শৈশবে বাবা হারানো নিয়ামুল কবীরের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প

নিয়ামুল কবীর উৎস। ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত (১৯৭তম) হয়েছেন। মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) প্রকাশিত হয় এ ফল। উৎসের বাড়ি টাঙ্গাইল সদরে। পড়াশোনা করেছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (মাভাবিপ্রবি)।
নিয়ামুল কবীর উৎসের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ গল্প। তার সফলতার গল্প ও পরামর্শ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন ঢাকা টাইমসের মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি সুজন চন্দ্র দাস।
নিয়ামুল কবীর উৎস ২ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর চাকরিজীবী মায়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এবং অনেক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তিনি সাফল্য অর্জন করেন।
তুখোড় মেধাবী এ শিক্ষার্থী টাঙ্গাইল জেলার সদরের আকুর টাকুর পাড়ার বটতলার বাসিন্দা। পিতা হুমায়ুন কবীর (মৃত) ও মাতা সামছুন নাহার (চাকরিজীবী)- দম্পতির একমাত্র সন্তান ।
শৈশবে বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনার গল্প তুলে ধরে উৎস বলেন, ছোট বেলা থেকেই টাঙ্গাইলে মানুষ হয়েছি। আম্মু চাকরি করায় দাদির কাছেই থাকতাম বেশি সময়। পড়াশোনার সাফল্যের ক্ষেত্রে এসএসসি এবং এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ ছিল এবং বাড়ির পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। তাতে আমি অনেক খুশি হই। বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে পারবো এবং পরিবারকেও সময় দিতে পারবো। ভার্সিটিতে ৩.৫৫ সিজিপিএ পাই। এছাড়া স্কুল লেভেল বৃত্তি পেয়েছি।
বিসিএসে সাফল্যের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি এবং কার অনুপ্রেরণায় বিসিএসে আসা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিসিএসের চলার গল্পের শুরু ২০২০ সালে করোনাতে। বড় মামা আমাকে অনেক আগে থেকেই বিসিএসের প্রতি অনুপ্রাণিত করতেন। কিন্তু আমার মনে সুপ্ত ইচ্ছা থাকলেও ওভাবে চেষ্টা করার ইচ্ছা ছিল না। বরং দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার প্রতি ঝোঁক বেশি ছিল। আমি যখন ২ বছর বয়সি শিশু তখন আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন এবং আমার মা আমাকে অনেক কষ্ট করে এই পর্যন্ত নিয়ে আসছেন তাই মাকে ছেড়েও দূরে থাকার সাহস হতো না। পরবর্তী সময়ে এলাকার বড় ভাই সানির পরামর্শ ও সহযোগিতায় ওই সময়টাতেই আমি সিদ্ধান্ত নেই বিসিএস দেওয়ার। আমি টাঙ্গাইল থেকে প্রিপারেশন নেওয়ায় ওরাকল টাঙ্গাইলে ভর্তি হয়েছিলাম এবং সেখানেই প্রস্তুতি চলতে থাকে। তারা আমাকে যেভাবে সাপোর্ট করেছে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এর পাশাপাশি একরামুল ভাই (৪৩ বিসিএস ক্যাডার) ও শৈশব ভাইয়ের পরামর্শে লাইভ এমসিকিউতেও পরীক্ষা দিতাম। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর থেকেই লিখিত পরীক্ষার প্রিপারেশনে জোর দেই। বন্ধু নিষাদ (৪১ প্রশাসন ক্যাডার) এসময় পেপার বেজড পড়াশোনার প্রতি জোর দেয়ার পাশাপাশি নানা দিক নির্দেশনা দেয় এবং একটা পর্যায়ে আমি পড়াগুলো এনজয় করতে শুরু করি। পাশাপাশি উত্তরণে ও পরীক্ষা দিয়ে যাচাই করতাম নিজেকে। এভাবেই ৪৩ রিটেন, ৪৪ প্রিলি এবং ৪৪ রিটেন শেষ করি, পাশাপাশি বিবি এডিসহ আরও কয়েকটা চাকরির রিটেন ও ভাইভা ও দিয়েছিলাম।২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ভাইভা দিই। ভাইভার সময় ছিল প্রায় ৩০ মিনিট। কাজেই কিছুটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে ভালো কিছু হবে। অবশেষে মঙ্গলবার রেজাল্ট প্রকাশের পর থেকেই আমি অনেক আবেগাপ্লুত। আমার মাসহ পরিবারের সবাই, কাছের মানু্ষজনসহ বন্ধুবান্ধবরা সবাই অনেক খুশি। আমার মামারা সবসময়ই আমার পাশে ছিল। তাদের আশা পূরণ করতে পারাটা আমার কাছে আশীর্বাদ।
সফলতার এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পথে কষ্টের কোনো স্মৃতি আছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে উৎস জানান, আসলে ছোট বেলা থেকেই আব্বু ছিল না। স্কুল-কলেজে যখন বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতো, বাবা মারা গেছে বা নাই এই কথাগুলো বলা অনেক কষ্ট ছিল। অনেকে অনেক কটু কথা বলতো প্রিপারেশনের সময় বা খুব কাছের বন্ধুরা আমাকে দিয়ে হবে না। এসব কথা সহ্য করা আমার জন্য ছিল খুব কষ্টকর। আমার প্রতি তাদের ব্যবহারেও অনেকটা অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনোযোগ ধরে রেখেছি এবং চেষ্টা করেছি।
স্মৃতি বলতে প্রথম দিকে আমার একাডেমিক রেজাল্ট তেমন ভালো ছিল না। একটি কোর্সে অকৃতকার্য হওয়ার পর স্যারকে বলেছিলাম নেক্সট কোর্সে আমি হায়েস্ট পাবো এবং সত্যিই পেয়েছিলাম। এরপর থেকেই আমার কনফিডেন্স লেবেল হাই হয়ে গেল। একাডেমিক্যালি আমি লাস্ট চার সেমিস্টারে অনেক ভালো করেছিলাম। তাই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার এই বিষয়গুলো আমি উপভোগ করি।
অবসরে কী করেন জানতে চাইলে তিনি বলেনে, অবসর সময়ে খেলাধুলা করার চেষ্টা করি। বিশেষ করে ফুটবল। ভালো মুভি, সিরিজ দেখার চেষ্টা করি। বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি ক্লাব এক্টিভিটিতে জড়িত ছিলাম। ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। আগে অনেক ঘুরাঘুরি করলেও মাঝে তা বন্ধ ছিল। এখন আবার ঘুরে বেড়াতে চাই।
কত ঘণ্টা পড়া করলেন এবং কীভাবে? জবাবে তিনি বলেন, আসলে আমি প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা পড়ার চেষ্টা করতাম। যেকোনো কিছুই অনেক ডিটেইল পড়ার চেষ্টা করতাম। খাওয়া দাওয়া ঘুম নামাজের বাইরে খুব কম সময় নষ্ট করতাম। কোনো বিশেষ পরীক্ষার আগে হয়তো বেশি পড়া হতো। এখানে সময়ের থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদিন নিয়ম করে পড়াশোনা করা। ২০২২ সালে ডিসেম্বরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে (ওয়ান ব্যাংক পিএলসি) স্পেশাল ক্যাডার অফিসার (এমটিও) হিসেবে জয়েন করি এবং চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাই। আমার মনে হয় আমার জন্যে সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল এই সময়টা। প্রতিদিন অফিস শেষে সাড়ে ৭টায় যেয়ে পড়তে বসতাম এবং রাত ২টা পর্যন্ত পড়তাম। পরেরদিন আবার সকালে অফিস, এভাবে কষ্টের মধ্য দিয়ে পড়াশোনা চলতো।
বিসিএসে সফল হতে নতুনদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী? জবাব তিনি জানান, ২০২১ সালের ২৫ মার্চ, আমার তারিখটা মনে আছে। ওদিন রাত থেকে আমি প্রিপারেশন শুরু করি এবং সকল সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে ছিলাম প্রায় ২ বছর। এ সময় বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল। নতুনদের বলবো পরিশ্রম করার মানসিকতা আর ধৈর্য থাকলে অবশ্যই বিসিএসে আসা উচিত এবং একটা সলিড প্রিপারেশন নেওয়া উচিত। বড় কিছুর জন্য লক্ষ্য রাখা এবং সেই অনুযায়ী পরিশ্রম করা। শুধু একটা চাকরি হলেই হলো এ ধরনের মানসিকতা থাকা উচিত না।
(ঢাকাটাইমস/২৭ডিসেম্বর/এআর)

মন্তব্য করুন