব্র ফাটলযুক্ত সম্পর্কে জোরা লাগাতে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। অন্যদিকে একই প্রান্তিক অবস্থায় থাকা সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক তৈরিতে পশ্চিমাদের গলদঘর্ম অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অবস্থান জোরালো হওয়া তীব্রভাবে পশ্চিমাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবকে চুক্তিতে পৌঁছাতে মরিয়া হয়ে ওঠে বাইডেন প্রশাসন। ঠিক সেই মুহূর্তে সমস্ত হিসাব-নিকাষ পাল্টে দেয় ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের শাসক দল হামাস। চীন এক্ষেত্রে শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। এমনকি পারস্য উপসাগরে সামরিক উপস্থিতিও নিশ্চিত করে চীন। এমন অবস্থায় পশ্চিমারাও নিজেদের সংযত করতে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু ততক্ষণে ইসরায়েলের পাগলা ঘোড়া নেতানিয়াহু নাগালের বাইরে চলে যায়। মানবতার চরম শত্রু নেতানিয়াহু এখন আর কারো কোনো আহ্বান, অনুরোধ, আইন, মূল্যবোধ্যের তোয়াক্কা করতে রাজী নন। 

এমন অবস্থায় মানবতা বিধ্বংসী আগ্রাসনের বিপক্ষে প্রয়োজন ছিলো কারো না কারো শক্ত অবস্থান। স্বার্থের সংঘাতে আরবলীগ ও মুসলিম বিশ্বের প্রতি প্রত্যাশা সাম্প্রতিক ভূরাজনীতি কিছুটা আশার আলো তৈরি করেছিলো। যেভাবেই হোক ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আরবরা অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। এটা সম্ভব হয়েছে ইরানের সাথে সৌদি আরবের শান্তি স্থাপনের কারণেই। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদকে সৌদি আরবে অন্যান্য আরব নেতাদের সঙ্গে এক টেবিলে আমন্ত্রণ আরবদের ঐক্যবদ্ধতার বার্তা আরো বেশি জোরালো করে। এর ফলাফলও ইচিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা এখনো জিইয়ে রাখতে পেরেছে ফিলিস্তিন ইস্যুতে। সৌদি আরব এর আগে কখনোই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও ইসরায়েলের বর্বরতার বিপক্ষে এতটা কঠোর ও সরব ছিলো না। 

এছাড়া মুসলিম বিশ্বের অন্যতম উচ্চকন্ঠ তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ভূমিকাও শুরু থেকেই অন্য যে কারো তুলনায় ফিলিস্তিনের নির্যাতিত, নিজভূমে পরাভূত মানুষদের পক্ষে। কিন্তু এত কিছুর পরও কিছু তো ফাঁক রয়ে গেছে এখনো। দফায় দফায় আরব লীগের বৈঠকে কার্যকর উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারায় ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান আরব লীগ ও মুসলিম বিশ্বের নেতাদের যৌথভাবে আমন্ত্রণ করেন রিয়াদে। দুর্ভাগ্যবশত বাহরাইন, সংযুক্ত আরব ও মরক্কোর কারণে ইসরায়েলের বিপক্ষে এবারও শক্ত কোনো পদক্ষেপ ঘোষণা করতে পারেনি মুসলিম নেতারা। অন্যদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ বৈশ্বিকভাবেই হুমকি স্বরুপ। এই দুই শক্তিধর দেশের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক যেকোনো সময়ের জন্যই ভয়ের, আশঙ্কার। গত এক দশকে অবস্থার চূড়ান্ত অবনতির এই পর্যায়ে উভয়ের সম্পর্কের ‘বরফ গলা’ পুরোপুরি বা সহনীয় পর্যায়ে থামলেও তা বিশ্ববাসীর জন্য ভালো। কিন্তু ভয় হচ্ছে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে। চীন মূলত প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত। সাগরের বুকে চীনের গা ঘেঁষে বিষফোঁড়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়ে আাছে স্বশাসিত তাইওয়ান। চীনের সমুদ্র উপকূল থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরত্বের আংশিক স্বীকৃত ছোট্ট একটি ভূখণ্ড তাইওয়ান। ইউক্রেনের রাশিয়ার অযৌক্তিক দাবির দূরবর্তী ভিত্তি থাকলেও তাইওয়ানকে চীনের অংশ মনে করার পেছনে চীনাদের ঐতিহাসিক শক্তিশালী যুক্তি নেই। তথাপিও বিশ্বব্যাপী সেমি কন্ডাক্টর চিপস উৎপাদনে অর্ধেক বাজার দখলে রাখা মাত্র ৩৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই চীনের উদ্বেগ বেশি। কেননা মৌলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এক চীন নীতিতে এখনো পর্যন্ত অটল থাকলেও তাইওয়ানে চীনের হস্তক্ষেপ সমর্থন করে না। গোপনে তাইওয়ানকে অস্ত্র থেকে শুরু করে নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে। তাইওয়ান নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের তিক্ততা শুরু হয়েছিলো গত বছরের আগস্টে। ওই সময় চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক যোগাযোগ সংক্রান্ত একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়ার প্রস্তুতি চলছিলো। কিন্তু আকস্মিকভাবে তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফর ও প্যারাগুয়ে সফরকালে তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট লাই এর দুই দফা যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা বিরতিকে চীন ভালোভাবে নেয়নি। দুইটি ঘটনাকেই চীন উসকানিমূলক এবং আখ্যা দিয়ে দফায় দফায় দক্ষিণ চীন সাগরে তাইওয়ান প্রণালিতে সামরিক মহড়া দিয়ে উত্তেজনা তৈরি করে। সেই অবস্থা থেকে ‘বাইডেন-শি’র আলোচিত বৈঠকে পুনরায় সামরিক যোগাযোগ চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে দুই নেতা একমত হয়েছেন। যেকোনো সংকটকালে পারস্পরিক ফোনালাপের ব্যাপারেও সম্মত হয়েছেন তারা। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত মাদক জাতীয় রাসায়নিক ‘ফেন্টানাইল’ উৎপাদনরোধে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়াও বৈঠকে ইরানের ব্যাপারে জিনপিংকে শঙ্কার কথা জানিয়ে ভূমিকা রাখার আহ্বান করেছেন বাইডেন।

বলা বাহুল্য ফিলিস্তিনের পক্ষে আরব বিশ্ব সিদ্ধান্তে আসুক বা না আসুক যদিও কেউ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায় সেটা হবে সবার আগে ইরান। এই কারণে ইরানকে নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের মাথা ব্যাথার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জিনপিংও আশ্বাস দিয়েছেন। বিনিময়ে চীনকে দমন ও ঠেকানোর পরিকল্পনা না করতে বাইডেনকে অনুরোধ জানিয়েছেন শি। শঙ্কার জায়গা হলো তাইওয়ান প্রশ্নে যদি আমেরিকা চুপসে যায় তবে কি ফিলিস্তিন প্রশ্নে চীন থেমে যাবে? এই প্রশ্ন বা আশঙ্কার কারণ রয়েছে।

বাইডেন যেকোনো স্বৈরশাসকের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়চেতা এবং অকপট ঘাউড়া একজন মানুষ। ইতিহাসের সবচেয়ে সৌহার্দপূর্ণ ও ফলপ্রসূ বৈঠক করেও সংবাদ সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্টনে সামনা-সামনি স্বৈরশাসক বলতে দ্বিধা করেননি। এটা একদিক থেকে সাহসী ব্যক্তিত্বের পরিচয় অন্যদিক থেকে ত্যাড়ামির পরিচয়। যেমনটা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। যা বলেছি তো বলেছি! এ কারণে আশঙ্কা হয় চীনকে নিবৃত করা গেলে ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাইডেন আরও বেশি নেতানিয়াহুর দিকে ঝুঁকে পড়বেন কি না।

আদতে চীন হলো দখলদারী স্বৈর শক্তি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। নেই কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে চীনের শক্ত অবস্থান মানবিক কিংবা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নয়। বরং পশ্চিমাদের বিরোধীতার কারণে। এই কারণে শঙ্কা জাগে, পশ্চিমাদের সাথে বিরোধীতা কমে আসলে এবং তাইওয়ান নিয়ে শঙ্কামুক্ত হলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নিয়ে চীনা প্রশাসন কথা বলবে কি না সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণেই চলমান ফিলিস্তিন সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে আশান্বিত হওয়ার মতো কারণও রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে চীন যে অবস্থান তৈরি করতেছে তা হয়ত হারাতে চাইবে না। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বরফ গলা সম্পর্ক এখনো পরীক্ষার পর্যায়ে। বিশ্বস্ততার পর্যায়ে পৌঁছতে নিঃসন্দেহে সময় লাগার কথা। এছাড়া প্রাকৃতিক মূল্যবান খনিজ সম্পদে ভরপুর আফগানিস্তানে ইতোমধ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু করেছে চীন। সেখানে তারা চাইবে না তালেবান সরকারের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে। কেননা তালেবান সরকার বিনা প্রশ্নে ফিলিস্তিন মুক্তির পক্ষে। হামাসকে তারা সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত। অন্যদিকে আরব ও মুসলিম বিশ্ব যদি বাধা বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে পারে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভবনা এখনো রয়েছে। আমরা আশাবাদী হতে চাই। পৃথিবীর পরাশক্তিধর দেশগুলো নেতাদের সুমতি হোক। বিশেষ কোথাও গিয়ে তাদের মানবতাবোধ ও নৈতিকতার যেন মৃত্যু না ঘটে। জেগে উঠুক বিশ্ব মানবতা। বাঁচুক গাজাবাসী। অধিকার ফিরে পাক ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী বৈধ ভূমি মালিকরা।

(ঢাকাটাইমস/১৮ডিসেম্বর/জেডএম)