সরেজমিন মধ্যরাতের ব্যাংকপাড়া: ‘পুলিশের চোখে আবার ঘুম আসে নাকি’

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:১৬ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:০৭

হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস

রবিবার দিনগত রাত ১২টা ১৫মিনিট। রাজধানী ঢাকা তখন ঘুমন্ত, কোলাহল মুক্ত। ব্যাংকপাড়া হিসেবে পরিচিত মতিঝিল থানার প্রধান ফটকে দায়িত্ব পালন করছেন দুজন পুলিশ সদস্য। ভেতরে ঢুকতেই বললেন, ‘বড় স্যারেরা কেউই নাই, কোনো সহায়তা লাগলে ডানে ডিউটি অফিসারের রুমে যান।’ গিয়ে দেখা গেল এসআই উজ্জ্বল নামের ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশেই ওয়্যারলেস অপারেটর। চোখে ঘুমের ছাপ লেগে থাকলেও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন তারা। 
রাতে মতিঝিল থানার কয়টি টিম ব্যাংক পাড়ায় ডিউটিরত আছেন জানিয়ে ডিউটি অফিসার উজ্জ্বল ঢাকা টাইমসকে বলেন, রাত ৮টার দিকে তাদের রাতের ডিউটি শুরু হয়ে পরদিন সকাল ৮টায় শেষ হয়। রবিবার রাত ৮টা থেকে পরদিন সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৭জন এসআই ও দুইজন এএসআই তাদের সঙ্গীয় ফোর্সসহ আলাদা টিম নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। কোথাও কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে ওয়্যারলেসে বিষয়টি থানায় অবগত করে থাকেন তারা।
রাত ১টায় মতিঝিল থানা থেকে বের হয়ে ঢাকা টাইমসের গন্তব্য মতিঝিল ব্যাংকপাড়া। থানার পাশ দিয়ে প্রধান সড়কের আধা কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে সোশ্যাল ইসলামিক ব্যাংক কর্পোরেট ব্র্যাঞ্চ, ডাচ বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যিক শাখা, উত্তরা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা, সিটিজেন ব্যাংক প্রধান শাখা, যমুনা ব্যাংক বৈদেশিক বাণিজ্যিক শাখাসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক। রাত ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে এই ব্যাংকগুলোর আশপাশে কোনো পুলিশ সদস্যদের সেখানে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। তবে ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রহরীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। 
তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে  তারা বলেন, প্রতি রাতেই ব্যাংক ও এটিএম বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তাদের বিশ্রামের জন্য ব্যাংক বা বুথের পাশে একটি চেয়ারও থাকে। তবে ডিউটি চলাকালে তারা কেউই ঘুমান না। ব্যাংকের পাশে দু-একটা চায়ের ভাসমান দোকান থেকে তারা মাঝে মধ্যে কিছু খাবার খেয়ে থাকেন বলেও জানান তারা।
রাত ২টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে দেখা যায়, দুটি পুলিশের গাড়ি থামা নো। কাছে যেতেই দেখা যায় থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার রায়হান উদ্দিন। এ সময় রায়হানকে দেখা যায় বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। উপস্থিত পুলিশ অফিসারদের দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।
ঢাকা টাইমসকে সহকারী পুলিশ কমিশনার রায়হান উদ্দিন বলেন, থানার অফিসারদের ডিউটি আমরা সরেজমিনে তদারকি করে থাকি। যাকে যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা তা আমরা গিয়ে পরিদর্শন করে আসি। এটা আমাদের নিয়মিত রুটিন।
রাত আড়াইটার দিকে মতিঝিলের দিলকুশা এলাকার ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, মতিঝিল থানার এএসআই সরোয়ার ও তার সঙ্গে থাকা দুজন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। 
এএসআই সরোয়ার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দিলকুশা এলাকায় আজকে (রবিবার) আমার রাতের ডিউটি। রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত আমাদের রাতের ডিউটি থাকে।’
রাতে ঘুম আসে কিনা বা ঘুমাতে ইচ্ছে করে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুলিশের চোখে আবার ঘুম আসে নাকি। রাইত ৮টা থেইকা সকাল ৮টা পর্যন্ত ডিউটি। আবার দুপুর ২টা থেইকা রাইত ১০টা পর্যন্ত বই মেলায় ডিউটি দিয়া রাখছে। ঘুমের সময় কই। সকাল থেকে দুইটার মধ্যে যতটুকু সময় পাই একটু ঘুমাইতে পাড়ি।’
এদিকে রাত ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত মতিঝিল এলাকার প্রধান সড়কগুলোর পাশে থাকা ব্যাংকগুলোর আশপাশে মতিঝিল থানার কোন পুলিশ সদস্যকে দেখতে পাওয়া যায়নি। মতিঝিল থানার এসআই মোফাজ্জল হোসেনকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে দায়িত্ব দেওয়া হলেও রাত আড়াইটার পর তাকেও সেখানে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। এমনকি সোনালি ব্যাংক,  জনতা ব্যাংক ও শাপলা চত্তরের আশপাশেও কোন পুলিশ সদস্য চোখে পরেনি।
মতিঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, শুধু মতিঝিল থানার ব্যাংকপাড়া এলাকার জন্যই রাতে একটি মোবাইল টিম রাখা হয়েছে। এই টিম পুরো ব্যাংক পাড়ায় ভ্রাম্যমাণ হিসেবে ঘুরে ঘুরে ডিউটি করে থাকে। এছাড়াও পুরো থানায় ৭টি টিম আলাদা আলাদা কাজ করে।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার জন্য মতিঝিল থানায় পুলিশের জনবল বাড়ানো বলে মনে করছেন কিনা এর জবাবে তিনি বলেন, মতিঝিল এলাকাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ এড়িয়া। এই এলাকায় দেশের প্রায় সকল ব্যাংকেরই প্রধান ও কর্পোরেট শাখা রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকও এই এলাকায়। এড়িয়া হিসেবে মতিঝিল থানা এলাকা অনেক বড় এড়িয়া নিয়ে গঠিত। সেই হিসেবে থানার জনবল অনেক কম। থানায় পুলিশের জনবল বাড়ানো উচিত বলেও মনে করছেন এই কর্মকর্তা। 
ব্যাংকের পাহারায় সারা রাত শুধু সিকিউরিটি গার্ডদেরকেই (নিরাপত্তা প্রহরী) লাগাতার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। 
সৌরভ নামের এক নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরাই একমাত্র সঠিক দায়িত্বটা পালন করি। একফোঁটাও রাইতে ঘুমাই না। ডিউটি শেষ কইরা আরেকজনরে ডিউটিতে রাইখা পরে বাসায় যাইয়া ঘুমাই। এত কষ্টের পরও আমাদের বেতন কম। ঈদে কোরবানিতেও আমরা ছুটি পাই না। কোনো উৎসবের দিনেও আমাদের ছুটি নাই। আমরা মানুষের টাকা পাহাড়া দেই। আর মানুষ তাদের টাকা নিয়া উৎসব করে।

((ঢাকাটাইমস/এইচএম/এআর)