পাঁচ কারণে বাবুবাজার ব্রিজে যানজট লেগেই থাকে

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২৭ | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২৯

হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস

বছরের পর বছর বাবুবাজার ব্রিজে (বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু) যানজট যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধী এই ব্রিজে যানজটে নাকাল হয়ে থাকে চলাচলকারীরা। ব্রিজটিতে চলা সব অনিয়মই যেন নিয়ম। যানজটের সঙ্গে জড়িত নানাবিধ অনিয়ম হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায়।

সরেজমিনে বাবুবাজার ব্রিজ ঘুরে দেখা যায় দীর্ঘদিনের চলমান যানজট হচ্ছে ৫ কারণে। ব্রিজের ওপর অবৈধ স্ট্যান্ড, ব্রিজের নিচে পার্শ্ব রাস্তায় অবৈধ পার্কিং, কদমতলি থেকে ব্রিজের প্রবেশমুখে স্ট্যান্ড, নয়াবাজার থেকে তাঁতিবাজার সড়কের অর্ধেকজুড়ে পিকআপ স্ট্যান্ড, সড়কে খানাখন্দ।

শুধুমাত্র ট্রাফিক ব্যবস্থার দায়িত্ব অবহেলা ও এসব অনিয়মের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন থাকায় এ অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে মাঝেমধ্যেই হয় তাদের লোক দেখানো অভিযান ও ট্রাফিক আইনে মামলা।

২০০১ সালের ২০ মে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাবুবাজার সেতুটি দিয়ে বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল করছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাবুবাজার ব্রিজ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় এক লাখের বেশি পরিবহন চলাচল করছে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী মানুষের অন্যতম রুট এই ব্রিজ।  প্রতিদিনই এই গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজটি পারাপার হতে সময় লেগে যায় ১ ঘণ্টারও বেশি। অতিমাত্রায় যানজট হওয়ায় অনেক সময় রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সকেও যানজটে পড়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের যাত্রীদের জন্যও সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এই সেতুটির ওপরেই বসানো হয়েছে বাস, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত রিকশাভ্যানের অবৈধ স্ট্যান্ড। ব্রিজটির প্রায় অর্ধেকজুড়েই সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে এই স্ট্যান্ড।

সেতুটির উত্তর প্রান্তে নয়াবাজার এলাকায় রয়েছে সিএনজি স্ট্যান্ড। এখানে প্রায় ৮০-১০০টির মতো সিএনজি সবসময় রাখা হয়। তারা ব্রিজের ওপর থেকেই যাত্রী বহন করে নিয়ে যায়। রাজধানীতে ঢাকা মেট্রো থ সিরিয়ালের সিএনজি ছাড়া অন্য জেলা কিংবা সিরিয়ালের সিএনজি চলাচল নিষিদ্ধ। তারপরও দুই ব্রিজে প্রায় ২ হাজার সিএনজি চলাচল করছে। তার মধ্যে অবৈধ ও চোরাই সিএনজিও রয়েছে। ব্রিজটিতে চলাচলকারী সব সিএনজি থেকে নিয়মিত টাকা নেয় পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যরা।

মিটফোর্ড হাসপাতালের পথচারীদের জন্য ব্রিজে উঠতে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। তবে এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠার জায়গাতেই দেখা যায় ব্রিজে চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো, উল্টোপথে আসা সিএনজিচালিত অটোরিকশার লাইন, পথ পারাপারে ভাঙা ডিভাইডারে পথচারীদের হুড়োহুড়ি। ব্রিজের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের সিঁড়িতে রয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যানের স্ট্যান্ড। দুই স্টান্ডে দেড় শতাধিক রিকশা ও ভ্যান পার্কিং করা থাকে। রাস্তার অর্ধেকাংশ জুড়ে থাকে এই স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডের সামনেই প্রতিদিন দায়িত্বে থাকে একটি পুলিশের টহল গাড়ি। এই দুই স্ট্যান্ডের কারণে ব্রিজের মাঝপথে যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও ব্রিজটির মধ্যবর্তী দুই স্থানে মাওয়াগামী বিভিন্ন পরিবহন থামিয়ে যাত্রী নেওয়া হয়। এতে করে পুরো ব্রিজের চলাচল বন্ধ হয়ে থাকে দীর্ঘ সময়। রাতের বেলা সেতুর ওপরে সারিবদ্ধভাবে অবৈধ গাড়ি পার্কিং করেও রাখা থাকে।

বুড়িগঙ্গা নদীর পার থেকে শুরু করে নয়াবাজার পর্যন্ত ব্রিজের নিচে ২৪ ঘণ্টা প্রায় ৫০০ পরিবহন পার্কিং করা থাকে। এসব পরিবহনের জন্য পুরো রাস্তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকে। এতে করে ব্রিজ থেকে পরিবহনগুলো নিচে নামতে অনেক সময় লেগে যায়।

সেতুটির নিচে ভারী যানবাহন পার্কিংয়ের ফলে মূল কাঠামোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উঁচু যানগুলোর ওপরের অংশের ধাক্কায় সেতুর কাঠামোর কংক্রিটের আস্তর খসে পড়ছে। ঘষা লেগে ক্ষতি হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।

ব্রিজের এই পয়েন্টে কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকায় ডিভাইডারের অংশ ভেঙে ফেলেই কদমতলি থেকে আসা অটোরিকশা বাবুবাজারের দিকে চলে আসে রং সাইট দিয়ে।  

কেন এভাবে উল্টোপথে তারা চলাচল করছে এমন প্রশ্নের জবাবে সিএনজিচালক জাহাঙ্গীর ঢাকা টাইমকে বলেন, উল্টোপথ দিয়ে না গেলে ব্রিজের শেষ মাথায় যেখানে ডিভাইডার শেষ, সেখান থেকে ঘুরে আসতে হবে তাদের। তাই সময় বাঁচাতে উল্টোপথ ব্যবহার করছেন।

সিএনজিচালক সুমন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাগো সিএনজিগুলা ঢাকা জেলায় চলাচলের জন্য। আমি উল্টোপথ দিয়া না চলাচল করলে তো নয়াবাজার বা তাঁতিবাজার দিয়া ঘুইরা আইতে হইবো। তহন ট্রাফিক ধইরা মামলা দিতে চায়। ৫শ-১ হাজার টাহা তহন তাগোরে (ট্রাফিক) চান্দা দিয়া ছুটতে হয়। তাই আমরা উল্টা চলাচল করি।’

বাবুবাজার ব্রিজের উত্তর পাশের প্রবেশদারে বুধবার দুপুরে দায়িত্বরত সার্জেন্ট হুমায়ন ঢাকা টাইমসকে বলেন, এই ব্রিজে বছরের পর বছর যানজট লেগেই থাকে। অন্যান্য এলাকার তুলনায় এই এলাকা দিয়ে বেশি পরিবহন চলাচল করে। যানজট লাগার প্রধান কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নদীর পার থেকে তাঁতিবাজার পর্যন্ত সড়কের পাশ খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও বছরজুড়েই এই সড়ক ভাঙা থাকায় যানজট বেশি হচ্ছে। এই রাস্তাটি আর আলোর মুখ দেখে না।
আকাশ বর্মণ নামের স্থানীয় বাসিন্দা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ব্রিজের দুই পাশে ট্রাফিক পুলিশ সবসময় থাকে না। এছাড়াও পুলিশ এই ব্রিজের ওপর অবৈধ স্ট্যান্ড বসিয়ে নিয়মিত টাকা নিচ্ছে। এজন্য তারা ব্রিজের ওপর থেকে স্ট্যান্ড সরাতে কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখছেন না।
এদিকে নয়াবাজার থেকে তাঁতিবাজার পর্যন্ত সড়কের পাশে খোঁড়া রয়েছে দীর্ঘদিন। এর মধ্যে সেই সড়কের দুই পাশেই রয়েছে কয়েকশ পিকআপ-বাসস্ট্যান্ড। নয়াবাজারের নবাব ইউসুফ রোডের পাশে প্রতিদিন শতাধিক পিকআপ পার্কিং করে রাখা হয়।

রফিক নামের এক পিকআপচালক ঢাকা টাইমসকে বলেন, অনেক বছর ধরেই আমরা এই রোডে পিকআপ রাখি। এজন্য থানা ও ট্রাফিক বক্সে আমরা মাসিক টাকা দেই। আমাদের পিকআপগুলা সারিবদ্ধ করে রাখা হয়, তাই রাস্তা বন্ধ হয় না। পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় আমরা এইখানে পিকআপ রাখি।

যানজটের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করে ডিএমপি ট্রাফিকের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার আসমা সিদ্দিকা মিলি ঢাকা টাইমসকে বলেন, বাবুবাজার ব্রিজে যানজট মানুষের নিয়মিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর জন্য অনেক কিছুই দায়ী। ব্রিজের নিচে নয়াবাজার থেকে তাঁতিবাজারের যে সড়ক রয়েছে, সেই সড়কের কিছু অংশ খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া রাস্তাটি অনেক দিন যাবতই ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। এতে করে পরিবহনের ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। একই সড়কে আবার পিকআপ-ট্রাক পার্কিং করা রয়েছে। এতে করে রাস্তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পরিবহন সংখ্যা অনেক বেশি। 

তিনি বলেন, ব্রিজের নিচের সড়কে দিনে ও রাতে কয়েকশ ট্রাক-কনটেইনার পার্কিং করা থাকে। এতে করে নিচের রাস্তাটি বন্ধ হয়ে থাকে। কয়েকটি বড় বড় মার্কেট থাকায় এই রাস্তায় পরিবহনগুলো পার্কিং করা হয়। পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় তারা রাস্তায় পার্কিং করে মালামাল লোড-আনলোড করে থাকে।

ব্রিজের ওপর যানজটের কারণ হিসেবে মিলি আরো উল্লেখ করে বলেন, বাবুবাজার ব্রিজটি দুই পাশে ওঠা-নামার জন্য সিঁড়ি দেওয়া হয়েছে। এই সিঁড়ির জন্য শত শত মানুষ ব্রিজটিতে উঠে পারাপারের জন্য যাত্রীবাহী পরিবহন থামায়। এতে করে ব্রিজটিতে যানজট লেগেই থাকে। ব্রিজের ওপর গাড়ি থামানোর দায়ে মাঝেমধ্যেই ট্রাফিক আইনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকে, তবে পরিবহনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারলেও মানুষকে তো আর আটকানো যায় না। 

(ঢাকাটাইমস/১৫ফেব্রুয়ারি)