২৫শে মার্চ ভয়াল রাত
প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আর্মিরা ধরে নিয়ে যাবে: ফরিদা খানম সাকি
ভয়াল ২৫ মার্চের গণহত্যার তান্ডব ছুঁয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলেও। সেই বিভীষিকাময় রাতে বেঁচে ফিরেছিলেন নারী মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ ফরিদা খানম সাকি।
গণহত্যার সেই নৃশংস রাতের বর্ণনা দিয়ে গিয়ে ঢাকা টাইমসকে ফরিদা খানম সাকি বলেন, ‘‘২৫শে মার্চের সেই রাতে রোকেয়া হলে ছিলাম। অনার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার সাথে কুমিল্লার মমতাজ ছাড়া আরও পাঁচজন মেয়ে ছিল। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। তখন ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আমাদের বললেন, ‘তোমরা আরও দুইদিন কাজ করো তারপর ২৫ বা ২৭শে মার্চ বাড়িতে চলে যেও।’ আমরা সেই অনুযায়ী হলে অবস্থান করছিলাম। পরে ২৫শে মার্চ রাতে তখনও ১২টা বাজেনি। আমরা বাইরের কাজ সেরে হলে ফিরে খেয়েদেয়ে মাঠে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ গুলিগোলার শব্দ কানে এল এবং এক সেকেন্ডের মধ্যেই অজস্র লাইটের আলোকেও হার মানাবে এমনভাবে চারপাশ সাদা হয়ে ওঠেছিলো। এমনকি সবুজ ঘাসও সাদা রঙের দেখাচ্ছিল। পাক হানাদার বাহিনী অনর্গল গুলি করতে করতে ক্যাম্পাসের দিকে আসতে শুরু করেছে।’’
পাক হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় হতবিহ্বল হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘প্রতি সেকেন্ডে গুলি হচ্ছে চতুর্দিকে। এমন অবস্থায় আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। ওই মুহূর্তে কী করব বুঝতে না পেরে দৌড়াতে লাগলাম। দৌঁড়ানোর এক পর্যায়ে রোকেয়া হলের ডাইনিংয়ের পেছন দিয়ে একটা রাস্তা দিয়ে প্রভোস্টের বাসায় নক করলাম। কিন্তু সব দরজা বন্ধ। ততক্ষণে হানাদার বাহিনী গেইট ভেঙ্গে ফেলছে। তারপর প্রভোস্ট আপা যেহেতু দরজা খোলেনি তখন ওইদিকে হাউজ টিউটর সাহেরা খাতুন আপার বাসা ছিলো। দৌড়ে সেখানে গেলে সাহেরা খাতুন আপা হাত ধরে টেনে উনার স্টোর রুমে ঢুকালেন। আমরা তখন সাতজন ছিলাম। স্টোর রুমে ঢুকিয়ে তিনি বললেন ‘তোমরা একদম শব্দ করবে না।’ ততক্ষণে পাক হানাদার বাহিনী প্রভোস্ট আপার বাসায় হানা দিয়েছে। তারা প্রভোস্ট আপাকে বললো, ‘মেয়েরা কোথায়? বের করে দেন?’ প্রভোস্ট আপা যতই জানাচ্ছেন যে তার কাছে কেউ নেই কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি। পরে উনার বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজে পায় নি। পরে বন্দুকের পেছন দিক দিয়ে আপার হাতে আঘাত করে চলে গেছে। আর্মিরা ভেবেছিল তার কাছে অনেক মেয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
সেই কালরাতকে স্টোররুমে আবদ্ধ অবস্থায় পৃথিবীর দীর্ঘতম রাত মনে হতে থাকলো ফরিদা খানম সাকিসহ অন্যদের। ভয়ানক রাতের স্মৃতিচারণের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এদিকে সাহেরা আপার বাসায় আমরা যে জায়গায় ছিলাম সেখান থেকে বাইরে কী হচ্ছে সেটা বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের স্টোর রুমটা কারো চোখে পড়বে না। সেই স্টোর রুমেই ছিলাম সারারাত। সেই স্টোররুমে সারা রাত ঘুম নেই, খাওয়া নেই। কোনোরকমভাবে বেঁচে ছিলাম। এত চিন্তা আর ভয়ে প্রতি মুহূর্তেরই মনে হচ্ছিলো যেকোনো সময় তারা ধরে নিয়ে যেতে পারে।’
রাতভর ঘুমহীন আতঙ্কময় সেই কালরাতে বেঁচে গিয়ে পরের দিনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে এই নারী মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘এমন অবস্থায় রাত পার করার পর ২৬শে মার্চ মেহেরুন্নিসা আপা এলেন আমাকে আর মমতাজকে নিতে। তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার বাসায় চলো। ওরা সাহেরার কাছে থাকুক।’ মেহেরুন্নিসা আপা খুব আদর করতেন আমাকে। তিনিও হাউজ টিউটর ছিলেন। শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট ছিলেন তিনি। সেইদিন আপার বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন ঘোষনা হলো ২৭ শে মার্চ কিছুক্ষণের জন্য কারফিও উঠিয়ে দিবে। তখন ২৭ শে মার্চ সকালে ছাত্রলীগের নেতারা এসেছিলেন যদি লাশ পাওয়া যায় তবে বাসায় হস্তান্তর করবেন। কিন্তু আমাদের জীবিত অবস্থায় পেলেন এবং আশ্বাস দিলেন আমাদের গ্রামের বাড়ি পৌঁছে দেবেন। এদিকে আমার ফুপা থাকতেন ঢাকার ওয়ারিতে। সেখানে আব্বা এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। আমি তখন ফুপার বাসায় চলে গেলাম। পরে ১ এপ্রিল বাবার সাথে গ্রামের বাড়ি রওনা দিয়েছিলাম।’
(ঢাকাটাইমস/২৫মার্চ/টিএ)
মন্তব্য করুন