ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-৬

কোরআনে বর্ণিত মানবকল্যাণের বিধানাবলি

প্রকাশ | ১৬ মার্চ ২০২৪, ২০:১৮ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৪, ১৫:২৭

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী

প্রিয় পাঠক, রহমতের সময়গুলো দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। কোরআনকে জানার মধ্য দিয়ে আসুন সময়গুলো অতিবাহিত করি। আজ আমরা ৬ষ্ঠ পারার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে চাই। চলুন তাহলে শুরু করি...

আগের পর্ব: বিয়ে-পারিবারিক ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক ইহসান

পঞ্চম পারার শেষে মুনাফিকদের নিন্দা করা হয়েছে। তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির ধমক দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ষষ্ঠ পারার শুরুতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা কোনো মন্দ কথা প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে যদি কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে কিংবা মন্দ কথাটি কোনো জালেমের সম্পর্কে হয় তা হলে তার সমালোচনা করার সুযোগ রয়েছে। তাই আল্লাহ তায়ালা মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়াতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

এ ছাড়াও পঞ্চম পারায় এ সূরার যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:

 

ইহুদিদের ভ্রান্তি

১. মুনাফিকদের সমালোচনা করার পর ইহুদিদের অপরাধের কথা তুলে ধরা হয়েছে। কেননা অপরাধের দিক থেকে তারা মুনাফিকদের ভাই। তাদের একটি অপরাধ হচ্ছে তারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে হেফাজত করেছেন। সম্মানের সাথে তাকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। (১৫৮)

 

খ্রিষ্টানদের ভ্রান্তি

২. ইহুদিদের পর আহলে কিতাবদের অপর সম্প্রদায় খ্রিষ্টানদের আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় ভুল বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ এক নয়; বরং তিনি তিন সত্তার-পিতা, পুত্র ও রুহুল কুদস-এর সমন্বিত রূপ (নাউজুবিল্লাহ)। খ্রিষ্টানদের বোঝানো হয়েছে, তোমরা ধর্মের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করো না। ঈসা আলাইহিস সালামকে তার মূল মর্যাদা থেকে বড় করো না। তোমরা বলো না যে, খোদা তিনজন। (১৭১)

যখন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজেই আল্লাহ তায়ালার সামনে নিজেকে দুর্বল ভাবেন, তার উপাসনা করতে তিনি কোনো লজ্জাবোধ করেন না, বরং সম্মানবোধ করেন; তা হলে তোমরা কে, যারা ঈসা আলাইহিস সালামকে খোদা সাব্যস্ত করছ? (১৭২)

 

কয়েকটি বিধান

৩. এই সুরার শুরুতে নারীদের বিষয়াদি, নিকটাত্মীয় ও উত্তরাধিকারীদের অধিকারসমূহের প্রতি যত্নবান হতে বলা হয়েছিল। সূরার শেষে বিষয়টি পুনরায় আলোচনা করা হয়েছে। (১৭৬)

 

সূরা মায়েদা

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১২০। রুকু সংখ্যা: ১৬

 

নামকরণ

এই সূরায় যেহেতু দস্তরখানের আলোচনা এসেছে এ কারণে একে মায়েদা নামকরণ করা হয়েছে।

 

সূরা মায়েদা সর্বশেষ সূরা। মদিনায় হিযরত করার পর এটি অবতীর্ণ হয়। কোনো কোনো রেওয়ায়েত দ্বারা বোঝা যায়; যেমন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, সবশেষে সূরা মায়েদা নাজিল হয়েছে।

 

এই সুরায় হালাল-হারামের বিভিন্ন বিধান এবং তিনটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

 

এ সূরার একটি বিশেষত্ব

 

এর একটি আয়াত বিদায় হজের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে দীন পূর্ণ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটা সেই আয়াত, যার ব্যাপারে এক ইহুদি হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছিল, আমিরুল মুমিনিন, এ আয়াত যদি আমাদের ওপর অবতীর্ণ হতো তা হলে আমরা সেদিনকে ঈদের দিন ঘোষণা করতাম। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি সেইদিনটির কথা জানি এবং যে সময় অবতীর্ণ হয়েছে সেই সময়ের কথাও জানি। শুক্রবার আরাফার দিন সন্ধ্যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এদিন যেন আমাদের দুটি ঈদ একত্র হয়েছিল।

ষষ্ঠ পারায় সূরা মায়েদার যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:

 

অঙ্গীকার পূরণ করার নির্দেশ

১. এ সূরার শুরুতে মুমিনদের মানুষ ও রবের মধ্যে বা মানুষ-মানুষের মধ্যে সম্পাদিত সকল বৈধ চুক্তি ও অঙ্গীকার পূরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন এ সুরায় আল্লাহ তায়ালা বান্দার ওপর যেসব বিষয় ফরজ করেছেন এবং ক্রয়-বিক্রয়, শরিকানা-ব্যবসা, ভাড়া, বিয়েশাদি-সহ সকল প্রকার চুক্তির আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামের চুক্তি ও অঙ্গীকারের প্রতি গুরুত্বারোপের বিষয়টি এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

কিছু হারাম খাদ্য ও পানীয়

 

২. জাহেলিযুগে যেসব খাদ্য ও পানীয়কে হালাল মনে করা হতো, তার কিছু হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কেননা তা খাওয়ার কারণে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়াও চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চরিত্রের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে থাকে। যেমন, মৃত জন্তু, প্রবাহিত রক্ত, শূকরের মাংস, আল্লাহ ছাড়া অন্যকারো নামে উৎসর্গীকৃত প্রাণীর মাংস। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা হলে বাধ্য হয়ে গুনাহের প্রতি কোনো রকম আকৃষ্ট না হয়ে ক্ষুধা নিবারণ হয় পরিমাণ খাওয়া জায়েজ আছে। এসব নাপাক বস্তু ছাড়া সকল পবিত্র জিনিস হালাল ঘোষণা করা হয়েছে। (৩-৪)

 

অজু ও গোসলের নেয়ামত

৩. হালাল-হারামের আলোচনা শেষে মুসলমানদের ওপর যে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ও অনুগ্রহ রয়েছে, সেটি স্মরণ করে দিয়েছেন। কেননা তিনি অজু ও গোসলের নেয়ামত দান করেছেন। এর মাধ্যমে মুমিনদের দেহ ও মন (যাহের বাতেন) দুটোই পবিত্র হয় এবং আল্লাহর সাথে একান্ত আলাপনের জন্য কহানি প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বান্দাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার কৃত অনুগ্রহের মধ্যে এটিও একটি যে, পানির সক্ষমতা না থাকার ক্ষেত্রে তিনি তায়াম্মুমের অনুমতি দিয়েছেন।

ইসলাম হচ্ছে এক সহজ ধর্ম। এতে প্রতি কদমে মানুষের কষ্টের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে ষষ্ঠ রুকুতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের কষ্ট চান না; বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে এবং তোমাদের উপর ইহসান পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা শোকরগুজার হতে পারো। (৬)

 

ইহুদিদের ভীরুতা, ফাসাদ সৃষ্টি ও অহংকার

 

৪. এ পারার সপ্তম রুকুতে ইহুদিদের ভীরুতা, তাদের ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি, অবাধ্যতা ও অহংকারের আলোচনা করা হয়েছে। এসব ত্রুটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানরা যেন নিজেদের তা থেকে বাঁচিয়ে রাখে। ইহুদিদের পাশাপাশি খ্রিষ্টানদের অবস্থার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তাদের থেকেও আল্লাহ তায়ালার বিধান পালনের অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা তা ভঙ্গ করেছে। এ কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা ঢেলে দিয়েছেন। উভয় সম্প্রদায় আকিদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাকগত বহু সমস্যায় জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও এই দাবি করে যে, আমরা আল্লাহর পুত্র এবং তার প্রিয়ভাজন। তাদের এ দাবি খণ্ডন করতেই বলা হয়েছে, যদি তোমরা প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তায়ালার প্রিয় পাত্র হয়ে থাকো তা হলে আল্লাহ কেন গুনাহের কারণে তোমাদেরকে শাস্তি দেন। (১৮)

তাদের দাবি খণ্ডনের পর এই নিন্দা দীনুল হক ও খাতামুল আমবিয়া হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনার জন্য তাদের দাওয়াত দেওয়া।

৫. অষ্টম রুকুতে বলা হয়েছে, হযরত মুসা আলাইহিস সালাম ইহুদিদের প্রথমে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর তাদের পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনে প্রবেশ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। কিন্তু এসব দুরাচারী এই উৎসাহদানের কারণে মুসা আলাইহিস সালামের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ শুরু করে। তারা বলে, ‘মুসা, আমরা এই শহরে কখনো প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না সেখান থেকে আমালিকারা বের হয়। তুমি এবং তোমার প্রতিপালক গিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করো। আমরা এখানেই বসে রইলাম।’ (২৪)

 

হাবিল-কাবিলের ঘটনা

 

৬. বনি ইসরাইলের অবাধ্যতা ও নাফরমানির আলোচনার পর নবম রুকুতে আদম আলাইহিস সালাম ও তার দুই ছেলে হাবিল-কাবিলের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কাবিল হিংসাবশত আপনভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল। হিংসা ইহুদিদের মধ্যেও পাওয়া যায়। যে কারণে তারা শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত অস্বীকার করে।

 

ডাকাত, রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশৃঙ্খলাকারীদের শাস্তি

 

৭. এ ঘটনার সাথে কিছুটা মিল থাকার কারণে ডাকাত, রাষ্ট্রদ্রোহী, পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলাকারী লোকদের শাস্তির আলোচনা করা হয়েছে। তাদের কাউকে শূলীতে চড়ানো হবে। কাউকে হত্যা করা হবে। উলটো দিক থেকে কারও হাত-পা কেটে দেওয়া হবে। (৩৩-৩৪)

 

চোরের হাত কাটার নির্দেশ

 

৮. এরপর দশম রুকুতে পুরুষ চোর ও নারী চোরের হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা এরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শান্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকে। এই কারণে তাদেরকে এমন শাস্তি দেওয়া আবশ্যক, যার মাধ্যমে অন্যরাও শিক্ষা লাভ করতে পারে।

 

শাস্তির বিধানের মাধ্যমে একটি বিষয় বুঝে আসে যে, সমাজের জন্য যেসব মানুষ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত, যা কল্পনা করামাত্র অপরাধীরা অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। তাদের আর মাথা ওঠানোর সাহস হবে না। কিছু হাত কাটার মাধ্যমে যদি লাখো মানুষ নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে তা হলে তা লোকসানের কী? অপরাধের সয়লাবে গোটা বিশ্ব আজ জাহান্নামে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থা চিৎকার করে মুসলমানদের ইসলামি বিধান ও হুদুদ বাস্তবায়ন করার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

 

মুনাফিক ও ইহুদিদের বিধান

 

৯. ডাকাত, ব্যভিচারী, চোর, হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের বিধান বর্ণনা করার পর ফেতনাবাজ দুই সম্প্রদায়ের আলোচনা করা হয়েছে। তারা হচ্ছে মুনাফিক ও ইহুদি। প্রথম গোষ্ঠীর আলোচনা করা হয়েছে সংক্ষেপে আর দ্বিতীয় গোষ্ঠীর আলোচনা বিস্তারিতভাবে করা হয়েছে। বলা হয়েছে, হে রসূল! কুফরীর ব্যাপারে তাদের প্রতিযোগিতা যেন আপনাকে দুঃখ না দেয়, যারা মুখে বলে ঈমান এনেছি কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান আনেনি। আর যারা ইহুদি, তারা মিথ্যা কথা শুনতে বিশেষ পারদর্শী, তারা আপনার কথাগুলো অন্য সম্প্রদায়ের স্বার্থে কান পেতে শোনে যারা আপনার নিকট (কখনো) আসেনি, এরা আল্লাহর কিতাবের শব্দগুলোকে প্রকৃত অর্থ হতে বিকৃত করে। তারা বলে, তোমরা এ রকম নির্দেশপ্রাপ্ত হলে মানবে, আর তা না হলে বর্জন করবে। বস্তুত আল্লাহই যাকে ফিতনায় ফেলতে চান, তার জন্য আল্লাহর কাছে আপনার কিছুই করার নেই। ওরা হল সেই লোক, যাদের অন্তরাত্মাকে আল্লাহ পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্য দুনিয়াতে আছে লাঞ্ছনা, আর তাদের জন্য আখেরাতে আছে মহা শাস্তি। 

শয়তানের ওয়াসওয়াসা

 

শয়তানের ওয়াসওয়াসা ও কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকার জন্য আদম-সন্তানকে বারবার সম্বোধন করা হয়েছে। মানুষ যেন তার চটকদার কথা শুনে ধোঁকায় না পড়ে যায়, এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। কেননা সে অত্যন্ত ধূর্ত শত্রু, বন্ধুত্বের পোশাক পরে আসে। সে কূটচক্রান্তকারী, নিজেকে কল্যাণকামীরূপে প্রকাশ করে। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য, ভালোকে মন্দ আর মন্দকে ভালোরূপে জাহির করার ক্ষেত্রে সে খুব পটু। দুনিয়াতে যেসব লোক এ ধরনের কাজ করে প্রকৃতপক্ষে তারা শয়তানের এজেন্ট।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রথমে পোশাক সম্পর্কে সম্বোধন করা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয়বার সম্বোধন করে বলা হয়েছে, অভিশপ্ত ইবলিস হয়রত আদম আলাইহিস সালাম ও হাওয়া আলাইহাস সালামের পোশাক খুলে ফেলেছিল। তাদের সতর প্রকাশ করে দিয়েছিল। এর দ্বারা বোঝা যায় আদম-সন্তানকে লজ্জা- শরমের পোশাক থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া এবং তাদের নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতার পথে নিয়ে যাওয়া যেন ইবলিসের প্রধান লক্ষ্য।

 

ইসলামি পোশাক

সতর আবৃতকারী পোশাক মানুষ ও জীবজন্তুর মাঝে পার্থক্যরেখা টেনে দেয়। জীবজন্তু উলঙ্গ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে আর উলঙ্গ হয়েই জীবনযাপন করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পোশাকের মাধ্যমে সম্মান দান করেছেন।

আজ আমরা পশ্চিমা মিডিয়ার মাধ্যমে নির্লজ্জতার যে সয়লাব এবং নারী স্বাধীনতার নামে অশ্লীলতার যে প্রসার দেখতে পাচ্ছি, তাতে বিভিন্নভাবে কোরআনুল কারিম কর্তৃক পোশাকের প্রতি বারবার গুরুত্বারোপের কারণ অতি সহজেই বুঝে আসে।

এ সম্বোধন ছাড়াও ৬ষ্ঠ পারায় সূরা আরাফে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হল:

 

আল্লাহ তায়ালা নির্লজ্জ কাজের নির্দেশ দেন না

মুশরিকরা উলঙ্গ অবস্থায় বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করত। এই নির্লজ্জ কাজ এবং অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে তারা পিতৃপুরুষদের দলিল হিসেবে পেশ করত। তারা বলত যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা এটা করত। কখনো কখনো তারা এমনও বলত যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের এ দাবি খণ্ডন করে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা নির্লজ্জ কাজের নির্দেশ দেন না। তাই তোমাদের এই দাবি আল্লাহর ওপর এক মিথ্যা অপবাদ।

 

প্রকৃত মুসলিম কে?

ইসলাম জীবনের সকল বৈধ চাহিদা পূরণের অনুমতি দেয়; তাই এ এক অসম্ভব ব্যাপার যে, ইসলাম পবিত্র পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করবে। এর দ্বারা সন্ন্যাসবাদের প্রবক্তাদের দাবি খণ্ডন হয়ে যায়। তারা হালাল এবং পবিত্র জিনিস ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। তারা একে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে। অথচ দেহ ও আত্মা, দীন ও দুনিয়া উভয়ের চাহিদা পূরণকারী ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম।

হযরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু জানতে পারলেন হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু দিনে রোজা রাখেন এবং রাতে নামাজ পড়েন। তার ইবাদতমগ্নতা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, এর ফলে তিনি স্ত্রীর হক আদায় করতে পারতেন না। তখন তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বলেন, আপনার ওপর আপনার রবেরও হক রয়েছে, নফসেরও হক রয়েছে, ঘর ও পরিবারেরও হক রয়েছে। তাই প্রত্যেককে প্রত্যেকের হক প্রদান করুন। হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহ এই উপদেশের কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পেশ করলে তিনি বলেন, ‘সালমান সত্য বলেছে।’

 

দুই পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠী

অষ্টম পারার এগারো ও বারোতম রুকুতে এমন দুই গোষ্ঠীর আলোচনা করা হয়েছে, যারা আকিদা-বিশ্বাস, কাজকর্ম এবং চিন্তাভাবনার দিক থেকে একে অপরের বিরোধী। এক গোষ্ঠী জেদ, হঠকারিতা, কুফুরি ও অহংকারের পথ অবলম্বন করে থাকে। তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। অপর দল ঈমান ও আনুগত্যের পথে চলে। আল্লাহর অনুগ্রহে তারা জান্নাতি হবে।

উভয় দলই যখন নিজ নিজ ঠিকানায় পৌঁছে যাবে, কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী তখন তাদের মাঝে কথাবার্তা হবে। জান্নাতিরা জাহান্নামিদের জিজ্ঞেস করবে, আল্লাহ তোমাদের সাথে যে অঙ্গীকার করেছেন তা সত্য হওয়ার বিষয়টি কি তোমাদের বিশ্বাস হয়েছে? উত্তরে তারা স্বীকার করবে যে, হ্যাঁ, আমরা সেই প্রতিশ্রুতি সত্য পেয়েছি। জাহান্নামিরা যখন জাহান্নামের ভয়ানক ও উত্তপ্ত আগুন এবং ক্ষুৎপিপাসায় পেরেশান হয়ে যাবে তখন জান্নাতিদের দিকে হাত পেতে আবেদন করবে, আমাদের কিছু দানাপানি দাও। কিন্তু তাদের এই আবেদন বৃথা যাবে। আলোচনাটি এ পারার বারো ও তেরোতম রুকুতে উল্লেখ হয়েছে।

 

তৃতীয় দল আসহাবুল আরাফ

তৃতীয় একদলকে কোরআন ‘আসহাবুল আরাফ’ (আরাফবাসী) বলে আখ্যা দিয়েছে। বিশ্বাসের দিক থেকে তারা মুমিন হবে। কিন্তু আমলের দিক থেকে তারা অন্যান্য জান্নাতির তুলনায় পিছিয়ে থাকবে। তাদের না জান্নাত মিলবে আর না তাদের জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে; বরং তাদের ব্যাপারে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবে। তবে পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এই আসহাবুল আরাফ ও জাহান্নামিদের মাঝেও কথাবার্তা হবে, যা তেরোতম রুকুতে আলোচনা করা হয়েছে।

 

আল্লাহ তায়ালার কুদরত ও তাওহিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল

 

এই কথোপকথনের পর আল্লাহ তায়ালার কুদরত ও তাওহিদের উপর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

 

১. স্তরবিশিষ্ট সাত আকাশ একটি অপরটির উপর স্থাপিত হয়েছে। এত বিশাল ও প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও আকাশগুলো কোনো স্তম্ভ ব্যতীতই দাঁড়িয়ে আছে।

 

২. রহমানের আরশ এতটাই প্রশস্ত যে, আসমান-জমিন কিছুতেই তার সংকুলান হবে না। তা কত বড় কেউ তার কল্পনাও করতে পারবে না। বিশাল মরুভূমিতে একটি রিং যেমন ছোট্ট, আরশের তুলনায় কুরসিও তেমন ছোট্ট। আসমান-জমিনে এ কুরসিই যখন সংকুলান হবে না, তা হলে আরশের প্রশস্ততা কত হতে পারে! আরশ ও কুরসি এমন বিষয়, যার ওপর আমরা ঈমান এনে থাকি; কিন্তু তার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা জানি না।

 

৩. চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রের সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতা ও তাওহিদের উপর তৃতীয় দলিল দেওয়া হয়েছে। এসব জিনিস আল্লাহ তায়ালার অধীন। তা শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার পরিধির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে না। তা নিজ পরিধি থেকে বেরও হয় না।

 

ছয়জন নবীর সংক্ষিপ্ত ঘটনা

এসব দলিল উল্লেখ করার পাশাপাশি শেষে ছয়জন নবী হযরত নুহ, হুদ, সালেহ, লুত, শোয়াইব ও মুসা আলাইহিমুস সালামের ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম শাইখুল আমবিয়া হযরত নূহ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আর সবশেষে শোয়াইব আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় যেসব উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:

 

ক. বিরোধীদের নির্যাতনের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা প্রদান করা হয়েছে।

 

খ. অহংকারীদের মন্দ পরিণাম এবং নেককারদের ভালো পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে যে, অবশ্যই একদিন আল্লাহর নিকট যেতে হবে। তখন জালেমদেরকে তাদের জুলুমের শাস্তি পেতে হবে।

 

গ. আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতার ওপর দলিল পেশ করা হয়েছে যে, তিনি উম্মি হওয়া সত্ত্বেও অতীত ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা ও বাস্তবতা সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন।

 

ঘ. অতীত ঘটনাবলিতে মানুষের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা ও উপদেশের উপকরণ রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

চলবে,ইনশাআল্লাহ....

(ঢাকাটাইমস/১৬মার্চ/এসআইএস)

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ, খতীব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।