মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয় গ্রিন টি

প্রকাশ | ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:০৭ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:১১

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

স্বাস্থ্য সুরক্ষ‍া এবং স্বাদের ভিন্নতার জন্য মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে গ্রিন টি। গ্রিন টি তৈরি করা হয় যে চা গাছের পাতা বা কুঁড়ি থেকে তার বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। আমরা সাধারণত যে চা পান করে থাকি সেই ব্ল্যাক টি কিংবা ওলং টি থেকে গ্রিন টি-র প্রস্তুতপ্রণালী কিছুটা ভিন্ন। গ্রিন টি-কে উইদারিং বা অক্সিডেশন (উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়ানো) হয় না।

গ্রিন টি সর্বপ্রথম চীনে আবিষ্কৃত হয় এবং ধীরে ধীরে এশিয়ার অন্যান্য দেশের এটি ছড়িয়ে পরে। গ্রিন টি একটি পুষ্টিকর এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত পানীয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি আশ্চর্যজনক ভাবে দ্রুত কাজ করতে পারে। গ্রিন টি খাদ্যনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ভালো কোষগুলোর কোনো ক্ষতি না করে সার্বিকভাবে ক্যান্সারের কোষ নির্মূল করে। গ্রীন টিতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন সি এর চাইতে ১০০ গুন ও ভিটামিন ই এর চাইতে ২৪ গুন ভালো। গ্রীন টি বিশেষ ভাবে ত্বকের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সারের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।

গ্রিন টি-তে সেই সমস্ত পুষ্টি রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটিতে প্রধানত ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, ভিটামিন বি ৫, ভিটামিন কে, রিবোফ্লাভিন, থায়ামিন, ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম, কপার, আয়রন, অক্সিডেন্ট, পলিফেনলের মতো উপাদান রয়েছে। যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রিন টি-তে ‘এল-থিয়েনিন’ নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড রয়েছে। যা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ও দুশ্চিন্তা কমাতে অত্যন্ত উপযোগী। গবেষণা বলছে, গ্রিন টি-তে এক দিকে ‘করটিসোল’ হরমোন ক্ষরণ কমে মানসিক চাপ কমায়, অন্য দিকে বাড়ে ‘ডোপামিন’ ক্ষরণ। এটি মন ভাল রাখতে সহায়তা করে।

গ্রিন-টি মূলত তৈরি করা হয় ফার্মেনটেশন ছাড়া যাতে এর সবুজ রং অক্ষুণ্ণ থাকে। প্রথমে চা পাতাকে আংশিক শুকানো হয়, তারপর বাষ্পায়িত করা হয়, এরপর শুকিয়ে নেওয়া হয় এবং সবশেষে তাপ দিয়ে গ্রিন-টি তৈরি করা হয়।

গ্রিন টি কীভাবে খাওয়া উচিত, এতে কী কী উপকার তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই। অতিরিক্ত গ্রিন টি যেমন পান করা ঠিক না, তেমনই আবার খালি পেটে ঘুম থেকে উঠেই গ্রিন টি, কিংবা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে গ্রিন টি পান করাও মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।

আমেরিকান জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি গবেষণায় জানা যায়, অন্যান্য চায়ের মতো গ্রিন টি আমাদের শরীরে জারিত হয় না। তাই এই চা অন্য চায়ের তুলনায় স্বাস্থ্যকর। অনেক রকম ফ্লেভার তো বটেই, বাজারে ভেষজ গ্রিন টি-ও পাওয়া যায়। গ্রিন টি শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইড জমতে দেয় না। রক্তনালিতে এই সব ফ্যাট জমলে রক্ত সঞ্চালন বাধা পায়।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গ্রিন-টির ভূমিকা অপরিসীম।গ্রিন-টি তে মূলত রয়েছে ফ্লাভোনোয়েড জাতীয় উপাদান যেমন-ক্যাফেইন, থিয়োফাইলিন, থিয়ানিন, ক্যাটেকিন, থিয়ারুবিজিন, ইসেনসিয়াল অয়েল এবং ফেনল জাতীয় যৌগ।

এছাড়াও এতে রয়েছে দ্রবণীয় উপাদান যেমন-অ্যামাইনো অ্যাসিড, ফ্লুরাইড, ভিটামিন বি১,বি২, ন্যাচারাল সুগার, পেকটিন, স্যাপোনিন এবং ভিটামিন সি।

অন্যদিকে অদ্রবণীয় উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক্লোরোফিল, ক্যারোটিন, সেলুলোজ এবং ভিটামিন-ই।এই উপাদানগুলো মূলত পাতায় থাকে।এছাড়াও এতে পানির পরিমাণ শতকরা ৭৫-৮০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মেটাবলিজম বাড়িয়ে ফ্যাট বার্নে সহায়তা করে গ্রিন টি, যা ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গ্রিন টি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। কিডনি রোগের জন্য গ্রিন টি বিশেষভাবে উপকারী। রক্তে কোলেস্টোরেলের মাত্রা কমাতে গ্রিন টি একটি যাদুকরী পানীয়।

গ্রিন টির মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, বি, বি৫, ডি, ই, সি, ই, এইচ সেলেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, জিংক, ক্যাফেইন ও মেঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান৷ যা শরীরের ওজন ঝরাতে বেশ কার্যকর।

যারা মেদ ঝরাতে চান, তারা গ্রিন টিতেই ভরসা রাখেন। নিয়ম মেনে গ্রিন টি খেলে ক্যানসার, অ্যালজাইমার্স, স্ট্রোক ও ডায়াবিটিসের ঝুঁকি কমে। এমনকি, ত্বকে বয়সের ছাপ ঠেকিয়ে রাখতেও গ্রিন টি-র জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু ঠিক মতো উপকার পেতে কতটা গ্রিন টি খাওয়া জরুরি, জানেন কি? কেউ দিনে দু’ কাপ খান, কেউ কেউ আবার বেশি উপকার পেতে পাঁচ-ছ’কাপ এই চা খেয়ে ফেলেন। না জেনে বুঝেই কম বা বেশি খেয়ে ফেলছেন না তো? কিংবা দিনের এমন সময়ে খাচ্ছেন, যে সময়ে খাওয়াটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়।

গবেষণায় জানা গিয়েছে, গ্রিন টি-র সব গুণ যদি পেতে চান তাহলে বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে। সকলেরই ধারণা গ্রিন টি খেলেই অতিরিক্ত মেদ ঝরবে তাড়াতাড়ি। তাই যখন তখন গ্রিন টি খাওয়া চলে। গ্রিন টি সাধারণত প্রতিদিন ২ থেকে ৫ কাপের মধ্যে খাওয়া চলে। তবে এই বিশেষ চা খাওয়ারও রয়েছে কিছু নির্দেশিকা। গ্রিন টি পান করার সময় কী কী একেবারেই করবেন না, তা জেনে নিন আগে...

গ্রিন টি খাওয়ার সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা হল খাওয়ার ঠিক পরে এই ভেষজ চা খেলে শরীরের ক্যালোরি বার্ন হয় দ্রুত। খাবারের প্রোটিনগুলো খাওয়ার পরই তা হজম হয় না। সময় লাগে। খাবার খাওয়ার ঠিক পরেই যদি গ্রিন টি খাওয়া হয় তাহলে তা উল্টে ক্ষতি হতে পারে।

খালি পেটে গ্রিন টি খাবেন না। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রিন টি খেতে হলে দুটি ভারী খাবারের মাঝখানের বিরতিতেই খাওয়া উচিত। সবচেয়ে বেশি উপকার পেতে হলে কোনও ভারী খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে কিংবা ২ ঘণ্টা পরে গ্রিন টি খেতে পারেন। এই চায়ে ক্যাফিন ও ক্যাটেচিন ভাল মাত্রায় থাকে, এই যৌগগুলি বিপাকহার বাড়াতে সাহায্য করে। তাই ওজন ঝরানোর জন্য গ্রিন টি খেতে হলে খাবারের মাঝে খাওয়াই শ্রেয়। খালি পেটে খেলে তেমন উপকার পাবেন না।

গ্রিন টি খাওয়ার সময় মাথায় রাখবেন একদম গনগনে গরম পানি নয়, হালকা গরম পানির গ্রিন টি পান করার চেষ্টা করুন। পানি যত বেশি গরম হবে, স্বাদও তত কমতে থাকবে। এছাড়া পেট ও গলায় ব্যথাও হতে পারে।

আবার গ্রিন টি-র সঙ্গে মধু যোগ করে খান অনেকেই। চিনির বিকল্প হিসেবে স্বাদ যোগ করতে অনেকেই এই কাজ করেন। ফুটন্ত পানিতে গ্রিন টি ও মধু যোগ করলে তার পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। পানির অতিরিক্ত তাপ কমতে দিন, তারপর দারুচিনি, মধু যোগ করতে পারেন।

দ্রুত রোগা হওয়ার চক্করে দিনে ১০ থেকে ১২ বার গ্রিন টি খাওয়া স্বাস্থ্যকর বলে মনে করলে ভুল করছেন। কোনও কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়। চা বা কফির মতোই গ্রিন টিতেও রয়েছে ক্যাফেইন। দিনে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করলে মাথাব্যথা, ক্লান্তিভাব, উদ্বেগ, বিরক্তিভাবের মতো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। দিনে ২-৩বার গ্রিন টি পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

ফুটন্ত পানির মধ্য়ে বহুক্ষণ ধরে গ্রিন টি-র পাতা ফোটানো অধিকাংশেরই অভ্যাস। যতক্ষণ না রঙ গাঢ় হচ্ছে, ততক্ষণ ফুটিয়ে যান। প্রাকৃতিকভাবে স্বাদযুক্ত করতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চা বানিয়ে পান করতে পারেন।

গ্রিন টি পান করার সময় একেবারেই তাড়াহুড়ো করবেন না। অফিসের জন্য বের হওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করে চা পান করলে আজ থেকেই তা বন্ধ করুন। বিশ্রামের সময় চা পান করার গ্রিন টি খাওয়ার সর্বোত্তম উপায়।

একসঙ্গে ২টি গ্রিন টি ব্যাগ যোগ করবেন না। এমন অভ্যাস থাকলে আজ থেকেই সতর্ক থাকুন। অনেকেই মনে করেন, একসঙ্গে ২টি ব্যাগ ভিজিয়ে চা খেলে বেশি মাত্রায় ক্যালোরি বার্ন হবে। ওজন ঝরবে তড়তরিয়ে! প্রতিদিন ২টি করে গ্রিন টি ব্যাগ যোগ করলে হজমের সমস্যা ও অ্যাসিডিটি হতে পারে।

 

সঠিক গ্রিন টি যেভাবে বেছে নিবেন

অর্গানিক গ্রিন টি বেছে নিলে কীটনাশকের বা কোনও ক্ষতিকারক রাসায়নিকের প্রভাবমুক্ত থাকা যাবে। সতেজ গ্রিন টি কিন্তু হালকা সবুজ রঙেই হবে। টি ব্যাগ এড়িয়ে চলাই ভাল। পাতার আকার হবে বড়। মার্চ-এপ্রিল মূলত এই গ্রিন-টি চাষ করা হয়, তাই পুষ্টিগুণও সেই সময় সবচেয়ে বেশি মেলে। ৬ মাসের বেশি গ্রিন টি রাখা যায় না কোনওমতেই। গ্রিন টি-তে কখনওই চা মিশিয়ে খাবেন না। গ্রিন টি-র প্যাকেটে এপিগ্যালোক্যাটেচিন (ইজিসিজি) আছে কি না দেখতে হবে, ভাল রকমের ইজিসিজি মানে সেটাই কেনা ভাল। গ্রিন টির গন্ধ হবে হালকা, সতেজ, কচি ঘাসের মতো। গ্রিন টি রাখতে হবে কাচ বা পোর্সেলিনের বদ্ধ পাত্রে। খাওয়ার বিষয়ে কী কী খেয়াল রাখতে হবে। গ্রিন টি-তে দুধ মেশানো ঠিক নয়। ওয়ার্ক আউটের আগে বা পরে গ্রিন টি খাওয়া যায়। স্ন্যাক্স খাওয়ার ইচ্ছা দমন করতে হলেও এক কাপ গ্রিন টি যথেষ্ট।

 

সঠিক গ্রিন টি বানানোর পদ্ধতি

৫ গ্রাম বা এক চা চামচ গ্রিন টি নিতে হবে। জল গরম করে ফুটে গেলে (৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জল থাকলে ভাল।) তারপর তা সামান্য ঠান্ডা হলে স্টিল বা কাচের পাত্রে রাখতে হবে। তার পর এতে চা পাতা যোগ করে ৩ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। চা পাতা পুরোপুরি ভিজে গেলে পছন্দের কাপে চা ছেঁকে চুমুক দিন প্রিয় পানীয়তে।

কেউ চাইলে এর মধ্যে দারচিনি গুঁড়ো, এলাচ গুঁড়ো, আমলা গুঁড়ো যোগ করতে পারেন। যোগ করা যায় আদাও। এক চা চামচ আমলার রস, এক চা চামচ লেবুর রস, এক চা চামচ আদার রসে গ্রিন টি পাবে অন্য মাত্রা। তবে দিনে দু থেকে তিনবারই যথেষ্ট। অতিরিক্ত গ্রিন টি পান করা কখনওই ঠিক নয়।

(ঢাকাটাইমস/৩১ জানুয়ারি/আরজেড)