নারী আলোকিত হয়ে উঠুক নিজের শক্তিতে

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২৪, ১০:৩৩

আবদুল্লাহ আল মোহন

আজ ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর কৃতিত্বকে স্মরণ ও সম্মান জানাতে এই দিনটি পালন করা হয়। ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ / এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’- এই প্রতিপাদ্যটিকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪ পালিত হচ্ছে। লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এই দিনটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নারী দিবস শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পালনের কোনো উৎসব নয়, এই দিবস মানবিকবোধের চেতনায় জাগ্রত এক সম্মিলিত প্রয়াস। নারী দিবস পালনকে কেন্দ্র করে বিতর্কও রয়েছে। কেউ মনে করেন- নারীর প্রাপ্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে মনে করিয়ে দিতে নারী দিবস পালনের দরকার রয়েছে। অন্যরা মনে করেন- নারীদের জন্য আলাদা দিবস উদ্যাপন করার মাধ্যমেই বরং নারীদের দুর্বল করে দেখা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দুই পক্ষেরই বক্তব্য যুক্তিসংগত। তবে, এখনো যেহেতু নারীর প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি, তাই নারী দিবসকে কেন্দ্র করে বছরে একটি দিনও যদি সমাজের ভাবনায় সচেতনভাবে উঠে আসে, তাতে ক্ষতি তো নেই! নারী দিবসকে কেন্দ্র করে নানাজনের নানা ভাবনা থাকলেও প্রকৃত অর্থে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে নারীর অর্জন উদ্যাপন করা হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল লক্ষ্য। এর পাশাপাশি সমাজে নারীর সমতার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে এ লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়ানোও এর আরেকটি উদ্দেশ্য। তাই প্রত্যাশা আন্তর্জাতিক নারী দিবস কেবল পালনে নয়, প্রবলভাবে দৃশ্যমান হোক সকলের সম্মিলিত দৃশ্যমান প্রচেষ্টায় এবং আন্তরিক জীবনচর্চায়।
নারী মানে শক্তি, নারী মানে ক্ষমতা। জন্মের পর থেকে সামাজিক বাধা অতিক্রম করে নিজের সত্তা বিকাশের চ্যালেঞ্জ নিয়ে সে বড়ো হতে থাকে। নিজের ঘর, পরিবার, পরিজন ছেড়ে অন্য এক পরিবেশে গিয়ে যোগ হয় নতুন চ্যালেঞ্জ। সে তার ক্ষমতার জাদুবলে তার শরীরে বড়ো করে আরেক প্রাণ। নিজের পরিবার, পেশাগত দায়িত্ব সামলে সে সন্তান বড়ো করে। নারীর সহনশীলতা তুলনাহীন। সে নিজেই ক্ষমতার উৎস। নারীর শক্তি নারী নিজেই। নারী দিবসে রবীন্দ্রনাথের ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ কবিতার চরণ স্মরণ করি- ‘মুক্ত করো ভয় / আপনা মাঝে শক্তি ধরো / নিজেরে করো জয়’। ‘নারী’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সামনে ভেসে উঠে মমতাময়ী মায়ের প্রতিচ্ছবি যার মাধ্যমেই আমরা পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছি। সেই অপার মমতার অধিকারী নারীদেরকে কেন্দ্র করেই পালিত হয় নারী দিবস যদিও এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। অমিত সম্ভাবনার অধিকারী নারী শক্তির যথাযথ বিকাশ সম্ভব হয় না নূন্যতম সুযোগ এবং যথাযথ মুল্যায়নের অভাবে। পুরুষশাসিত সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের ছোটো করে দেখা হয়। দমিয়ে রাখা হয় তাদের দিগ্বিজয়ী শক্তিকে, তাদেরকে সম্মুখীন হতে হয় অনেক সহিংসতার। নারীদের প্রতি এইসব অবিচার প্রতিরোধ করে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই নারী দিবস পালনের মূল বিষয়।
একান্তই নারীদের একটি দিবস আন্তর্জাতিক নারী দিবস; যার আদি নাম ‘আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস।’ প্রতি বছর মার্চ মাসের ৮ তারিখ পালিত হয় দিবসটি। নানা দিবসের ভিড়ে এই দিবসটিকে একটু আলাদাভাবেই বিশ্লেষণ করা দরকার। কারণ, মানুষ হিসেবে একজন নারী পরিপূর্ণ অধিকারের দাবিতে সুদীর্ঘকাল যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, তারই সম্মানস্বরূপ পালিত হয় নারী দিবস। অন্তত একটি দিন গোটা বিশ্ব আলাদা করে মনে করে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এই জগতের শক্তির উৎস আর প্রেরণা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নারী দিবস পালনের সূত্রপাত ঘটে ১৮৫৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে। নারী শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি নির্ধারণসহ কর্মপরিবেশের উন্নয়ন- এরূপ দাবিতে নারী শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন পরবর্তীতে তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি প্রতিবছর পালিত হয়।
এবার একান্ত ভাব-অনুভবের কথা কিছু বলা যাক। নারী দিবসকে যেন আমরা রঙের সমাবেশে কিংবা পোশাকের সচিত্র উপস্থাপনায় আটকে না রাখি। নারীদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্র-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতটা সহায়ক পরিবেশে আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি বা আন্তরিক মনোযোগ দিয়ে থাকি সেই প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে মনে চলেই আসে। আগে ঘরের দিকেই তো নজর দিতে হয়। সেই দৃষ্টিপাতে আমি আমাদের আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’ পরিচালনায় দীর্ঘ দেড় যুগের অভিজ্ঞতায় একজন শিক্ষক হিসেবে প্রবলভাবে অনুভব করি নারী দিবস যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য ব্যবহার উপযোগী কমনরুম এবং বাথরুম-টয়লেট ব্যবস্থাপনার দিকে একটু সুনজর দেন নীতিপ্রণেতারা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক হলেও জীবনাচরণে, অভিজ্ঞতায়, দক্ষতায় সর্বোপরি মানসিকতায় প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে কোনো নারী দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেই যে মেয়েদের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে ইতিবাচক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বা করবেন, আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে মোটেই সন্তোজনক নয়। এ বিষয়ে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের কমন রুম এবং টয়লেট ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিলেই অনেকের ধারণা আরো সুস্পষ্ট হবে। আর তাই ধারণা করা যায়, নারী-পুরুষ নয়, যোগ্যতা-দক্ষতা এবং অবশ্যই মানবিক গুণাবলির ইতিবাচক মানসিকতার ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব শিক্ষার উপযুক্ত সহায়ক পরিবেশ সুনিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন উপলক্ষ্যে একই রঙের পোশাক কিনতে অনেক প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ অর্থের ব্যয় করা হয়, সেই পরিমাণ অর্থ যদি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিশেষত ছাত্রীদের টয়লেট, কমনরুম ব্যবহার উপযোগী করার জন্য ব্যয় করা হতো তাহলেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের চেতনা এবং তাৎপর্য সঠিকভাবেই প্রতিভাত হতো বলেই আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি। সমতার বিশ্ব গড়তে টাকা বা অর্থের চেয়ে মানসিকতার পরিবর্তনই সবচেয়ে বেশি জরুরি বিবেচনা করি। আমরা কাজের কাজটি না করে দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতায় দারুণ পারঙ্গম।

 
মানবিক সমাজ সর্বোপরি পৃথিবীর প্রত্যাশায় সর্বাগ্রে আমাদের চরম স্ববিরোধী মন-মানসিকতার আমূল বদল দরকার। যে-যার অবস্থান থেকে নিজে সর্বোত্তম চেষ্টাটাই জরুরি বিবেচনা করি। এক্ষেত্রে জীবনাদর্শের ত্রুটি, ব্যক্তিগত লাভ-লোভের সংকীর্ণতা এড়িয়ে সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগের অভাব প্রকটরূপে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। ব্যক্তির সাংস্কৃতিক মান, রুচিবোধের ব্যাপারটি জীবনাদর্শের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্ব-বিরোধিতার অপসংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারলে প্রত্যাশিত মানবিক উন্নয়ন ঘটবে বলে মনে হয় না। মানবিক উন্নয়ন মানেও নারীর উন্নয়ন, শিশুর উন্নয়ন। এক্ষেত্রে পাঠাভ্যাস প্রবৃত্তির সবিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ দিকটার কথা আমরা প্রায়শই এড়িয়ে যাই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যেমনটি উল্লেখ করতে পারি, মহাসমারোহে গ্রন্থাগার দিবসে র‌্যালি-সমাবেশ-আলোচনার আয়োজন পালন শেষে একজোট হয়ে দাবি উপস্থাপন করা হয়, প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক আয়োজনে বিগত বছরে থালা-বাটি নেওয়া হয়েছে, এবার যেন বিছানার চাদর দেওয়া হয়, মোটেই বই নয়। চাদরের মতোন যে উপহারগুলো কেনা হয় কারো ব্যক্তিগত টাকায় নয়, রাষ্ট্রের কিংবা প্রতিষ্ঠানের কোনো-না-কোনো ফাণ্ডের অর্থেই। যদিও সরকারি নির্দেশনা আছে শিক্ষা সহায়ক উপহার ক্রয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্ত কে কার কথা শোনে! কাগজে-কলমে অনেক সুন্দর নীতিমালা আমাদের আছে কিন্তু নেই সেই নির্দেশনা-প্রজ্ঞাপন মানার মানসিকতা। অর্থ নয় সুস্থ চিন্তার দারিদ্র্য কিংবা সুরুচির সংস্কৃতির তীব্র অভাবই আমাদের মনোজগতে প্রকটভাবে দৃশ্যমান। এমনই হচ্ছে আমাদের জাতীয় চরিত্রের দারুণ স্ববিরোধী স্বরূপ! সুতরাং চরিত্র বা মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ছাড়া কোনো ধরনের বৈষম্যই নিরসন করা সম্ভব নয়। কেননা বস্তুগত, অবস্তুগ এবং মানবিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণের স্বক্ষমতার ক্ষমতায়নের ধারণাকে বাস্তায়নে সবার আগে চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ, রুচির দুর্ভিক্ষের বিলোপ সাধনে কার্যকরী পদক্ষেপ। নারী দিবস পালনের তাৎপর্য যেন সেই অভিমুখেই প্রবাহিত হয়, সেই প্রত্যাশা একান্তভাবে করতেই পারি।
একান্ত অভিজ্ঞতার তিক্ত আলাপন ছেড়ে জীবনবোধের দিকে নজর দেওয়া যাক। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের নারী কবিতায় বলেছেন- ‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’ ধরণীতে নারীদের জয়গান গাওয়া হলেও এখনো প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীসমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও নারীরা নিজগৃহে অত্যাচারের মুখোমুখি হয়, এখনোও তাদের সহ্য করতে হয় মানসিক যন্ত্রণার। যেই নারীরা নিজ পরিবারের কথা চিন্তা করে জীবন ত্যাগ করতে পারে তারাই পরিবারসহ সামাজিকভাবে প্রাপ্য সম্মান পায় না। নারীশ্রমিকদের এখনো আমাদের দেশে ছোটো করে দেখা হয়, তারা তাদের ন্যায্য মজুরিও পায় না। এভাবেই বহুকাল থেকে নারীরা বৈষম্যের সম্মুখীন হয়ে আসছে। এখনো তাদের যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধির শিকার হতে হয়। এখনো খবরের পাতায় ধর্ষণের খবর অহরহ প্রকাশিত হয় অর্থাৎ নারীদের নিরাপত্তা প্রদান এখনো সম্ভব হয়নি। এইসব বৈষম্য দূরীকরণে সকলকে আহ্বান করাও নারী দিবস পালনের প্রতিপাদ্য। বর্তমানে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয় না। আমাদেরকে প্রথমেই সেই মানসিকতা দূর করতে হবে, পুরুষদের অংশগ্রহণ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জরুরি। শুধুমাত্র নারী দিবসে নয় নারীদের প্রতি সম্মান ও সমতার বিষয়টি বছরের প্রতিটি দিনে প্রতিফলিত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে সমাজের যেই স্তরে নারীদের প্রতি সহিংসতা বেশি সেখানে সচেতনতা বাড়াতে হবে। গ্রামাঞ্চলে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে চলমান বৈষম্য ও সহিংসতা দূর করতে হবে এবং সমাজের সব মানুষের মধ্যে অসাম্য দূর করতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব পরিসরে নারীরা যেন পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষ যেন স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পারে, এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন কখনোই অর্জন করা সম্ভব হবে না। আমাদের সবাইকে নিজেদের প্রথাগত ও অনুদার মানসিকতা বদলাতে হবে। আর এজন্য সবার আগে দরকার এ বিষয়ে সচেতনতা; হোক না তা নারী দিবসকে কেন্দ্র করেই! নারীরা আলোকিত হয়ে উঠুক নিজ শক্তিতে, আলোকিত করুক সমাজ ও পৃথিবীকে, নিজ উদ্যমে জয় করুক সাফল্যের প্রতিটি চূড়া- নারী দিবসে এটিই কাম্য।

আবদুল্লাহ আল মোহন: লেখক, গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা